1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

তরুণ ও নতুন ভোটারই নিয়ন্ত্রণ করবে আগামী নির্বাচন

ডয়চে ভেলের অতিথি লেখক মাসুদ কামাল৷
মাসুদ কামাল
২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫

এই যে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি, সেখানে তরুণ বা নতুন ভোটারদের কথা বিবেচনায় রাখা হয়েছে কতটুকু?

যে-কোনো স্বাভাবিক সাধারণ নির্বাচনে তরুণ এবং নতুন শব্দ দুটি প্রায় সমার্থক হয়ে থাকে। আগের নির্বাচনে যাদের বয়স ১৪ ছিল, এবার তারা ১৯ বছরের তরুণ। এরাই নতুন ভোটার।ছবি: Mohammad Ponir Hossain/REUTERS

শফিক রেহমানের কাছে বাংলাদেশের মিডিয়া অনেকভাবে কৃতজ্ঞ থাকবে। তিনি নতুন অনেক কিছু চালু করেছেন, মিডিয়া কীভাবে রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করতে পারে, সেটাও সম্ভবত তিনিই প্রথম দেখিয়েছিলেন। একটা ঘটনা বলি।

২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনের সময় সাপ্তাহিক যায়যায়দিনে একটা প্রচ্ছদ প্রতিবেদন হয়েছিল তরুণ ভোটারদের নিয়ে। শফিক রেহমানের এই সাময়িকীটি তখন সরাসরিই বিএনপির পক্ষ নিয়েছিল। যায়যায়দিন সে সময় তরুণদের কাছে দারুণ জনপ্রিয়, অনেকটা নেশার মতো। আমার স্পষ্ট মনে আছে, একেবারে নির্বাচনের দিনেই ম্যাগাজিনটি বাজারে এসেছিল, আর সেই সংখ্যার প্রচ্ছদ প্রতিবেদনে ‘এক কোটি নতুন ভোটার'-এর কাছে সরাসরিই আহ্বান জানানো হয়েছিল বিএনপিকে ভোট দেওয়ার জন্য। নির্বাচনের দিন সকালে ম্যাগাজিনটি হাতে নিয়ে আমার মনে দুটি প্রশ্ন জেগেছিল। প্রথমত, একটা মিডিয়া এভাবে প্রকাশ্যে কোনো একটি রাজনৈতিক দলের পক্ষ নিতে পারে কি-না। দ্বিতীয়ত, আহ্বানটি কেবল নতুন এক কোটি ভোটারের কাছেই কেন? অন্য সকল ভোটারের কাছে বিশেষ অনুরোধের কথা কেন গুরুত্ব দিয়ে বলা হলো না?

প্রথম প্রশ্নটির জবাব জনাব শফিক রেহমান সেই সংখ্যার সম্পাদকীয়তেই দিয়েছিলেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন মিডিয়া হাউজের উদাহরণ দিয়েছিলেন, বলেছিলেন- পত্রিকা বা টেলিভিশন সরাসরি কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষ নিতে পারে, নিয়ে থাকে। এবার আসি দ্বিতীয় প্রসঙ্গে, তরুণ বা নতুন ভোটারদের গুরুত্বের বিষয়ে। পুরাতন ভোটারদের পরিবর্তে নতুন ভোটাররা যে আসলেই একটা জাতীয় নির্বাচনে নিয়ামকের ভূমিকায় থাকতে পারে, বিষয়টা সেবারই প্রথম আমি উপলব্ধি করতে পারি ওই প্রচ্ছদ প্রতিবেদনটি পড়ে। সেদিন আমার প্রাথমিক প্রতিক্রিয়াটি অবশ্য একটু নেতিবাচকই ছিল। আমি ভাবছিলাম— এমনিতেই সরকারি দল হিসেবে জনসমর্থনের দিক দিয়ে আওয়ামী লীগ একটু পিছিয়ে, এর মধ্যে যদি এরকম প্রভাবশালী একটা মিডিয়া প্রকাশ্যে বিএনপির পক্ষ নেয়, তাহলে প্রতিদ্বন্দ্বিতাটা কি কিছুটা একপেশে হয়ে যায় না? সাংবাদিক হিসেবে আমি তো ভোটের একটা হাড্ডাহাড্ডি লড়াই দেখতে চেয়েছিলাম। পরে অবশ্য আমার কাছে যায়যায়দিনের সেই ভূমিকাটিকে যথার্থই মনে হয়েছে। কোনো একটা রাজনৈতিক পলিসির পিছনে বুদ্ধিবৃত্তিক সহযোগিতাকারী হিসেবে মিডিয়া ভূমিকা রাখতেই পারে। যায়যায়দিনের সেদিনের সেই অবস্থান নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল বলে আমার ধারণা। বিপুল ব্যবধানে সেই নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিল বিএনপি। এতদিন পরে এসে আমার এখনও মনে হয়, তরুণ বা নতুন ভোটারদের ওই কনসেপ্টটা আসলেই ‘ইউনিক' ছিল।

আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে কি-না, তা নিয়ে অনেকের মধ্যেই সংশয় আছে। কেন এমন সংশয়, তা নিয়ে লম্বা আলোচনা করা যায়। কিন্তু তারপরও এটা সবাই মানবেন, ফেব্রুয়ারি না হয় এপ্রিল, কিংবা জুন— নির্বাচন হবেই। নির্বাচনকে সামনে রেখেই বর্তমানে আবর্তিত হচ্ছে বাংলাদেশের রাজনীতি। এই রাজনীতি নির্বাচনকে এগিয়ে বা পিছিয়ে নিতে যেমন হচ্ছে, তেমনি হচ্ছে নির্বাচনে নিজ দলের জন্য একটা ভালো ফল পাওয়ার জন্যও। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর একটি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামি এই মুহূর্তে নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে আন্দোলন করছে। তারা পিআর বা সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির নির্বাচন চায়। একদিকে তারা পিআর পদ্ধতির দাবি তুলছে, অন্যদিকে আরো মাস কয়েক আগেই তারা ঘোষণা করেছে তিনশ' আসনে তাদের প্রার্থীদের নামের তালিকা। যতদূর জানা গেছে, বিএনপিও তাদের সম্ভাব্য প্রার্থীদের তালিকা ঠিক করার চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। এসবই নির্বাচনের জন্য ইতিবাচক নমুনা। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই যে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি, সেখানে তরুণ বা নতুন ভোটারদের কথা বিবেচনায় রাখা হয়েছে কতটুকু? কোনো সন্দেহ নেই, আগামী নির্বাচনে এই বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করবে।

২০০১ সালে, কিংবা যে-কোনো স্বাভাবিক সাধারণ নির্বাচনে তরুণ এবং নতুন শব্দ দুটি প্রায় সমার্থক হয়ে থাকে। আগের নির্বাচনে যাদের বয়স ১৪ ছিল, এবার তারা ১৯ বছরের তরুণ। এরাই নতুন ভোটার। ১৫, ১৬ বা ১৭ বছর বয়স থাকার কারণে যারা আগের নির্বাচনে অংশ নিতে পারেনি, এবার তারা প্রথমবারের মতো ভোট দিতে যাচ্ছে। হিসেবটা এরকমই থাকার কথা। কিন্তু আমাদের আসন্ন নির্বাচনে বিষয়টা অন্য রকম হয়ে যাবে। ২০২৪ এর জানুয়ারিতে যে নির্বাচনটা হলো, যেটাকে আমরা ‘আমি ও ডামি'র নির্বাচন বলি, তার ঠিক আগে আগে এক ভদ্রলোকের একটা কথা আমাকে খুব স্পর্শ করেছিল। তিনি একটা বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা। তিনি জানালেন, তার বয়স ৩১ বছর, কিন্তু তিনি কোনোদিন জাতীয় নির্বাচনে ভোট দিতে পারেননি। ২০০৮ এর নির্বাচনে ভোট দিতে পারেননি, কারণ, তখন তার বয়স ছিল ১৬ বছর। এরপর ২০১৪ আর ২০১৮তে ভোট দেওয়ার সুযোগ পাননি। আর সবশেষ ২০২৪ যে প্রক্রিয়ায় ভোটের আয়োজন করা হয়েছে, ভোট দেওয়ার আগ্রহই তিনি হারিয়ে ফেলেছেন! তাই এবার আসন্ন এই নির্বাচনে, ৩৩ বছর বয়স্ক সেই ভদ্রলোক কিন্তু তরুণ না হলেও নতুন ভোটারই হবেন। ফলে এবার নতুন ভোটারের সংখ্যা দাঁড়াবে আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি, প্রায় তিনগুণ। আমার বিবেচনায় এই নতুন ভোটাররাই আসন্ন নির্বাচনের ফলাফলকে নিয়ন্ত্রণ করবে।

হাসিনা সরকারের পতনের পর ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলে গুরুত্বপূর্ণ দুটি নির্বাচন আমরা দেখেছি। দুটিই অবশ্য ছাত্রসংসদ নির্বাচন, ডাকসু ও জাকসু। সে বিবেচনায় এই দুটি ছিল তরুণদের নির্বাচন। দুটি নির্বাচনেই ইসলামি ছাত্র শিবিরের প্রবল প্রাধান্য দেখা গেছে। সামনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের নির্বাচন হবে। সেগুলোতেও মোটামুটি একই ধরনের ফল হবে বলে অনেকে ধারণা করছে। এখান থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে গেছে। সেটা হচ্ছে— তরুণদের মধ্যে ছাত্র শিবিরের রাজনীতির প্রতি আগ্রহ। কেবল তরুণরাই নন, তরুণীরাও বিপুলভাবে ছাত্র শিবিরের রাজনীতির দিকেই ঝুঁকেছে! এই প্রবণতাটা শুরুতে আমার কাছে খুব স্বাভাবিক বলে মনে হয়নি। আমরা যখন ছাত্র ছিলাম, তখনও ইসলামি ছাত্র শিবির ছিল। তারা কখনোই নির্বাচনে খুব একটা সুবিধা করতে পারতো না। তাদের ধর্মভিত্তিক রাজনীতির প্রতি তরুণদের, বিশেষ করে তরুণীদের আগ্রহ ছিল খুবই কম। এবারের ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচনের ফল আগের সেই মানসিকতার প্রতিফলন ঘটাচ্ছে না। তাহলে কি বর্তমানের এই ছেলে-মেয়েদের চিন্তাভাবনা পালটে গেছে? নাকি ইসলামি ছাত্র শিবিরই পরিবর্তন এনেছে তাদের রাজনীতিতে?

আমার মনে হয়, দ্বিতীয়টিই ঘটেছে। শিবিরের রাজনীতিতেই অনেকটা পরিবর্তন এসেছে। কয়েকটা ঘটনা— ঢাকসুতে তাদের প্যানেলে অমুসলিম ছাত্রকে প্রার্থী করা, নিজ সংগঠনের বাইরের লোককে প্রার্থী করা, বিজয়ের পর রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধ সময়কালে নিহত বুদ্ধিজীবী কবরে পাশে দাঁড়িয়ে জিয়ারত করা, এসব কিন্তু সেই রাজনীতির সেই পরিবর্তনটাই ইঙ্গিত করে। কাজটি যে জামায়াতের অনুমোদনক্রমেই হয়েছে, সেটাও এরই মধ্যে পরিষ্কার হয়ে গেছে। কেবল শিবিরের বিষয়ে অনুমোদনই নয়, জামায়াতের অভ্যন্তরেও পরিবর্তনের আভাস কিন্তু মিলছে। নির্বাচনে বিজয়ী হলে জামায়াত এখন আর দেশে শরিয়া আইন কায়েম করতে চায় না। তারা বরং সব ধর্মের লোকের সমন্বয়ে একটা অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গড়ে তুলতে চায়।

এই যে জামায়াতের মতো কট্টর ইসলামপন্থি দলের এরকম মৌলিক পরিবর্তন, এর পিছনে প্রধানতম কারণ কিন্তু ওই নতুন ভোটার। তরুণ ও নতুন ভোটারদের তারা গুরুত্ব দিতে চাইছে। তারা বুঝতে পেরেছে, এরাই আসলে নিয়ন্ত্রণ করবে আগামী নির্বাচন। তরুণ এবং তরুণী— সকলেই রয়েছে তাদের বিবেচনায়। কট্টর ধর্মভিত্তিক রাজনীতির পরিবর্তে তারা এখন ওয়েলফেয়ার পলিটিক্স করছে। তাদের এ কাজে সবচেয়ে বেশি সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে পূর্ববর্তী সরকারের অপরাজনীতি। শিক্ষাঙ্গণের হলগুলোতে ছাত্রলীগের নিবর্তনমূলক কর্মকাণ্ডের বিপরীতে ছাত্রশিবিরের কল্যাণমূলক কাজগুলোকে সাধারণ শিক্ষার্থীরা যে পছন্দ করেছে তার প্রমাণ এরই মধ্যে ডাকসু ও জাকসুতে পাওয়া গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েরাও শিবিরকে তাদের জন্য অধিকতর নিরাপদ হিসেবে বিবেচনা করেছে।

তরুণদের এমন মনোভাব কি দেশের রাজনৈতিক দলগুলো উপলব্ধি করতে পেরেছে? আমার মনে হয় ছাত্রসংসদ নির্বাচনগুলো দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর চোখ খুলে দেওয়ার কাজটি করেছে। তাদের সামনে নতুন এক বাস্তবতাকে উপস্থাপন করেছে। প্রশ্ন হচ্ছে— রাজনৈতিক দলগুলো সেসব নতুন দৃশ্যাবলীকে কতটুকু দেখতে চাইবে? সেই বাস্তবতাকে কতটুকু মেনে নেবে? নির্বাচন যদি ফেব্রুয়ারিতেই হয়, তাহলে তার এখনো প্রায় ৫ মাস বাকি। চাইলে এরই মধ্যে অনেক কিছুই সংশোধন করা সম্ভব। রাজনৈতিক দলগুলো কি সেটা করতে চাইবে? চাইলে কীভাবে করবে? অনেক হয়তো বিষয়টাকে অতি সরলীকৃতভাবে দেখতে পারে। তারা হয়তো ভাববে—ঠিক আছে, প্রার্থী তালিকায় একটা বড়সংখ্যক তরুণকে বরং যুক্ত করা যাক, তাহলেই তরুণ ও নতুন ভোটাররা হুমড়ি খেয়ে আমাদেরকে ভোট দেবে! এটা যে তেমন একটা কার্যকর পদ্ধতি হবে না, তার নির্মম উদাহরণ হচ্ছে জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপি'র ক্রমহ্রাসমান জনপ্রিয়তা। এ দলের সবাই তরুণ, অথচ তারপরও তরুণদের মধ্যেই এদের গ্রহণযোগ্যতা প্রত্যাশাকে স্পর্শ করতে পারেনি। বিষয়টা আসলে নেতার বয়স নয়, বরং নীতির চরিত্রের মধ্যে নিহিত। দলগুলো যদি তাদের নীতি, কর্মসূচি প্রণয়নে তরুণ ও নতুন ভোটারদের প্রত্যাশাকে বিবেচনায় রাখে, কেবল তাহলেই সম্ভবত কিছু প্রাপ্তিযোগ হতে পারে।

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ