তাঁদের কথা কেউ বলে না
২৬ জানুয়ারি ২০১৩ক'দিন পরই ঢল নামবে একুশে বইমেলায়৷ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকেও আসবেন অনেকে, বই কিনতে, বইকে ঘিরে মানুষের আনন্দমেলায় শরিক হতে৷ সেখানে তাঁদের হয়ত দেখবেনও না৷ তাঁরা বইমেলার নেপথ্যের কর্মী৷
তাজমহলে কত শ্রমিকের ঘাম-রক্ত মিশে আছে বলতে পারেন? কে রাখে তাঁর খোঁজ! সবার আগ্রহ শাহজাহানের অমর প্রেমের নিদর্শনের দিকে৷ কথাটা ফরিদা, আরিফের কথা ভাবলেও খুব মনে পড়ে৷ একুশে বইমেলাকে ঘিরে তাঁদের কবে থেকেই নাওয়া-খাওয়া হারাম৷ বইয়ের পর বই বেরোচ্ছে তাঁদের হাত দিয়ে৷ কিন্তু ক'জন চেনেন তাঁদের? সংবাদ মাধ্যম, প্রকাশক, লেখক, পাঠক – কে কতটুকু গুরুত্ব বা মর্যাদা দেয় তাঁদের?
ফরিদা বা আরিফের চেয়ে অনেক ভালো আছেন ঝন্টু চৌধুরী৷ একসময় স্বপ্ন ছিল ঢাকাই ছবির নায়ক হবেন৷ হতে পারেননি৷ সেই ব্যর্থতা বইয়ের সঙ্গে জড়িয়ে দিয়েছে তাঁকে৷ প্রতি বছর বইমেলা আসে তাঁর জন্য উপার্জনের বড় একটা সুযোগ হয়ে৷ মাসে গড়ে কমপক্ষে ৪০-৫০ হাজার টাকা আয় – এটা অন্য চাকরি করে সম্ভব নয়৷ সবাই যাঁদের চেনেন ‘প্রুফ রিডার' হিসেবে, সংবাদ পত্রের জগতে হালে যাঁদের পোষাকি নাম হচ্ছে ‘সম্পাদনা সহকারি', ঝন্টু চৌধুরী তাঁদেরই একজন৷
সম্প্রতি দৈনিক কালের কণ্ঠ সাব-এডিটর পদে কাজ করার সুযোগ দিয়েছে তাঁকে৷ এটা তাঁর যোগ্যতারই স্বীকৃতি৷ কিন্তু এ স্বীকৃতি এবং সম্মান তো সংসার চালানোর নিশ্চয়তা নয়৷ সেই নিশ্চয়তার অনেকটাই দেয় বানান এবং বাক্য ঠিক করে চেনা-অচেনা অনেক লেখকের লেখা ছাপার যোগ্য করার কাজ৷ ঝন্টু চৌধুরীর বড় আয় আসে সেখান থেকেই৷ এই তৃপ্তির পাশেই ভীষণ কষ্টদায়ক এক সত্যের বাস৷
ঝন্টু চৌধুরী জানালেন প্রুফ রিডারদের অনেকেই এখনো সম্মান করেন না, বানান ঠিক করাকে চাল থেকে পোকা বাছার সঙ্গে তুলনা করে হেয় করার চেষ্টা করেন অনেকে৷ তাঁর কথায়, ‘‘প্রুফ রিডিংকে অনেকেই ভালো চোখে দেখেন না৷ অনেকেই মন্তব্য করেন, এরা পোকা বেছে খায়৷''
ফরিদার সেই কষ্ট নেই৷ কোলের সন্তান রেখে বাইরে যাওয়া সম্ভব নয় বলে ঘরে বসেই কাজ করেন৷ সংসারের যাবতীয় কাজের পাশাপাশি উদয়াস্ত খেটে যান কম্পিউটার নিয়ে৷ কম্পোজ করেন৷ এবারের বইমেলাতেও থাকছে তাঁর কম্পোজ করা অন্তত ৬-৭টি বই৷ সংসারের অভাব একটু হলেও ঘোচাতে পারছেন, ঢাকার গৃহিনী ফরিদার এটাই সবচেয়ে বড় তৃপ্তি৷ সঙ্গে আছে একটা গর্ব, তাঁর কাজ এত ভালো যে সবাই চোখ বুজে আস্থা রাখতে পারেন তাঁর ওপর৷
ফরিদা বললেন, ‘‘আমি এমনই কাজ করি যে আমার কম্পোজ করা কাজের কোনো প্রুফ দেখা লাগে না৷''
বাংলাবাজারে ‘শিল্পাঙ্গন' নামে ছোট একটি প্রতিষ্ঠান খুলেছেন আরিফ হোসেন৷ তিন জন কাজ করেন সেখানে৷ পেস্টিংয়ের কাজ৷ ভালো কাজের স্বীকৃতি বইমেলা এলে তাঁরা পান টাকার অঙ্কে৷ সারা বছর যে প্রতিষ্ঠানের খরচ তোলাই দায়, বইমোলা এলে সেখানেই মাসে আয় হয় গড়ে ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা৷
আরিফ জানালেন বইমেলাকে ঘিরে এবারও শিল্পাঙ্গন খুবই ব্যস্ত৷ বললেন, ‘‘মেলার সময় আমাদের বলতে গেলে চব্বিশ ঘণ্টাই কাজ চলে৷ একেবারে বিশ্রাম না নিলে চলে না বলে দিনে ৪-৫ ঘণ্টা ঘুমাই৷''
গত দু-তিন মাস ধরে ঝন্টু চৌধুরীও অনেক ব্যস্ত৷ খুব আনন্দ নিয়েই করে যাচ্ছেন বইমেলার বইয়ের বানান ঠিক করার কাজ৷ ‘পোকা দেখার কাজ' বলে যাঁরা তাঁকে ছোট করার চেষ্টা করেন তাঁদের পাত্তা না দিলেও তাঁর চলে, কারণ, যে যা-ই বলুক তাঁদের কাজের গুরুত্ব যে দেশবরেণ্য তারকা লেখকদেরও কেউ কেউ বোঝেন ঝন্টু সেটা জানেন৷ স্বয়ং জাফর ইকবাল তাঁকে যে উৎসাহ দিয়েছেন তার গুরুত্ব অস্বীকার করেন কী করে!
‘‘প্রখ্যাত সাহিত্যিক মোহাম্মদ জাফর ইকবালের একটি বইয়ের প্রুফ দেখে দিয়েছিলাম৷ এক বইমেলায় তাঁর সঙ্গে দেখা৷ তিনি একটি বইয়ে মন্তব্য লিখে দিয়েছিলেন – ঝন্টু এত বানান কী করে আপনি মাথায় রাখেন, তা ভাবার মতো বিষয়৷ উনার মতো একজন লেখক আমার বিষয়টা বুঝতে পেরেছেন যে, আমাকে অনেক কিছু জেনে বা মাথায় রেখে কাজ করতে হয়, এটা আমার ভীষণ ভালো লেগেছে৷''