সোশাল মিডিয়ায় মিথ্যা তথ্য প্রচার, ব্যক্তিগত আক্রমণ এবং সম্মানহানির অভিযোগে সুইডেনে মামলা হয়েছে শুনে তসলিমা নাসরিন বলেছেন, ‘‘কোনো মিথ্যুক যদি মামলা করে করুক, তার মিথ্যেটা তখন জনসমক্ষে আরো একটু প্রকাশ পাবে।"
বিজ্ঞাপন
ডয়চে ভেলের কনটেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কমের প্রতিবেদন অনুসারে মঙ্গলবার সুইডিশ পুলিশের কাছে মামলাটি দায়ের করেন প্রবাসী কবি ও নাট্যকার আনিসুর রহমান। বর্তমানে ভারতে বসবাসরত তসলিমা নাসরিন বলছেন, মামলার বিষয়টি তিনি জানেন না, তবে ‘কোনো মিথ্যা কথা' তিনি বলেননি।
২০১৭ সালে ঢাকার একটি নিউজ পোর্টালে 'নকল দুনিয়া' শিরোনামে তসলিমার একটি লেখা প্রকাশিত হয়। সেখানে সুইডেনের দগেন্স নিহেতার পত্রিকার সাবেক প্রধান সম্পাদক অরনে রুথ এবং আনিসুর রহমানসহ কয়েকজনের নাম জড়িয়ে বিভিন্ন ‘নেতিবাচক মন্তব্য' করা হয়। সম্প্রতি আনিসুর রহমান তার এক লেখায় নাম উল্লেখ না করে প্রবাসে থাকা কয়েকজন লেখক ও ব্লগারের সমালোচনা করেন। এরপর তসলিমার সেই পুরনো লেখাটি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নতুন করে আলোচনার সূত্রপাত হয়।
আনিসুর রহমানের অভিযোগ, তসলিমাকে ‘সূত্র হিসেবে ব্যবহার করে' বিভিন্ন দেশে কিছু ব্লগার এবং অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট তাকে নিয়ে ‘আপত্তিকর মন্তব্য এবং ব্যক্তিগত আক্রমণ' শুরু করেন। এই প্রেক্ষাপটে প্রতিকার ও ক্ষতিপূরণ চেয়ে তসলিমার বিরুদ্ধে মামলা করেছেন সুইডেন প্রবাসী এই লেখক। বাংলা একাডেমির আজীবন সদস্য আনিসুর রহমান এক যুগের বেশি সময় ধরে সপরিবারে সুইডেনে বসবাস করছেন। তিনি সুইডিশ রাইটার্স ইউনিয়নের পরিচালনা পর্ষদেরও সদস্য।
আনিসুরের লেখা কবিতা ও গদ্য বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। আফ্রিকা, এশিয়া, ইউরোপের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে তার লেখা নাটক পড়ানো হয়। নরওয়ে ও সুইডেনের থিয়েটারে তার লেখা নাটকের মঞ্চায়ন হয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের পাঠ্যক্রমে তার দুটি নাটক অন্তর্ভুত।
এতদিন পরে কেন মামলা করলেন জানতে চাইলে আনিসুর রহমান জানান, "মিথ্যার বিরুদ্ধে একটা প্রতিবাদ করা এবং মিথ্যা প্রচারের কারণে নিরাপত্তা হুমকি আর পেশাগত ক্ষতি থেকে প্রতিকার চাওয়ার অধিকারকে আমি রক্ষা করতে চাই, বিলম্বে হলেও চাই। এর থেকে প্রতিকার পাওয়ার কথা শুরু থেকেই ভেবেছি। কিন্তু এ বিষয়টি নিয়ে প্রয়োজনীয় সময় ব্যয় করে উঠতে পারিনি। সেই সঙ্গে দেশে বিদেশে আমার শুভাকাঙ্ক্ষী বন্ধু সহকর্মীদের সঙ্গে পরামর্শ করতে আর আইনি দিক খতিয়ে দেখে আইনজ্ঞদের পরামর্শ পেতে আমার কিছু সময় চলে যায়। আমার কর্মক্ষেত্রকেও বিষয়টি অবহিত করার একটা ব্যাপার ছিল।"
মৌলবাদীদের হুমকিতে ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশ ছাড়তে বাধ্য হওয়ার পর তসলিমা কয়েক দেশ ঘুরে এখন ভারতে থাকছেন। 'নকল দুনিয়া' শিরোনামের লেখাটি নিয়ে তিনি নিজের অবস্থানে অটল থাকার কথা বলেছেন। একটি ইমেইলের জবাবে তিনি লিখেছেন, "আমি যা লিখেছিলাম, সত্য লিখেছিলাম। মিথ্যে কিছু আমি লিখি না। লিখতে পারি না। মামলার কথা এই প্রথম শুনলাম। কোনো মিথ্যুক যদি মামলা করে করুক, তার মিথ্যেটা তখন জনসম্মুখে আরও একটু প্রকাশ পাবে।"
চিকিৎসকসা শাস্ত্রের ডিগ্রিধারী তসলিমা নাসরিন গত শতকের ৯০ এর দশকে লেখালেখি শুরুর পর আলোচনায় উঠে আসেন। বাংলাদেশে হিন্দু নিপীড়ন নিয়ে উপন্যাস ‘লজ্জা' প্রকাশের পর মৌলবাদীদের হুমকি ও ব্যাপক হৈ চৈয়ের মধ্যে ১৯৯৪ সালে দেশত্যাগে বাধ্য হন তিনি। ক্রমাগত জঙ্গি হুমকির মুখে কয়েকটি দেশ ঘুরে একটি বেসরকারি সংস্থার সহায়তায় যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় নিয়েছিলেন তসলিমা। পরে ভারতে এসে সেখানেই বসবাস করছেন বেশ কয়েক বছর ধরে।
'নকল দুনিয়া' শিরোনামের লেখাটি ২০১৭ সালে ছাপা হয়েছিল জানিয়ে তিনি বলেন, "লেখাটি নেটে পাবেন। কোনো মামলাবাজ এখন আমার ঘাড় মটকে অখ্যাত থেকে বিখ্যাত হতে চাইছে? এসবে প্লিজ আসকারা দেবেন না।"
২০১৭ সালের গ্যালারি
বাংলাদেশে ‘হুমকিতে’ প্রগতিশীলতা
বাংলাদেশে প্রগতিশীলদের প্রাণনাশের হুমকি প্রদান নতুন নয়৷ স্বাধীনতার পরপর একটি কবিতা লেখার জন্য দেশ ছাড়তে হয় একজন কবিকে৷ এখন কেবল হুমকি নয়, খুনও হয় অহরহ৷ কিন্তু এরপরও এসবে জড়িতদের বিরুদ্ধে কোনো কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হয় না৷
ছবি: AFP/Getty Images
দাউদ হায়দার
লেখালেখির জন্য মৌলবাদীদের হুমকি-ধমকিতে প্রথম বাংলাদেশ ছাড়তে হয় দাউদ হায়দারকে৷ ‘কালো সূর্যের কালো জ্যোৎস্নায় কালো বন্যায়’ নামে একটি কবিতার জন্য স্বাধীনতার পরপর তার বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছিল মৌলবাদীরা৷ দৈনিক ইত্তেফাকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, কবিতাটি প্রত্যাহার করে দাউদ হায়দার ক্ষমা প্রার্থণা করলেও শেষ রক্ষা হয়নি৷ তিনি গ্রেপ্তার হন৷ মুক্তির পর তাঁকে কলকাতাগামী বিমানে তুলে দেয়া হয়৷ তিনি জার্মানিতে রয়েছেন৷
ছবি: DW/A. Islam
ড. আহমদ শরীফ
দেশের প্রবীণ শিক্ষাবিদ ড. আহমদ শরীফের বিরুদ্ধে ১৯৯২ সালের শেষের দিকে মৌলবাদীরা মাঠে নামে৷ ওই বছরের শুরুর দিকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে ‘একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি’ গঠিত হয়৷ ড. আহমেদ শরীফও ওই কমিটির সদস্য ছিলেন৷ কমিটির আন্দোলনে চাপে পড়ে ‘যুদ্ধাপরাধীদের দল’ হিসেবে পরিচিত জামায়াত৷ সেই পরিস্থিতিতেই আহমদ শরীফের বিরুদ্ধে ধর্ম অবমানননার অভিযোগ তোলা হয়৷ জামায়াত এ বিষয়ে সংসদেও কথা বলে৷
ছবি: Khandaker Mohitul Islam
তসলিমা নাসরিন
ড. আহমদ শরীফের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরুর কিছুদিনের মধ্যে তসলিমা নাসরিনের নামও সেখানে যুক্ত হয়৷ ১৯৯৪ সালে তসলিমা বিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে৷ আগের বছর প্রকাশিত ‘লজ্জা’ উপন্যাসকে ঘিরেই মৌলবাদী বিভিন্ন সংগঠন ধর্ম অবমাননার অভিযোগে তাঁর ফাঁসি দাবি করে৷ হত্যার ফতোয়া দিয়ে তাঁর মাথার দামও ঘোষণা করা হয়৷ এক পর্যায়ে তাঁকে দেশ ছাড়তে হয়৷
ছবি: AFP/Getty Images
হুমায়ুন আজাদ
‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ নামে একটি বইয়ের জন্য ‘প্রথাবিরোধী’ লেখক হুমায়ুন আজাদের বিরুদ্ধে ২০০৪ সালে মাঠে নামে বিভিন্ন মৌলবাদী সংগঠন৷ এর মধ্যে একই বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি বইমেলা থেকে ফেরার সময় তাঁর উপর হামলা হয়৷ সে বছরেরই আগস্ট মাসে জার্মানির মিউনিখে তাঁর মৃত্যু হয়৷
ছবি: DW/Gönna Ketels
শাহরিয়ার কবির
সাম্প্রতিক সময়ে যাঁরা নানা ধরণের হুমকির শিকার হয়ে আসছিলেন, তাদের মধ্যে শাহরিয়ার কবির অন্যতম৷ দীর্ঘদিন যাবত তিনি একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলনের হাল ধরে আছেন৷ ২০০১ সালে বিএনপি-জামাত জোট সরকার ক্ষমতায় এলে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে তাঁকে গ্রেপ্তারও করা হয়৷ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরুর পর এবং গণজাগরণ মঞ্চে সক্রিয় হওয়ার পর তিনি ও তার সহকর্মীরা অনেকবার হত্যার হুমকি পান৷
ছবি: bdnews24.com/A. Pramanik
জাফর ইকবাল
বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় লেখক এবং শিক্ষাবিদ জাফর ইকবালকেও নানা সময়ে মৌলবাদীরা হত্যার হুমকি দিয়েছে৷ ২০১৬ সালের অক্টোবরে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিম তাঁকে এবং তাঁর স্ত্রী-কে হত্যার হুমকি দেয়৷ এরা আগের বছরও তাঁকেসহ প্রগতিমনা ২০ জনকে হত্যার হুমকি দেয়৷ মৌলবাদীদের হামলায় নিহত হন রেজাউল করিম সিদ্দিকী এবং একেএম শফিউল ইসলাম নামের দু’জন শিক্ষাবিদ ও বেশ কয়েকজন বিদেশি ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু৷
ছবি: DW/M. Mamun
আবদুল লতিফ সিদ্দিকী
টাঙ্গাইলের সিদ্দিকী পরিবারের প্রভাবশালী সদস্য আবদুল লতিফ সিদ্দিকী ২০০৯ এবং ২০১৪ সালের মন্ত্রিসভায় দাপটের সাথেই ছিলেন৷ হজ নিয়ে করা মন্তব্যের পর তাঁর ফাঁসির দাবিতে ধর্মভিত্তিক বিভিন্ন সংগঠন মাঠে নামে৷ এক পর্যায়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে ‘ঠোঁটকাটা’ হিসেবে পরিচিত এই মন্ত্রী দলীয় পদ, মন্ত্রিত্ব সবই খোয়ান৷
ছবি: DW
সুলতানা কামাল
সাম্প্রতিক সময়ে মৌলবাদীদের টার্গেটে পরিণত হন মানবাধিকার কর্মী ও মুক্তিযোদ্ধা সুলতানা কামাল৷ একটি টেলিভিশন বিতর্কে পাল্টা যুক্তি দিতে গিয়ে বলা এক কথার পর তাঁর বিরুদ্ধে মাঠে নামে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম৷ ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাঁকে গ্রেপ্তার বা দেশ ছাড়া করার দাবিও জানায় তারা৷
ছবি: DW/M. Mamun
কেবল হুমকি নয়, খুনও হচ্ছে
সাম্প্রতিক সময়ে মৌলবাদী ও জঙ্গি সংগঠনগুলোর হুমকি দেয়া শুরু হয় গণজাগরণ মঞ্চ শুরুর পর৷ ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ সাজার দাবিতে তরুণ-তরুণীরা শাহবাগে আন্দোলন শুরু করলে মঞ্চকর্মীদের ‘নাস্তিক’ আখ্যা দিয়ে হুমকি দেয়া শুরু হয়৷ এর মাঝে খুন হন মঞ্চকর্মী রাজিব হায়দার৷ একে একে নিহত হন অভিজিৎ, ওয়াশিকুর, অনন্ত, নিলয় ও দীপনসহ অনেকে৷ হুমায়ুন আজাদসহ প্রায় সব হামলায়ই ধারালো অস্ত্র দিয়ে মাথায় আঘাত করা হয়৷
ছবি: Getty Images/AFP
বাঁচার জন্য দেশত্যাগ
২০১৫ সালের ৩১ অক্টোবর ঢাকার লালমাটিয়ায় হামলা হলেও প্রাণে বেঁচে যান ‘শুদ্ধস্বর’-এর আহমেদুর রশীদ টুটুল৷ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে বাসায় ফিরলেও আতঙ্কে স্বাভাবিক চলাফেরায় ফিরতে পারেননি৷ এক পর্যায়ে তিনি দেশ ছাড়েন৷ তাঁর সঙ্গে আহত হওয়া ব্লগার তারেক রহিমও ওই সময় দেশত্যাগ করেছিলেন৷ গত ৩-৪ বছরে আরও অনেক ব্লগার দেশ ছাড়তে বাধ্য হন৷