ভারতে একের পর এক ধর্মগুরু যৌন কেলেঙ্কারিতে ফাঁসছেন এবং বিচারে দোষী প্রমাণিত হয়ে তাঁদের সাজাও হচ্ছে৷ তারপরেও বিশ্বাস টলছে না ভক্তদের৷
বিজ্ঞাপন
শেষতম উদাহরণ আসারাম বাপু৷ ছিলেন চাওয়ালা, রিকশাচালক৷ সেখান থেকে আধ্যাত্মিক গুরু হিসেবে চমকপ্রদ উত্থান৷ গুজরাটের সবরমতী নদীর ধারে একটি সাদাসিধে আশ্রম থেকে শুরু করে এখন এক বিশাল সাম্রাজ্য! চার দশকে বিশ্বের ১২টি দেশে ৪২৫টি আশ্রম৷ ভারতে ৫০টিরও বেশি ‘গুরুকূল', বা আবাসিক স্কুল চালায় আসারামের আশ্রম৷ তারই একটিতে বছর দশেক আগে দুই নাবালক ছাত্রের মৃতদেহ পাওয়ার পর প্রথম শোরগোল হয়৷ নিহত দুই ছাত্র, যারা দুই ভাই ছিল, তারা আসারাম বাপুর কালো জাদু চর্চার বলি হয়েছে বলে অভিযোগ তোলেন ওদের বাবা-মা৷ সেযাত্রায় বেঁচে গেলেও নাবালিকা ধর্ষণের মামলায় আর শেষরক্ষা হলো না৷ আসারাম এবং তার সুপুত্র, দু'জনেই গ্রেপ্তার হয়ে জেলে গেলেন এবং শেষ পর্যন্ত বিচারে আসারাম দোষীও প্রমাণিত হলেন৷ তার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা হলো সদ্য৷
ভারতে ধর্ষক ধর্মগুরুর সাজা
00:46
কিন্তু এই ধর্ষণ মামলার তদন্তের সূত্রে আশ্রমের ভেতরে বাবাজির যে কাণ্ডকারখানার নমুনা খুঁজে পাওয়া গেল, তা এককথায় ভয়াবহ৷ বেপরোয়া যৌন ব্যাভিচার আর নিপীড়নেরঅজস্র উদাহরণ৷ এবং আদৌ ধর্মীয় সংগঠন নয়, বরং পুরোদস্তুর ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান হিসেবে আশ্রমের কাজকর্ম চালিয়ে ৪০ বছরে ১০ হাজার কোটি টাকার সম্পত্তির মালিক হয়েছেন এই আসারাম বাপু৷ এর সঙ্গে আছে হাজার হাজার একর জমি, যার কিছু অংশ অবৈধ উপায়ে আত্মসাৎ করা৷ আসারামের কুকীর্তি অবধারিতভাবেই মনে পড়িয়ে দিচ্ছে আরেক স্বঘোষিত ধর্মগুরু গুরমিত সিং রাম রহিমের কথা, যার ডেরা ছিল যৌন অনাচারের আখড়া৷ কিন্তু তারও শেষরক্ষা হয়নি৷ তিনিও এক ধর্ষণের মামলায় দোষী প্রমাণিত হয়ে সম্প্রতি জেলে গেছেন৷
Twameka Roy Chowdhury - MP3-Stereo
This browser does not support the audio element.
এরপর স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে, এই ধর্মগুরুদের কি আর বিশ্বাস করতে পারবেন ভক্তরা? উত্তর খুঁজতে গিয়ে অবাক হতে হলো৷ পেশাদার জীবনে অত্যন্ত সফল বিপণন বিশেষজ্ঞ ত্বমেকা রায়চৌধুরি ব্যক্তিজীবনে খুবই ধর্মবিশ্বাসী এবং তাঁদের একজন পারিবারিক গুরুদেবও রয়েছেন৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে জানালেন, ধর্ম বিশ্বাস যেহেতু নেহাত অন্তরের ব্যাপার এবং তিনি জন্ম থেকেই ঐ গুরুদেবের কাছে যাচ্ছেন, তাঁর বিশ্বাস টলেনি৷ কিন্তু এটাও ঠিক যে কয়েকজন ধর্মগুরুর কুকীর্তির জন্য সবার সম্পর্কেই প্রশ্ন উঠে আসছে৷ যেমন একটি ঘটনার কথা জানালেন ত্বমেকা, যে তাঁদের গুরুদেব একবার ভক্তদের ডাকে প্যারিস যেতে চেয়েছিলেন৷ কিন্তু ভিসার দরখাস্ত করতে গিয়ে জানতে পারেন, কোনো ধর্মগুরুকে ইউরোপে যাওয়ার শেঙেন ভিসা দেওয়া হয় না৷ সমস্ত ধর্মের গুরুদের ক্ষেত্রেই এই নিয়ম প্রযোজ্য৷ কারণ তথাকথিত ধর্মগুরুরা যা বলেন, যা করেন, তার সঙ্গে আধুনিক ইউরোপীয় মনন আদৌ খাপ খায় না৷ ফলে গুরুরা স্বাগত নন ফ্রান্সে৷
কিন্তু প্রশ্ন যদি তৈরি হয়, সন্দেহ যদি দানা বাঁধে মনের মধ্যে, তা হলেও কি গুরুর প্রতি ভক্তি অটল থাকে? পেশায় অর্থনীতিবিদ অশেষ সেনগুপ্ত চমৎকার একটা কথা বললেন যে তিনি এখনও তেমন কোনো পরিস্থিতিতে পড়েননি, এমন কোনো অসুবিধে তাঁর এখনও হয়নি যে, একজন গুরুর দরকার হতে পারে৷ কিন্তু ভবিষ্যতে যদি হয়, তা হলে একজন গুরুর কাছে তিনি নিজেকে সমর্পণ করতেই পারেন৷ ডয়চে ভেলের তরফ থেকে অশেষকে প্রশ্ন ছিল, যাঁরা গুরুবাদে বিশ্বাসী, তাঁদের অনেকেই বেশ অর্থবান, বা ক্ষমতাশালী৷ তাঁদের কিসের অসুবিধা? অশেষের বক্তব্য, তিনি শুধু আর্থিক অসুবিধের কথাই বলতে চাননি৷ আরও অনেক সংকট আছে, যার থেকে পরিত্রাণ পেতে মানুষ গুরুর শরণ নেয়৷
Ashesh Sengupta - MP3-Stereo
This browser does not support the audio element.
সম্ভবত এই কথার মধ্যেই লুকিয়ে আছে মূল সমস্যার জায়গাটা৷ মানুষের যতদিন সেই আত্মিক সংকটের জায়গাটা থাকবে, কোনো আসারাম বাপু, বা গুরমিত সিং রাম রহিমের কেচ্ছা আঁচড় কাটতে পারবে না অখণ্ড গুরুভক্তিতে৷
ভারতের সমালোচিত ধর্মগুরুরা
ভারতে ধর্মগুরুদের কোনো কমতি নেই৷ কয়েকজন তো নিজেরাই নিজেদের ‘ঈশ্বর’ বলে ঘোষণা দিয়েছেন৷ আবার কেউ কেউ আছেন, যাদের কথা আর কাজের মধ্যে কোনো মিল নেই৷ ছবিঘরে থাকছে ভারতের সমালোচিত কিছু ধর্মগুরুর কথা৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/T. Topgyal
গুরমিত রাম রহিম সিং
ডেরা সাচ্চা সওদার প্রধান আধ্যাত্মিক গুরু গুরমিত রাম রহিম সিং নিজেকে ‘সব সম্প্রদায়ের ঈশ্বর’ বলে ঘোষণা করে৷ দুই নারী ভক্তকে ধর্ষণের দায়ে ২০০২ সালে তার বিরুদ্ধে মামলা হয়৷ সেই মামলায় রাম রহিম সিংকে দশ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে দেশটির আদালত৷ ২৫ আগস্ট আদালত রাম রহিমকে দোষী সাব্যস্ত করলে তার ভক্তরা দুই রাজ্যজুড়ে ব্যাপক তাণ্ডব চালায়৷ নিহত হয় ৩৮ জন৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/T. Topgyal
জাকির নায়েক
জাকির নায়েকের বিরুদ্ধে ইসলামি জঙ্গিবাদে মদদ দেয়া অভিযোগ এনেছে ভারতের মহারাষ্ট্র রাজ্য সরকার৷ তাঁর বিষয়ে তদন্ত শুরুর নির্দেশ দেয়া হয়েছে পুলিশকে৷ গত বছরের জুলাইতে ঢাকায় হোলি আর্টিজেন ক্যাফেতে হামলাকারী জঙ্গিরা নায়েকের কথা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল বলে অভিযোগ রয়েছে৷ ঐ বছর থেকেই ভারতের বাইরে অবস্থান করছেন তিনি৷
ছবি: cc-by-maapu 2.0
রাধে মা
ভারতীয় সংস্কৃতিতে মা শব্দটি ভীষণ পবিত্র৷ কিন্তু কিছু ভণ্ড এর সুযোগ নেয়৷ রাধে মা তাদের একজন৷ গুজরাটে এক পরিবারের সাতজন সদস্যকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করেছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে৷ এছাড়া পণ দিতে বাধ্য করা, আত্মহত্যায় প্ররোচিত করার অভিযোগ রয়েছে, যার তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ৷
ছবি: radhemaa.com
রামবৃক্ষ যাদব
২০১৬ সালে উত্তর প্রদেশের মথুরায় পুলিশের গুলিতে মারা যায় রামবৃক্ষ যাদব৷ সেখানকার প্রশাসন অবধ এর ভূমি তাদের দখল মুক্ত করতে গেলে রামবৃক্ষ যাদবের স্বাধীন ভারত সুভাষ সেনার সশস্ত্র গুণ্ডারা পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়লে দু’পক্ষের সংঘর্ষ বাধে৷
ছবি: Getty Images/AFP
স্বয়ম্ভূ সন্ত রামপাল
নিজেকে সন্ন্যাসী হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন তিনি৷ কিন্তু তার বিরুদ্ধে হত্যার ষড়যন্ত্র, পেট্রোল বোমা বানানো, অস্ত্র রাখার অভিযোগ রয়েছে৷ তার আশ্রমে নাকি নারীদের টয়লেটে ক্যামেরাও পাওয়া গিয়েছিল৷
ছবি: Getty Images/Afp/Sajjad Hussain
আসারাম বাপু
নামটা কেউ এখনও ভুলে যায়নি৷ বিপুল ক্ষমতার অধিকারী৷ ২০১৩ সালে ঝুলি থেকে বেড়াল বেরিয়ে পড়ে৷ ‘বাবার’ বিরুদ্ধে যৌন কেলেঙ্কারির অভিযোগে গোটা দেশ তোলপাড় হয়৷ জল গড়ায় আদালতে৷ আসারাম এবং তার সুপুত্র, দু'জনেই গ্রেপ্তার হয়ে জেলে গেলেন এবং শেষ পর্যন্ত বিচারে আসারাম দোষীও প্রমাণিত হলেন৷ তার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা হলো৷
ছবি: Sam Panthaky/AFP/Getty Images
স্বামী নিত্যানন্দ
ইনিও এক স্বঘোষিত ধর্মগুরু৷ ২০১০ সালে স্টিং অপারেশে টিভির পর্দায় ফাঁস হয় তাঁর কীর্তি৷ দক্ষিণের এক অভিনেত্রীর সঙ্গে আপত্তিজনক অবস্থায় দেখা যায় বাবাকে৷ সেই ভিডিও সম্প্রচারিত হতেই হুলস্থূল পড়ে যায়৷ সিআইডি তদন্তের মুখোমুখি হতে হয়েছিল বাবাকে৷ বাবার গ্রেপ্তারিতে ভক্তকূল আকুল হয়ে প্রতিবাদ জানায়৷
ছবি: AFP/GettyImages/M. Kiran
জয়েন্দ্র সরস্বতী
কাঞ্চি কামকোঠী পিঠের জয়েন্দ্র সরস্বতীকে ২০০৪ সালের নভেম্বরে সেখানকার ম্যানেজার শংকর রামণকে হত্যার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়৷ ২০০৫ সালের অক্টোবরে সুপ্রিম কোর্ট এই মামলা তামিলনাড়ু থেকে সরিয়ে পন্ডিচেরি পাঠিয়ে দেয়৷ যদিও পরে সে জামিনে ছাড়া পেয়ে যায়৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/M.Lakshman
নির্মল বাবা
২০১২ সালে উত্তর প্রদেশের নির্মল বাবার বিরুদ্ধে জালিয়াতি ও ধান্দাবাজির অভিযোগ আনা হয়৷ টেলিভিশনে মানুষকে অদ্ভুত সব পরামর্শ দিতে দেখা যেত তাকে৷ যেমন সিঙ্গারার সাথে ঝাল না খেয়ে মিষ্টি চাটনি খেলে দুঃখ দূর হয়৷
ছবি: Screenshot
সন্ত সাঁই বাবা
২০০৫ সালে সন্ত সাঁই বাবার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রে মামলা করা হয়৷ ২৭ বছর বয়সি এক যুবক তার বিরুদ্ধে যৌন নীপিড়নের অভিযোগে মামলাটি করে৷ এই ঘটনার উপর ভিত্তি করে একটি তথ্যচিত্র নির্মিত হয়েছে৷ তবে পরের বছরই রাম তার মামলা উঠিয়ে নেয়৷
ছবি: AP
বিক্রম চৌধুরী
হট যোগ বিখ্যাত হয়েছিল বিক্রম চৌধুরির কল্যাণে৷ একাধিক যৌন কেলেঙ্কারির অভিযোগ উঠেছে তার নামে৷