তরুণ প্রজন্মের মধ্যে আশা ও আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তোলা সহজ কাজ নয়৷ বিশেষ করে শরণার্থী হিসেবে ভিন দেশে আশ্রয়ের কঠিন অভিজ্ঞতার মাঝে তো নয়ই৷ জার্মানিতে এক অভিনব উদ্যোগের মাধ্যমে সেই চেষ্টাই চলছে৷
বিজ্ঞাপন
শরণার্থীদের জন্য আশার আলো
03:13
প্রথম শো-র আগে শেষ মহড়া চলছে৷ এই মিউজিক্যালের মাধ্যমে তরুণ-তরুণীরা শুধু গায়ক ও অভিনেতা হয়ে উঠছে না, অচেনা মানুষও বন্ধু হয়ে উঠছে৷ যেমন সিরিয়ার শরণার্থী মাহের৷ সে বলে, ‘‘আমার অনেক নতুন বন্ধু হয়েছে৷ খুব ভালো হয়েছে৷ কাউকেই চিনতাম না৷ সপ্তাহে একবার রিহার্সাল হয়৷ এখানে এলে সবকিছু ভুলে যাই৷ শুধু বন্ধুদের সঙ্গে থাকি৷''
মাহের ও সিনা-র বয়স যথাক্রমে ১৮ ও ১৭৷ দু'বছর আগে মাহের একাই সিরিয়া থেকে জার্মানি আসে৷ এখন সে ক্লাস টেনে পড়ে৷ সিনা জার্মান নাগরিক, আট বছর ধরে বার্লিনে থাকে৷ উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রস্তুতির মাঝে এই মিউজিক্যাল তাকে আনন্দ দেয়৷
ইউরোপের দশটি চোখ ধাঁধানো কনসার্ট হল
ইউরোপ কেন, দুনিয়া জুড়ে বড় বড় শহরের কনসার্ট হল শুধু গানবাজনা শোনার জায়গাই নয়, আধুনিক স্থাপত্যের নিদর্শনও বটে৷ তারা নিজেরাই পর্যটকদের টানে৷
ছবি: picture alliance/Arcaid/S. Ellingsen
কিলডেন পার্ফর্মিং আর্টস সেন্টার, নরওয়ে
কিলডেন পার্ফর্মিং আর্টস সেন্টার, নরওয়ে
কনসার্ট হলটি জলের ধারে৷ সামনেটা ১০০ মিটার লম্বা একটা কাচের দেয়াল, তার ওপর ঝুলছে ওক কাঠের সোনালি রঙের এক পর্দা, যেন থিয়েটারের যবনিকা৷ তৈরির কাজ শেষ হয় ২০১২ সালে৷ মোট এলাকা ১৬৫,০০০ বর্গমিটার৷ এখানে নাটক, অপেরা বা সিম্ফনি অর্কেস্ট্রা সব কিছুই অনুষ্ঠিত হয়৷
ছবি: picture alliance/Arcaid/S. Ellingsen
ফিলহার্মনি দ্য পারি, ফ্রান্স
এমন একটি কনসার্ট হলের আইডিয়া প্রথম এসেছিল নামকরা অর্কেস্ট্রা পরিচালক পিয়ের বুলে ও পুরস্কার বিজয়ী স্থপতি জঁ নুভেলের মাথায়৷ উদ্বোধন করা হয় ২০১৫ সালে৷ অ্যালুমিনিয়ামের সম্মুখভাগটি তিন লাখ চল্লিশ হাজার পাখি দিয়ে সাজানো, তাদের সাত ধরনের আকৃতি ও ধূসর থেকে কালো, এই চার ধরনের রঙ৷ দূর থেকে দেখলে মাছের আঁশের মতো ঝকঝক করে৷ ৩৭ মিটার উঁচু বাড়িটির ছাদে ওঠা যায় ও সেখান থেকে প্যারিসের দৃশ্য উপভোগ করা যায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/T. Muncke
সেজ গেটসহেড, ইংল্যান্ড
গেটসহেড আর নিউক্যাসলের মধ্যে টাইন নদীর ওপর সাতটা সেতু৷ তার মধ্যে মিলেনিয়াম ব্রিজটি সেজ গেটসহেড কনসার্ট হলের ওপর দিয়ে চলে গেছে৷ গোটা বাড়িটাতেই আলো জ্বলে৷ ডিজাইন প্রখ্যাত স্থপতি স্যার নর্মান ফস্টারের৷ উদ্বোধন করা হয় ২০০৪ সালে৷ কনসার্ট হলটি প্রতিদিন ১৬ ঘণ্টা করে বছরে ৩৬৪ দিন খোলা থাকে৷
ছবি: picture-alliance/robertharding/M. Sunderland
কাসা দা মুজিকা পোর্তো, পর্তুগাল
তেরশ’ দর্শকের বসার মতো এই কনসার্ট হলটিকে দেখতে যেন একটি সুবিশাল বাক্স৷ বাইরেটা সাদা কংক্রিট আর কাচের৷ ভেতরটায় নানা রঙ ও আকৃতির বিভিন্ন ফিচার, সেই সঙ্গে পর্তুগালের ‘আজুলেজস’ পাথরের টালি৷ কাচের ছাদটা খুলে দেওয়া যায়; তখন এখানে থেকে পোর্তো শহরের সব বাড়ির মাথা ছাড়িয়ে অতলান্তিক সমুদ্র অবধি দেখতে পাওয়া যায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/D. Karmann
পালাউ দে লেজার্ত রেইনা সোফিয়া, স্পেন
ভ্যালেন্সিয়া শহরে কুইন সোফিয়া প্যালেস অফ দ্য আর্টসের উদ্বোধন করা হয় ২০০৫ সালে৷ বিশ্বখ্যাত স্থপতি সান্তিয়াগো কালাত্রাভা যে সুবিশাল সিটি অফ আর্টস অ্যান্ড সায়েন্সেসের পরিকল্পনা করেছিলেন, এই কনসার্ট হলটি ছিল তার চূড়ান্ত অংশ৷ ৭৫ মিটার উঁচু ভবনটি বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু অপেরা হাউস বলে পরিচিত৷
ছবি: picture-alliance/Arco Images GmbH/J. Moreno
নর্স্কে অপেরা ও ব্যালে, নরওয়ে
অসলোর নরওয়েজিয়ান অপেরা ও ব্যালেট ভবনটির ছাদ ৩৬,০০০ কারারা শ্বেতপাথরের ব্লক দিয়ে তৈরি৷ এই ছাদের ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া যায়৷ হলটির চারপাশে পাতলা কাচের দেয়াল৷ হলের ভেতরটা তেলে ‘সিজনড’ ওক কাঠ দিয়ে তৈরি, যার ফলে খুব ভালো শুনতে পাওয়া যায়৷ ইন্টারভ্যালের সময় ব্যালকনি থেকে বাইরে নরওয়ের ফিয়র্ডগুলির দৃশ্য দেখতে পারা যায়৷
কনসার্ট হলটির ধাঁচ কিছুটা আলাদা বলে গোড়ায় বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল৷ অর্কেস্ট্রার বাজনদাররা হলের মাঝখানে একটা পোডিয়ামের ওপর বসেন৷ স্থপতি হান্স শারুনের এই বিপ্লবী ডিজাইন পরে সারা বিশ্বে আধুনিক কনসার্ট হল তৈরির মডেল হয়ে ওঠে৷
ছবি: picture alliance/Arco Images/Schoening Berlin
আল্টো থিয়েটার, এসেন, জার্মানি
জার্মানির এসেন শহরের এই কনসার্ট হলটির বিশেষত্ব হলো, স্টেজের সামনে বসা দর্শকদের আসনগুলি অর্ধগোলাকৃতি করে অপ্রতিসমভাবে সাজানো৷ ফিনল্যান্ডের স্থপতি আলভার আল্টো জানিয়েছেন, তিনি ডেলফির প্রাচীন গ্রিক থিয়েটারগুলো থেকে এ ধরনের অডিটোরিয়াম সৃষ্টির প্রেরণা পেয়েছেন৷ আলভার থিয়েটারের নকশাটি করেন পঞ্চাশের দশকে, কিন্তু কাজ শুরু হয় ১৯৮৩ সালে৷ আজ এই ভবনটিকে আধুনিক ক্লাসিক্যাল ডিজাইনের একটি নিদর্শন বলে গণ্য করা হয়৷
ছবি: Bernadette Grimmenstein
হার্পা মিউজিক হল, রাইকজাভিক, আইসল্যান্ড
আংশিক রঙ করা কাচের বিল্ডিং ব্লকগুলোকে মৌমাছির চাকের মতো বসিয়ে আলোর জাদু সৃষ্টি করেছেন শিল্পী ওলাফুর এলিয়াসন৷ দিনের বেলায় বাইরে থেকে কাচের ওপর আলো পড়ে বর্ণালীর সৃষ্টি হয়; রাত্রে ভবনটির ভিতরের আলো জ্বললে গোটা বাড়িটা রঙ বদলায় যেন বহুরূপীর মতো৷
হামবুর্গের এই কনসার্ট হলটি তৈরি হতে যে পরিমাণ বিলম্ব হয়েছে আর বাজেট যে পরিমাণে বেড়েছে, তাতে কেউ প্রত্যাশাই করেননি যে, তার চূড়ান্ত আকার এত সুন্দর ও মনোমুগ্ধকর হবে৷ ফিলহার্মনিকের ছাদটা ঢেউ খেলানো, যেন একসঙ্গে সাগর আর সংগীতের ওঠা-নামা৷ হামবুর্গের বন্দর এলাকার একটি মালগুদামের উপর কাচের এই বাড়িটি যেন জলের ওপর ভাসছে৷ প্রথম কনসার্টের তারিখ হলো ১১ই জানুয়ারি, ২০১৭৷
ছবি: T. Rätzke
10 ছবি1 | 10
মাস ছয়েক ধরে এই তরুণ-তরুণীরা রিহার্সাল করছেন৷ নিজেদের মাথা থেকেই এই মিউজিক্যাল-এর আইডিয়া এসেছে৷ গল্পের মূলে রয়েছে এক শান্তিপূর্ণ জাতি, যাদের উপর হামলা চালানো হয়েছে৷ মানুষকে অপহরণ করা হয়েছে৷ তবে সেই অ্যাডভেঞ্চার ভালোভাবে শেষ হয়েছে৷
প্লুলারআর্টস ইন্টারন্যাশানাল সংস্থার টড জনাথন ফ্লেচার সব আইডিয়া সংগ্রহ করে চিত্রনাট্য লিখেছেন, গানে সুর দিয়েছেন৷ ৩০ বছর ধরে তিনি তরুণ-তরুণীদের নিয়ে কাজ করছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘তারা সমাজে অবদান রাখতে চায়, সেটাই তাদের উদ্দেশ্য৷ শুধু ঘোরাঘুরি করতে চায় না তারা৷ তাদের মনে আত্মবিশ্বাস আনাই আমার মূল দায়িত্ব৷ কঠিন পরিশ্রমের মাধ্যমে সব সম্ভব৷ তারা একবার নিজেদের ক্ষমতার স্বাদ পেলে শুধু নাটক ও সংগীত নয়, হয়ত অংক ও বায়োলজির ক্ষেত্রেও ভালো ফল করবে৷ আত্মবিশ্বাসে আরও ভরপূর হয়ে তারা চেষ্টা করবে৷''
সিনা বলেন, ‘‘এর আগে আমি কখনো শরণার্থীদের সঙ্গে কিছু করিনি৷ তাদের একটা অন্য দিক সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলাম৷ নিজে ব্যক্তিগতভাবে জানতে চেয়েছিলাম, তারা কেমন মানুষ৷ এর আগেও আমি অনেক গ্রুপের নাটকে অভিনয় করেছি৷ তাই এখানে নতুন করে অনেক কিছু শিখলাম৷''
এবার দ্রুত কুশিলবদের পোশাক-পরিচ্ছদ পরে দেখার পালা৷ সেগুলিও তরুণ-তরুণীরা নিজেরাই সেলাই করেছেন৷
টড ফ্লেচার চান, তরুণ-তরুণীরা এই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে যাতে আরও এগিয়ে যায়৷ স্কুল, বন্ধুবান্ধব, পরিবারের মধ্যেও তারা যেন এই সাফল্যের প্রতিফলন ঘটাতে পারে৷
প্রতিবেদন: লেয়া আলব্রেশট/এসবি
৮ তারকা যাঁরা একসময় শরণার্থী ছিলেন
সংগীত শিল্পী, অভিনেত্রী থেকে শুরু করে রাজনীতিবিদ - বিশ্বখ্যাত এমন অনেক তারকাকে নানা কারণে জীবনের একটি সময় শরণার্থীর জীবন বেছে নিতে হয়েছিল৷ ছবিঘরে থাকছে তাঁদের কয়েকজনের কথা৷
ছবি: Getty Images
মারলেনে ডিটরিশ
১৯০১ সালে জার্মানিতে জন্ম নেয়া ডিটরিশ গায়িকা ও অভিনেত্রী হিসেবে বেশ নাম কুড়িয়েছিলেন৷ ১৯৩০ সালে তিনি হলিউডে কাজ করতে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান৷ সেখানে থাকলেও নাৎসি আমলের সমালোচনায় মুখর ছিলেন তিনি৷ ১৯৩৯ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি মার্কিন বাহিনীর জন্য গান গেয়েছেন৷ নাৎসি সরকার জার্মানিতে তাঁর মুভি প্রদর্শনের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল৷
ছবি: picture-alliance/dpa
হেনরি কিসিঞ্জার
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিসিঞ্জার জার্মানির বাভারিয়া রাজ্যে জন্মেছিলেন৷ নাৎসি সরকারের নিপীড়ন থেকে বাঁচতে ১৯৩৮ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে চলে গিয়েছিলেন৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/M. Schiefelbein
মেডেলিন অলব্রাইট
যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম নারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী অলব্রাইট চেক প্রজাতন্ত্রে জন্মগ্রহণ করেছিলেন৷ ১৯৪৮ সালে সে দেশে কমিউনিস্ট সরকার ক্ষমতায় গেলে তিনি তাঁর পরিবারসহ যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান৷
ছবি: Getty Images/AFP/S. Loeb
আলবার্ট আইনস্টাইন
জার্মান ইহুদি এই নোবেল বিজয়ী যখন ১৯৩৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র সফরে ছিলেন তখনই বুঝতে পারেন যে, তাঁর পক্ষে আর জার্মানি ফেরা সম্ভব নয়৷ কারণ ঐ বছরই হিটলার জার্মানির চ্যান্সেলর হন৷ ফলে তিনি যুক্তরাষ্ট্রেই থাকার সিদ্ধান্ত নেন এবং ১৯৪০ সালে সে দেশের নাগরিকত্বও গ্রহণ করেন৷
ছবি: Imago/United Archives International
গেওর্গ ভাইডেনফেল্ড
ইহুদি এই মানুষটির জন্ম অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায়, ১৯১৯ সালে৷ নাৎসিরা যখন অস্ট্রিয়া দখল করে নিলে তিনি লন্ডনে পাড়ি জমান৷ সেখানে তিনি একটি প্রকাশনা সংস্থা চালু করেন৷ ইসরায়েলের প্রথম প্রেসিডেন্টের ‘চিফ অফ স্টাফ’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/N.Bachmann
বেলা বার্টোক
হাঙ্গেরির কম্পোজার, পিয়ানোবাদক ও লোক সংগীত সংগ্রাহক বার্টোক ইহুদি ছিলেন না৷ কিন্তু নাৎসিদের হাতে ইহুদিদের নিপীড়িত হওয়ার বিষয়টির ঘোর সমালোচক ছিলেন তিনি৷ ফলে ১৯৪০ সালে তাঁকে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যেতে হয়৷
ছবি: Getty Images
ইসাবেল আলেন্দে
১৯৭৩ সালে এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে চিলির তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সালভেদর আলেন্দেকে হটিয়ে দেয়া হয় এবং সেই সময়ই তাঁর মৃত্যু হয়৷ এরপর একসময় আলেন্দের এক কাজিনের মেয়ে ইসাবেলকে মেরে ফেলার হুমকি দেয়া হয়৷ তা থেকে বাঁচতে প্রথমে ভেনেজুয়েলায়, তারপর যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান ইসাবেল৷ তাঁর লেখা কয়েকটি উপন্যাস আন্তর্জাতিকভাবে বেশ প্রশংসিত হয়েছে৷
ছবি: Koen van Weel/AFP/Getty Images
মিরিয়াম মাকেবা
‘মামা আফ্রিকা’ নামে পরিচিত দক্ষিণ আফ্রিকার সংগীত শিল্পী মাকেবা একবার গান গাইতে যুক্তরাষ্ট্র গিয়েছিলেন৷ সেই সময় দক্ষিণ আফ্রিকার সরকার বর্ণবাদবিরোধিতার অভিযোগে তাঁর পাসপোর্ট বাতিল করে দেয়৷ ফলে তিনি আর দেশে ফিরতে পারেননি৷ কয়েক দশক পর অবস্থার পরিবর্তন হলে দেশে ফিরে যান মাকেবা৷