করোনায় বইমেলার লাভ-লোকসান, বেস্ট সেলার বই, সৃজনশীল লেখার পাঠক ইত্যাদি বিষয়ে কথা বলেছেন বাংলা অ্যাকাডেমির মহাপরিচালক কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী।
বিজ্ঞাপন
ডয়চে ভেলে: এবার এই করোনার মধ্যেও বই মেলা করে কী লাভ হলো?
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: আমরা শুরু থেকেই ভার্চুয়াল করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু প্রকাশকরা বললেন মাঠে মেলা হলে তাদের কিছু আয় হবে। করোনা কমে আসায় আমরা মার্চ-এপ্রিল মিলিয়ে করি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত করোনা বেড়ে যাওয়ায় ঠিকমতো করা যায়নি। মেলার সাথে আমরা বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী যোগ করেছিলাম।
তবে লোকসানের দিক হলো এই মেলা চালাতে গিয়ে আমার অধিকাংশ কর্মকর্তা-কর্মচারী এখন করোনায় আক্রান্ত। আমাদের সাভাপতিও ( শামসুজ্জামান খান) বই মেলার কারণে নিয়মিত অফিস করতেন। তিনিও করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন। আমাদের আরেক সহকর্মী আবু জাফরও করোনায় মারা গেছেন।
আমরা আর্থিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। প্রকাশকরাও লাভবান হতে পারেননি। আমরা স্টলের ভাড়ায় শতকরা ৫০ ভাগ ভর্তুকি দিয়েছি।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী
তারপরও আমরা এই করোনার মধ্যে বই মেলা করতে পেরেছি- এটাই সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।
এবার নতুন বই কেমন এসেছে?
নতুন বই তেমন আসেনি। গত বছর চার হাজারের বেশি বই এসেছিল। এবার তার অর্ধেক। তবে এই বইগুলো সারাবছর অনলাইনে বিক্রি হবে। এটা একটা ভালো দিক। আর অনলাইনে বিক্রি বাড়ছে। গত বছর বিক্রির শীর্ষে ছিল একটা অনলাইন প্রতিষ্ঠান।
সৃজনশীল বই কম প্রকাশ হয় কেন?
সেটা নির্ভর করে প্রকাশকদের ওপর। তাদের রুচির ওপর। কিছু প্রকাশক আছে, তারা সৃজনশীল বইয়ের বাইরেও শিক্ষামূলক বই, বিনোদনমূল বই প্রকাশ করেন চাহিদার জন্য। তবে সৃজনশীল বইয়েরও চাহিদা আছে। ভালো ব্যবসাও হয়।
ভালো লেখক নেই, ভালো পাঠক নেই- এমন বক্তব্যের জবাবে আপনি কী বলবেন?
আমি এটা মনে করি না। ভালোরও একটা মানদণ্ড আছে। আমাদের মননশীলতার দিক, চর্চার দিকে কিন্তু কমতি নেই। গত এক বছর করোনার কারণে সবকিছুই কিন্তু অন্ধকার। সেখানে শুধু প্রকাশনা শিল্প সচল খাকবে সেটা বলা যায় না।
প্রসঙ্গ : পাঠকের রুচি ও অগ্রাধিকার
করোনাকালের বইমেলার ‘বেস্টসেলার’ দিয়ে কি পাঠকের সার্বিক রুচি এবং বই কেনায় পরিবর্তনের ধারা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়? তরুণ পাঠক এখন কী বেশি পড়ছেন? কেন পড়ছেন? এসব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন বিভিন্ন পেশার মানুষ৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
ইংরেজিতে দক্ষতা এখন অনেক জরুরি
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম এএফপি’র সাংবাদিক স্যাম জাহানের মতে, ‘‘বিগত এক দশকের আর্থ-সামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় তরুণদের কাছে শিল্প-সাহিত্য চর্চার চেয়ে ইংরেজি শেখাটা এখন বেশি লাভজনক বিনিয়োগ৷ বিপুল সংখ্যক মানুষ, বিশেষ করে তরুণ সমাজের একটা বড় অংশ উন্নত জীবনযাপনের উদ্দেশ্যে এখন দেশত্যাগে আগ্রহী৷ বিদেশে স্থায়ী হওয়ার জন্য ইংরেজি ভাষায় দক্ষ হওয়া জরুরি, তাই সেদিকেই তাদের মনোযোগ বেশি৷’’
ছবি: Privat
অনিশ্চয়তার মধ্যে সাহিত্য-চর্চা সম্ভব না
ইকমার্স নির্বাহী সামিউর রহমান বলেন, ‘‘তরুণদের বই পড়ায় আগ্রহ কমছে, আমি তা মনে করি না৷ গত কয়েক বছরে তরুণদের মধ্যে আত্মোন্নয়ন এবং ইংরেজি শেখার চাহিদা কয়েকগুণ বেড়েছে৷ অনেক দেশের তুলনায় আমাদের ইংরেজি শিক্ষার মান অত্যন্ত দুর্বল৷ আমাদের তরুণদের ভবিষ্যৎও অনিশ্চিত৷ সুতরাং এই অবস্থায় সাহিত্য-চর্চা শুধু নাটক-সিনেমাতে সম্ভব, বাস্তবে নয়৷’’
ছবি: Privat
বিষয়টি দ্বান্দ্বিক এবং অশনিসংকেত
লেখক ও আলোকচিত্রী শাহরিয়ার খান শিহাব বলেন, তরুণ সমাজ যে-কোনো বই পড়ছে বিষয়টি আনন্দের৷ তবে বইমেলায় কেন সৃষ্টিশীল রচনা সর্বোচ্চ বিক্রির আসনে নেই, সেখানে কেন একটি ভাষা শিক্ষার বই, এটি একটি দ্বন্দ্বপূর্ণ আলাপ৷ অন্তরালের কারণ হিসেবে বলা যায়, এখনকার লেখকদের মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগিতার কারণে লেখনীর মান যেমন তলানিতে যাচ্ছে, তেমনি পাঠ্যপুস্তকের বাইরের মৌলিক বইয়ের প্রতিও তরুণদের অনীহা বাড়ছে, এটা আশঙ্কাজনক৷
ছবি: Privat
সৃষ্টিশীল বই পড়ার সুযোগ কম
ঢাকা ডেন্টাল কলেজের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী মাশুক শাহরিয়ার বলেন, ‘‘আমার আশেপাশের সবাই এখন পড়াশোনা, চাকরি এবং ক্যারিয়ার নিয়ে উদ্বিগ্ন৷ তীব্র প্রতিযোগিতার এই যুগে পাঠ্যপুস্তক পড়ার পর যেটুকু সময় হাতে থাকে, তা আমরা অনলাইনে দেই৷ আমি নিজেই আগের মতো গল্প বা উপন্যাসের বইয়ের প্রতি সেভাবে আগ্রহ অনুভব করি না৷ বিগত কয়েক বছরের দিকে তাকালে দেখা যায়, এখন মানুষ বই কিনছে মনের খোরাক মেটাতে নয়, প্রয়োজনের তাগিদে৷’’
ছবি: Privat
বই পড়া বাদেও এখন অপশন অনেক
ব্যাংক কর্মরত ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘‘আমাদের সময়ে আমরা তিন গোয়েন্দা, কমিকস এসব বই পড়তাম, কারণ, আমাদের অপশন ছিল না৷ এখন ছেলেমেয়েদের ঘরে বসে সময় কাটানোর মাধ্যমের অভাব নেই৷ সৃষ্টিশীল বই-বিমুখতার পিছনে অভিভাবকরাও দায়ী, তারা সন্তানদের পাঠ্যপুস্তকের বাইরের বই পড়তে দিতে আগ্রহী না৷ যেহেতু এখন সব ক্ষেত্রেই প্রতিযোগিতা বেশি, ইংরেজিতে দক্ষতা অনেক গুরুত্বপূর্ণ, সুতরাং এ ধরনের বইয়ের প্রতি ঝোঁকটা স্বাভাবিক৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
মৌলিক চাহিদা সবার আগে
চাকরিপ্রত্যাশী স্থপতি এনায়েত হোসেন বলেন, ‘‘একজন মানুষ শিল্প-সাহিত্যের দিকে তখনই মনোনিবেশ করবে যখন তার মৌলিক চাহিদা পূরণ হবে,পেটভরা থাকবে৷ তরুণ সমাজ এখন হতাশায় ভুগছে, বিভিন্ন দিকে তারা ব্যর্থ৷ এ থেকে পরিত্রাণ পেতে তারা অনুপ্রেরণামূলক বই অথবা ইংরেজির মতো আন্তর্জাতিক ভাষা শেখার প্রতি আগ্রহী হচ্ছে৷ তরুণদের বেকারত্ব, অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মধ্যে এইসব সাহিত্য চর্চা এখন বিলাসিতারই নামান্তর বলে আমি মনে করি৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
মানুষ বই কিনছে নিতান্তই প্রয়োজনে
প্রতীক প্রকাশনা সংস্থার কর্ণধার নূর ই প্রতীক বলেন, ‘‘মানুষ এখন নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া বই কেনে না৷ বিষয়গুলো মানুষের আর্থিক সচ্ছলতার সাথে কিছুটা জড়িত৷ তবে ইংরেজি ভাষা বা অনুপ্রেরণামূলক বই বেস্ট সেলার হচ্ছে মানে যে অন্যান্য বই বিক্রি একদম কম হয়, বিষয়টা তা-ও না৷ মানুষ বই পড়ছে, তবে সেসব বই বিক্রির তথ্য অতটা আলোকপাত হয় না৷ কে জানে, পরের বছরে হয়ত কোনো সৃষ্টিশীল বই সর্বোচ্চ বিক্রির জায়গা দখল করতেও পারে৷’’
ছবি: Privat
সংখ্যা সবকিছু যাচাইয়ের মাপকাঠি নয়
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক সৈয়দ আজিজুল হক বলেন, ‘‘দেখা যায় একটি ‘গম্ভীর’ বইয়ের তুলনায় একটি সাধারণ বই অনেক বেশি বিক্রি হচ্ছে৷ সব বইয়ের পাঠক যে সবাই না, এটাও বুঝতে হবে৷ যা প্রয়োজনে কেনা হয়, সেটা দিয়ে পাঠকের দৃষ্টিভঙ্গি মাপা কঠিন৷ তরুণরা বই পড়ছে এবং কিনছে৷ গতবছর প্রায় ৮২ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়, যার অধিকাংশ ক্রেতা এই তরুণেরা৷ যুগ ডিজিটাল হচ্ছে, কিন্তু বই পড়া থেমে নেই৷’’
ছবি: privat
তরুণ প্রজন্ম এখন বাস্তববাদী এবং সচেতন
একটি আন্তর্জাতিক এনজিওর পরামর্শক মোস্তফা ফেরদৌস ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, ‘‘আমার আশেপাশের তরুণরা এখন চাকরি, ব্যবসা, সর্বোপরি ভবিষ্যৎ নিয়ে সচেতন৷ মহামারির কারণে সবাই চাচ্ছে ঘরে বসেই নিজেদের দক্ষতাকে শাণিত করতে৷ তবে আমি দেখেছি যারা প্রকৃত পাঠক, তারা বই কিনছেই৷ কিন্তু বই পড়ার আগ্রহ একদম কম দেখতে পাচ্ছি অপেক্ষাকৃত নতুন প্রজন্মের মাঝে, যারা ডিজিটাল দুনিয়ায় নিজেদের হারিয়েই ফেলছে বলা চলে৷’’
ছবি: privat
9 ছবি1 | 9
তরুণ লেখক প্রকল্প কি আবার সচল হবে?
তরুণ লেখক প্রকল্প সচল করার ব্যাপারে আমাদের আপাতত কোনো পরিকল্পনা নেই। কিন্তু তরুণদের মেধা ও মননকে কাজে লাগানোর জন্য আমরা বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছি। আমরা অনুবাদ, ফোকলোর এসব বিষয়ে তরুণদের কাজে লাগাচ্ছি। আর ভাষা সাহিত্য নিয়ে গবেষণার জন্য তরুণদের বৃত্তি দিচ্ছি। বিজ্ঞান বিষয়ক কাজ দেয়া হচ্ছে তাদের। আমি মনে করি, প্রশিক্ষণ দিয়ে সাহিত্যিক তৈরি সম্ভব নয়। এটা ঠিকও নয়। তবে তাদের বাংলা একাডেমির সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। আমরা সেই চেষ্টা করছি।
সৃজনশীল লেখক-পাঠক কি কমে গেছে?
কিছু পাঠক আছেন বিনোদনের জন্য পাঠ করেন। কিছু পাঠক আছেন অ্যাকাডেমিক কারণে পাঠ করেন। আর কিছু পাঠক আছেন সত্যিকারের জ্ঞান অর্জনের জন্য পাঠ করেন। ওই জ্ঞান অর্জনের অংশটুকু ক্রমান্বয়ে কমে গেছে, কারণ, কর্পোরেট বিশ্বে মানুষ অর্থের পিছনে ছুটছে।
এটা কি লেখকদের জন্যও সত্য?
হ্যাঁ। এটা লেখক- প্রকাশক সবার জন্যই সত্য। বিজ্ঞান চেতনা ও দর্শনের শিক্ষার অভাব আছে আমাদের। তার ফলে এরকম হচেছ। দর্শন আর বিজ্ঞান চেতনার দিকে আমাদের যেতে হবে। বিজ্ঞান ও সাহিত্য একসাথে চলে। তবে এটা একটা নতুন দেশ। ৫০ বছর হয়েছে। আমরা যদি চেষ্টা করি তাহলে সৃজনশীল লেখক, পাঠক তৈরি হবে। তরুণরা এগিয়ে আসবেন। অবস্থার পরিবর্তন হবে।