তাঁতী লীগ সদস্যের মামলায় বিপর্যস্ত এক মাদ্রাসা শিক্ষক
সমীর কুমার দে ঢাকা
২৬ জুলাই ২০২২
গত দেড় বছর ধরে বাড়িতে ঘুমাতে পারেন না ইকবাল হোসেন৷ দেশের বিভিন্ন থানায় ২১টি মামলা হয়েছে তার বিরুদ্ধে৷ বিভিন্ন দপ্তরে জমা পড়েছে ১২৫টি অভিযোগ৷ ৩৫ দিন জেলও খেটেছেন তিনি৷
বিজ্ঞাপন
এখন একটার পর একটা ওয়ারেন্টে পুলিশ খুঁজে বেড়াচ্ছে চাঁদপুরের হাজিগঞ্জের এক মাদ্রাসার শিক্ষক ইকবাল হোসেনকে৷ স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে মরিয়া ইকবাল হোসেনকে সোমবার দেখা যায় সুপ্রিম কোর্টের মাজার গেটের পাশে৷ প্রধান বিচারপতির দৃষ্টি আকর্ষণ করে বিষয়টিতে তার হস্তক্ষেপের দাবি জানাতে স্ত্রী ও দুই সন্তানসহ সেখানে অবস্থান নিয়েছিলেন তিনি৷
তার বিরুদ্ধে কেন এত মামলা? ইকবাল হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘২০১৬ সালে চাঁদপুরের শাহরাস্তি থানার সাংহাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পরিচালনা পর্যদে অভিভাবক প্রতিনিধি হিসেবে মনোনয়ন ফর্ম সংগ্রহ করি আমি এবং আমার স্ত্রী৷ তখন ওই স্কুলের পরিচালনা পর্যদের সভাপতি ছিলেন আজিজুল হক পাটওয়ারী৷ তার অনুমতি ছাড়া মনোনয়ন ফরম কেনায় তিনি ক্ষুব্ধ হন৷ আমাদের দেখে নেওয়ার হুমকি দেন৷ তখন উনি আমাদের বিরুদ্ধে টাকা পাওয়ার একটি মামলা করেন৷ পরে স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিরা আলোচনা করে সমোঝোতা করে দেন৷ ২০১৭ সালে তিনি আর কোনো মামলা করেননি৷ এরপর ২০১৮ সাল থেকে আজিজুল হক পাটওয়ারী, তার ছেলে এবং অজ্ঞাত লোকজন দিয়ে একটার পর একটা মামলা দিচ্ছে৷ বিভিন্ন দফতরে ১২৫টি অভিযোগ দিয়েছে৷''
ইকবাল হোসেন হাজীগঞ্জের কাঁকৈরতলা ইসলামিয়া আলিম মাদ্রাসার গণিতের শিক্ষক৷ তার বাড়ি চাঁদপুরের শাহরাস্তিতে৷ তার দাবি, তার বিরুদ্ধে শুধু মামলা করে এবং করিয়েই ক্ষান্ত হননি আজিজুল হক পাটওয়ারী৷ ওই মাদ্রাসা থেকে তার চাকরি খাওয়ার চেষ্টাও করেছেন৷ দিয়েছেন লিখিত অভিযোগ৷ তবে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ সেসব অভিযোগের কোনো সত্যতা পাইনি৷
জীবনটা দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে: ইকবাল হোসেন
কাঁকৈরতলা ইসলামিয়া আলিমমাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা তাফাজ্জেল হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ইকবাল হোসেন একজন ভালো শিক্ষক৷আজিজুল হক পাটওয়ারী নামের এক ব্যক্তি তার বিরুদ্ধে আমার কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছিল, কিন্তু আমরা তদন্ত করে কোনো সত্যতা পাইনি৷ ইকবাল হোসেনকে চাকরি থেকে বাদ দেওয়ার জন্য তিনি আমাকে চাপও দিয়েছেন৷ কিন্তু কোনো অভিযোগ ছাড়া কেন আমরা তাকে বাদ দেবো? তিনি অত্যন্ত সজ্জন ব্যক্তি৷ ছাত্ররাও তাকে পছন্দ করে৷ ভালো মানের শিক্ষক তিনি৷ আসলে আমার মনে হয়েছে, আজিজুল পাটওয়ারী সাহেব কোনো কারণে ইকবাল হোসেন সাহেবের পেছনে লেগেছেন৷ কিন্তু কী কারণে সেটা আমি জানি না৷''
সোমবার এসব মামলা থেকে মুক্তির দাবিতে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের মাজার গেটের পাশে ব্যানার নিয়ে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন ইকবাল হোসেন৷ সকাল সাড়ে ১০টা থেকে ঘণ্টাখানেক অবস্থান করেন তিনি৷ পরে তাকে সেখান থেকে সরিয়ে দেয় পুলিশ৷ ব্যানারে মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা থেকে মুক্তি এবং আজিজুল হক পাটওয়ারী নামের এক ব্যক্তি ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে প্রধান বিচারপতির হস্তক্ষেপ কামনার কথা লেখা ছিল৷ এ সময় ওই শিক্ষকের সঙ্গে স্ত্রী, ছেলে ও সাড়ে চার বছর বয়সি কন্যাশিশুকেও ব্যানার নিয়ে দাঁড়াতে দেখা যায়৷ তার অন্য দুই মেয়ের একজন চট্টগ্রাম পলিটেকনিকের ছাত্রী এবং আরেক মেয়ে স্নাতকের ছাত্রী৷ পরীক্ষার কারণে তারা আসতে পারেনি বলে জানান ইকবাল হোসেন৷
‘‘ইকবাল হোসেনের কাছে আমি ১২ লাখ টাকা পাই’’
কেন একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে এত মামলা?তদন্তে আসলে পুলিশ কী পেয়েছে? এসব প্রশ্নের জবাবে চাঁদপুরের শাহরাস্তি থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আব্দুল মান্নান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এর একটি মামলাও আমাদের থানায় হয়নি৷ একটি মামলার তদন্তও আমরা করছি না৷ আমাদের কাছে বিভিন্ন মামলার ওয়ারেন্ট আসে৷ সেগুলো তামিল করাই আমাদের দায়িত্ব৷ এখন ইকবাল হোসেনের বিরুদ্ধে কেন মামলা হচ্ছে, কারা করছে, এসবের কিছুই আমরা বলতে পারবো না৷ কিছুদিন পরপর আমাদের কাছে ওয়ারেন্ট আসে, আমরা তখন গ্রেপ্তারের চেষ্টা করি৷ কিন্তু উনাকে ঠিকানা অনুযায়ী পাওয়া যায় না, সেটা আমরা জানিয়ে দেই৷''
ইকবাল হোসেন জানান, চাঁদপুর, নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকা জজ কোর্টে তার বিরুদ্ধে মামলাগুলো করা হয়৷ আজিজুল হক পাটওয়ারী নিজে ১৩টি, তার ছেলে ৩টি এবং বাকিগুলো ওই ব্যক্তির চক্রের লোকেরা দায়ের করেছেন৷ জাতীয় পরিচয়পত্র জালিয়াতি করে তিনটি মামলা করা হয়৷ এছাড়া ১২৫টি অভিযোগও করেছেন৷ ২১টির মধ্যে ৩টি মামলার আসামি না হয়েও ৩৫ দিন জেল খাটতে হয়েছে ইকবাল হোসেনকে৷ জাতীয় পরিচয়পত্র জালিয়াতি করে ওই সিন্ডিকেট বিভিন্ন জেলা ও থানায় মামলাগুলো করে৷ কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাদীর জাতীয় পরিচয়পত্র অস্পষ্ট, আবার কোনোটিতে সংখ্যা কম, আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে মামলায় উল্লিখিত ঠিকানায় বাদীকে পাওয়া যায় না৷
গত দেড় দেড় বছর ধরে বাড়িতে যেতে পারছেন না বলেও দাবি করেন ইকবাল হোসেন৷ তিনি বলেন, ‘‘তিন মেয়ে ও এক ছেলের কেউই বাবাকে পাচ্ছে না৷ ঠিকমতো চাকরি করতে পারছি না৷ জীবনটা দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে৷'' তিনি আরো বলেন, ‘‘২১টির মধ্যে ১৬টি মামলা খারিজ হয়ে গেছে৷ অপর পাঁচটিতে জামিন হয়েছে৷ অপহরণ, প্রতারণা, টাকা নেওয়া, এমন সব অভিযোগে এসব মামলা করা হয়েছে৷ আমার বিরুদ্ধে আসলে ঠিক কতগুলো মামলা আছে, জানি না৷''
জানা গেছে, আজিজুল হক পাটওয়ারী শুধু ইকবাল হোসেন নয় আরো অনেকের বিরুদ্ধেই এমন মামলা করেছেন৷ হাজীগঞ্জের স্থানীয় একজন সাংবাদিক ডয়চে ভেলেকে বলেন, "হঠাৎ করেই আওয়ামী লীগের হয়ে বেশ টাকা পয়সার মালিক হয়েছেন তিনি (আজিজুল হক পাটওয়ারী)৷ তিনি এখন কেন্দ্রীয় তাঁতী লীগের এক নম্বর সদস্য৷ একটি পত্রিকা ও একটি অনলাইনও আছে তার৷ চাকরি দেওয়ার নাম করে অনেকের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন, কিন্তু চাকরি হয়নি, টাকাও ফেরত দেয়নি- এমন অভিযোগও আছে তার বিরুদ্ধে৷ এখন শাহরাস্তিতে বেশ প্রভাবশালী তিনি৷''
শিক্ষা, শিক্ষকতা ও ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কে শিক্ষাঙ্গন ও বাইরের প্রভাব
শিক্ষক মানেই গুরু৷ শিক্ষার্থী তার কাছে স্নেহাস্পদ৷ কিন্তু ইদানীং শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্কেও পরিবর্তনের ইঙ্গিত স্পষ্ট৷ তাতে শিক্ষাঙ্গন, শিক্ষক, সমাজ, রাজনীতি, পাঠক্রমের ভূমিকা কতটুকু? এর উত্তর খুঁজেছে ডয়চে ভেলে৷
ছবি: bdnews24.com
আবদুল্লাহ রানা, সাংস্কৃতিক কর্মী
সামগ্রিক পরিবেশের সঙ্গে আমাদের পারিবারিক পরিবেশও অনেকটা দায়ী৷ আমার ছেলে যখন ক্লাস থ্রি-তে পড়তো, তখন একদিন সে আমাকে বলল, তার ক্লাসের একটা ছেলে হিন্দু বলে তার সঙ্গে কেউ কথা বলে না৷ আমি তখন হেডমাস্টারের সঙ্গে কথা বলি৷ ওই স্কুলের পরিবেশ কিন্তু এমন না৷ তার মানে, পরিবার থেকেই এটা এসেছে৷ আসলে বাচ্চাদের খেলার মাঠ নেই, এলাকায় লাইব্রেরি নেই৷ কীভাবে আমরা ধর্মান্ধ একটা জাতিতে পরিণত হতে পারি- সে দিকেই যাচ্ছি৷
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
তৌহিদুল হক, সমাজ গবেষক ও শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
শিক্ষা ব্যবস্থার প্রধান লক্ষ্য নৈতিকভাবে বলিষ্ঠ জনগোষ্ঠী তৈরি করা৷ নৈতিক শিক্ষা আমরা পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সমাজ থেকে পেয়ে থাকি৷ ধর্মীয় বোধও গুরুত্বপূর্ণ৷ কিন্তু দেখা যাচ্ছে, নৈতিক শিক্ষার দায়টা পরিবার ও রাষ্ট্র শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উপর চাপিয়ে থাকে, যা একপেশে ধারণা৷ সমাজের সব স্তরেই যদি নৈতিকতার চর্চা না থাকে, তাহলে শুধুমাত্র শিক্ষকদের বক্তব্য বা বই পড়ে উদ্বুদ্ধ হবে, এমন মনে করা ঠিক নয়৷
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
আরেফিন শরিয়ত, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
নৈতিক শিক্ষা বইপত্র পড়ে শেখা যায় না৷ পারিবারিক সংস্কৃতি, শিক্ষকের মানসিকতা- এসবের উপর অনেকাংশে নির্ভর করে৷ মানসিকতার কারণে ধর্ম ও বিজ্ঞান আলাদা হয়ে যায়৷ দেখা যাচ্ছে, শিক্ষকদের ভাবনার জায়গা শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রসার ঘটছে না, যে কারণে শিক্ষার্থীরা এখন অন্য ধর্মের শিক্ষককে ভিন্ন চোখে দেখছে৷ এখানে রাষ্ট্রের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ৷ সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা শিক্ষককে কীভাবে দেখছেন তারও প্রতিফলন ঘটছে৷
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
রুকাইয়া জহির, শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
দিন দিন আমরা বাঙালি সংস্কৃতি হারিয়ে ফেলছি৷ গত দুই বছর ধরে কোনো সাংস্কৃতিক চর্চা নেই৷ আমরা যদি বাঙালি সংস্কৃতি আরো বেশি তুলে ধরতে পারি, আরো বেশি চর্চা করতে পারি, তাহলে বিভাজনটা চলে যাবে৷ সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমেই আমরা আবার বিশ্ব বাঙালি এক হতে পারি, আমাদের অন্ধত্ব দূর হতে পারে৷
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
সালমান সিদ্দিকী, সভাপতি, ছাত্রফ্রন্ট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ হওয়া উচিত৷ এই সম্পর্কের উপর নির্ভর করে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা এগুবে, না পেছাবে৷ যত দিন যাচ্ছে, ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক নষ্ট হচ্ছে৷ এখন আমরা দেখি, ছাত্রকে অপহরণ করছেন শিক্ষক৷ আবার ছাত্ররা শিক্ষকের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে৷ এখন শুধু স্কুল না, পুরো রাষ্ট্রের মধ্যে ধর্মকে ব্যবহার করা, ধর্মকে ব্যবহার করে অন্যকে ফাঁসানো, একটা উন্মাদনা তৈরি করার প্রবণতা বাড়ছে৷
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
সায়মা সিদ্দিকা, উন্নয়নকর্মী
আমাদের মধ্যে ধর্মভিরুতা তৈরি করা হচ্ছে৷ দীর্ঘদিনের যে সমাজ-সংস্কৃতি তা থেকে আমাদের দূরে সরিয়ে ফেলা হচ্ছে৷ এটা হওয়া উচিত না৷ পরিবার থেকেই বাচ্চাদের আমাদের কৃষ্টি-কালচার শেখাতে হবে৷ যেমন কীভাবে আমরা একে অপরের ধর্মীয় উৎসবের সঙ্গে মিশে যেতাম, এখনও যেতে পারি৷ এতে আমাদের ধর্মের কোনো ক্ষতি হবে না৷ আমি এখনও বিশ্বাস করি, সমাজে এই ধরনের মানুষ এখনও আছে৷ তারাই পরিস্থিতি পালটে দেবে৷
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
অনিক রায়, সভাপতি, ছাত্র ইউনিয়ন
আমাদের সময় যেভাবে পাঠ্যবইয়ে ধর্ম পড়ানো হতো, এখন সেভাবে হচ্ছে না৷ এখন ধর্মকে সাম্প্রদায়িকীকরণ ও উগ্রবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখানোর চেষ্টা হচ্ছে৷ ওয়াজগুলো কোনো সেন্সর ছাড়াই চলছে৷ সেখানে নারীর বিরুদ্ধে বা অন্য ধর্মাবলম্বীদের বিরুদ্ধে কথা বলা হয়, যেটা বারবার বলার কারণে মানুষের মাথায় গেঁথে যায়৷ শিক্ষক হৃদয় মন্ডলের যে ঘটনা, সেখানে একটি ছেলে বারবার বলছে, সে ওয়াজে শুনেছে৷
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
উৎপল বিশ্বাস, সাবেক ভিপি, জগন্নাথ হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে যে সম্পর্কটা আমরা ছোটবেলায় দেখেছি এখন সেটা আর নেই৷ শিক্ষকরা এখন অনেক হীনমন্যতায় ভুগছেন৷ নৈতিক শিক্ষা দিতে গিয়ে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর আক্রমণের শিকার হতে হয় কিনা তা তাদের ভাবনায় থাকছে৷ এই সুযোগটা শিক্ষার্থীরা নিচ্ছে৷ কোনো শিক্ষক যদি কিছু বলেনও, শিক্ষার্থীরা সেটিকে ঘুরিয়ে অন্যদিকে নিয়ে যাচ্ছে৷ এই যে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে দূরত্ব, এর জন্য জাতিকে আগামী দিনে চড়া মাশুল দিতে হবে৷
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
সুস্মিতা রায় সুপ্তি, চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, ঢাকার সমন্বয়ক
আমরা যেটা দেখছি, শিশুদের অ্যাকাডেমিক শিক্ষা এত বেশি বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, যার ফলে তারা নৈতিক শিক্ষার কথা ভাবতেই পারছে না৷ শুধু বই পড়ছে৷ এখন বেশি নম্বর পাওয়ার এক ধরনের প্রবণতা তৈরি হয়েছে৷ স্কুলের প্রশ্ন ফাঁস করছেন শিক্ষক৷ এগুলো তো ভয়াবহ ব্যাপার৷ যে শিক্ষক নৈতিক শিক্ষা দেবেন, তিনি যদি প্রশ্ন ফাঁস করে দেন, তাহলে কোথায় শিখবে৷ আবার অভিভাবকরাও এই প্রশ্ন সন্তানদের হাতে তুলে দিচ্ছেন৷
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
শান্তনু মজুমদার, অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় নৈতিক শিক্ষা যে খুব একটা গুরুত্ব পায়, তা নয়৷ শিক্ষার ক্ষেত্রে সহনশীলতা এবং বৈচিত্র খুবই প্রয়োজন৷ আমি এখনও বিশ্বাস করি না, বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী ধর্মের ভিত্তিতে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক রচনা করে৷ সাম্প্রতিক সময়ে আমরা যে প্রবণতা দেখছি, সেটা একটা দুষ্টু প্রবণতা৷ শিক্ষার্থীদের মনোজগৎ নষ্ট করার রাজনৈতিক ও মতাদর্শিক চেষ্টা তো আছেই৷ তবে আমি মনে করি না, এখনও সব ধ্বংসের মুখে চলে গেছে৷
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
10 ছবি1 | 10
২০২০ সালের ২৬ জুলাই আজিজুল হক পাটওয়ারীর বিরুদ্ধে থানায় একটি জিডি করেন চাঁদপুরের তৎকালীন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আফজাল হোসেন৷ আজিজুল হকের বিরুদ্ধে একটি অভিযোগের তদন্তের দায়িত্ব ছিল আফজাল হোসেনের৷ তদন্তে সহযোগিতা না করে উল্টো হুমকি দেওয়ার অভিযোগে তখন ওই জিডিটি করেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার৷
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে আজিজুল হক পাটওয়ারী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ইকবাল হোসেনের কাছে আমি ১২ লাখ টাকা পাই৷ সেই টাকা তিনি দিচ্ছেন না৷ এই কারণে আমি একটি মামলা করেছি, সেই মামলায় তার কারাদণ্ড হয়েছে৷ উল্টো ইকবাল হোসেন ও তার ভাইয়েরা আমাদের বিরুদ্ধে ৮টি মামলা করেছে৷ কোনো মামলাতেই অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি৷'' ইকবাল হোসেনকে ১২ লাখ টাকা ধার দেয়ার কারণ চাইলে আজিজুল হক পাটওয়ারী বলেন, "প্রতিবেশীকে দিতেই তো পারি৷ আসলে আমি আওয়ামী লীগের রাজনীতি করি, আর সে জামায়াত-শিবিরের কাছ থেকে টাকা নিয়ে আমাকে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা চালাচ্ছে৷''
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আফজাল হোসেন কেন তার বিরুদ্ধে জিডি করেছিলেন জানতে চাইলে আজিজুল হক বলেন, ‘‘তিনি মাদকাসক্ত ছিলেন৷ আমি একজন নাগরিক হিসেবে পুলিশ সুপারের কাছে তার ডোপ টেস্টের আবেদন করেছিলাম৷ তিনি আসলে ইকবালের পক্ষ নিয়েছিলেন৷ এ কারণে আমার উপর ক্ষুব্ধ ছিলেন৷'' আর চাকরি দেওয়ার নাম করে অনেকের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘‘এসব অভিযোগ সত্য না৷ স্থানীয় সাংবাদিকরা অনেক কথাই বলেন, কিন্তু কোনো প্রমাণ দিতে পারবেন না৷''
আজিজুল হক পাটওয়ারী সম্পর্কে শাহরাস্তি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান মিন্টুর কাছ থেকেও প্রকৃত তথ্য জানার চেষ্টা করেছে ডয়চে ভেলে৷ তিনি বলেছেন, “আজিজুল হক পাটওয়ারীকে একজন প্রতারক ও মামলাবাজ হিসেবেই এলাকার মানুষ জানে। মামলা করাই তার পেশা। এলাকার বহু মানুষের বিরুদ্ধে তিনি মামলা করেছেন। এমনকি আমি যখন উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হই, তখন তিনি এই নির্বাচন বাতিল, গেজেট বাতিলসহ এই নির্বাচন নিয়েই তিনটি মামলা করেছিলেন। আমি আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি আমার বিরুদ্ধে যদি তিনটি মামলা করে, তাহলে সাধারণ মানুষের অবস্থা কী বুঝতেই পারছেন। আমি আওয়ামী লীগের একটা দায়িত্বে থাকায় আমার বিরুদ্ধে মামলা করে সুবিধা করতে পারেননি। আসলে এলাকায় তার কোনো অবস্থান নেই। ঢাকায় বসেই তিনি এসব করেন। কিভাবে তাঁতী লীগে তিনি ঢুকলেন সেটাও আমরা জানি না। দলীয় ফোরামে বিষয়টা আমরা জানিয়েছি। আমরা খোঁজ নিয়ে জেনেছি, এই লোক আগে জাতীয় পার্টি করতে, তারপর বিএনপি এবং এখন আবার আওয়ামী লীগে এসেছেন। ২০০৫ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি তিনি শেখ হাসিনার ফাঁসির দাবিতে ঢাকায় মানববন্ধন করেছিলেন। সেই খবর তখন সব পত্রিকায় ছাপাও হয়েছে। এই বিষয়টিও আমরা দলীয় ঊর্ধ্বতনদের অবহিত করেছি। এখন তিনি এলাকা এলে পুলিশ তার বাড়িতে যায়। কেন যায়, সেটা জানি না। তবে এটা বলতে পারি, তার মামলার কারণে বহু নিরীহ মানুষ এখন নিঃস্ব। এর একটা প্রতিকার হওয়া প্রয়োজন।’’
তিনটি বৈশ্বিক শিক্ষা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান
শিক্ষার মান তুলে ধরে এমন তিনটি বৈশ্বিক সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান বেশ খারাপ৷ এর মধ্যে দুটি সূচকে দেখা যাচ্ছে, দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান সবার নীচে৷
ছবি: Abdullah Al Momin/bdnews24.com
বৈশ্বিক জ্ঞান সূচক
ইউএনডিপি ও মোহাম্মদ বিন রশিদ আল মাকতুম নলেজ ফাউন্ডেশনের প্রকাশিত ২০২১ সালের বৈশ্বিক জ্ঞান সূচকে ১৫৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২০তম৷ সাতটি বিষয় বিবেচনায় নিয়ে এটি তৈরি করা হয়েছে৷ প্রাক-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা, প্রযুক্তিগত ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা, উচ্চশিক্ষা, গবেষণা, উন্নয়ন ও উদ্ভাবন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, অর্থনীতি এবং সাধারণ সক্ষমতার পরিবেশ৷ সূচক সম্পর্কে আরও জানতে উপরে (+) চিহ্নে ক্লিক করুন৷
ছবি: Abdullah Al Momin/bdnews24.com
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর অবস্থান
বৈশ্বিক জ্ঞান সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের চেয়ে খারাপ অবস্থানে আছে পাকিস্তান (১২৩), নেপাল (১২৮) ও আফগানিস্তান (১৫১)৷ দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষে আছে শ্রীলঙ্কা (৮৬)৷ ভারত ও ভুটান আছে যথাক্রমে ৯৭ ও ১০৮তম স্থানে৷
ছবি: David Talukdar/Zumapress/picture alliance
প্রতিভা সূচক
ফ্রান্সভিত্তিক বিজনেস স্কুল ‘ইনসিয়েড’ ও ওয়াশিংটনভিত্তিক ‘পোর্টুল্যান্স ইনস্টিটিউটের’ গত অক্টোবরে প্রকাশিত ২০২১ সালের ‘গ্লোবাল ট্যালেন্ট কম্পিটিটিভনেস ইনডেক্সে’ ১৩৪ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২৩ নম্বরে৷ মেধা অর্জনের সক্ষমতা, আগ্রহ, বিকাশ, ধরে রাখা, বৃত্তিমূলক, কারিগরি দক্ষতা ও বৈশ্বিক জ্ঞান- এই সাতটি বিষয় বিবেচনায় নিয়ে সূচকটি তৈরি করা হয়েছে৷ সূচক সম্পর্কে আরও জানতে উপরে (+) চিহ্নে ক্লিক করুন৷
ছবি: Imago/epd
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর অবস্থান
প্রতিভা সূচক দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান সবার নীচে৷ এই অঞ্চলে শীর্ষে আছে ভারত (৮৮)৷ এরপর আছে শ্রীলঙ্কা (৯৩), পাকিস্তান (১০৭) ও নেপাল (১১৩)৷
ছবি: AP
বৈশ্বিক উদ্ভাবন সূচক
জাতিসংঘের সংস্থা ‘ওয়ার্ল্ড ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি অর্গানাইজেশনের’ প্রকাশিত ২০২১ সালের বৈশ্বিক উদ্ভাবন সূচকে ১৩২ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১১৬ নম্বরে৷ সূচক সম্পর্কে আরও জানতে উপরে (+) চিহ্নে ক্লিক করুন৷
ছবি: bdnews24.com
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর অবস্থান
উদ্ভাবন সূচকেও দক্ষিণ এশিয়ায় সবার নীচে আছে বাংলাদেশ৷ সবচেয়ে ভালো অবস্থানে আছে ভারত (৪৬)৷ এরপর আছে শ্রীলঙ্কা (৯৫), পাকিস্তান (৯৯) ও নেপাল (১১১)৷
ছবি: IANS
বাংলাদেশে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ সবচেয়ে কম
ইউনেস্কো ইনস্টিটিউট ফর স্ট্যাটিস্টিকসের হিসেব বলছে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশে শিক্ষাখাতে সবচেয়ে কম বাজেট বরাদ্দ করা হয়৷ ১৯৭১ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে এই তথ্য পাওয়া গেছে৷ বাংলাদেশের সাম্প্রতিক প্রস্তাবিত বাজেটে শিক্ষাখাতে জিডিপির মাত্র ১.৮৩ শতাংশ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে৷ একটি দেশের জিডিপির ৬ শতাংশ শিক্ষা খাতে ব্যয় করা উচিত বলে মনে করে ইউনেস্কো৷ প্রতিবেদনটি পড়তে উপরে (+) চিহ্নে ক্লিক করুন৷