1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

তাঁদের ভিক্ষাও কেড়ে নেবেন মমতা?

পায়েল সামন্ত কলকাতা
৫ ডিসেম্বর ২০১৮

রাস্তার মোড়ে মোড়ে বৃহন্নলা বা হিজড়াদের ভিক্ষাবৃত্তি রুখতে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ‘আসল' বৃহন্নলাদের চাকরির আশ্বাস দিয়েছেন৷ প্রশ্ন উঠছে, কলকাতার সৌন্দর্যায়নের জন্য এই পদক্ষেপ কতটা জরুরি?

Indien Hijra Das dritte Geschlecht
ছবি: picture alliance/dpa/Jagadeesh Nv

তিনি সৌন্দর্যের পূজারী৷ কলকাতাকে লন্ডন বানানোর অভিপ্রায় রয়েছে তাঁর৷ এবার তাই নীল-সাদা রং ও ত্রিফলা আলোয় সজ্জিত মহানগরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নজরে পড়ল রাস্তার মোড়ে মোড়ে ভিক্ষাজীবী বৃহন্নলাদের উপর৷ রাজ্যের প্রশাসনিক সদর দপ্তর নবান্নে একটি উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে তিনি জানিয়েছেন, বৃহন্নলারা কলকাতার রাস্তায় যেভাবে ভিক্ষা করেন, তা শহরের সৌন্দর্যের পক্ষে যেমন খারাপ, তেমনি শহরের নাগরিক হিসেবে ভিক্ষাজীবীদেরও বেমানান লাগে৷ তিনি আশ্বাস দিয়েছেন, ভিক্ষাবৃত্তি ছাড়লে আসল বৃহন্নলাদের গ্রিন পুলিশ কিংবা সমাজকল্যাণের কাজে অন্তর্ভুক্ত করা হবে৷ তবে যারা কেবল বৃহন্নলার ভেক ধরে ভিক্ষা করেন, তারা এ সুযোগ পাবেন না৷ সে জন্যই আসল বা নকল বৃহন্নলা চিহ্নিতকরণের দায়িত্ব থাকবে রাজ্যের পুলিশের হাতে৷

সমাজকর্মীসহ ট্রান্সজেন্ডার সমাজের অনেকেরই এ বিষয়ে আপত্তি রয়েছে৷ রয়েছে শঙ্কাও৷ রাজ্য ট্রান্সজেন্ডার বোর্ডের সদস্য রঞ্জিতা সিনহা বললেন, ‘‘কোনো গবেষণা বা সমীক্ষা না করে হঠাৎ করে এই ভিক্ষাবৃত্তি বন্ধ করার কথা আসছে কেন? শহরের সৌন্দর্যায়ন নিয়ে ভাবতে গিয়ে এই প্রান্তিক মানুষগুলোর উপর প্রশাসন খড়গহস্ত হয়ে উঠছে না তো? সেটা ভাবতে হবে৷'' 

‘কোনো সমীক্ষা না করে হঠাৎ এই ভিক্ষাবৃত্তি বন্ধ করার কথা আসছে কেন'

This browser does not support the audio element.

এই সংক্রান্ত দেশব্যাপী কোনো সরকারি টাস্ক ফোর্স নেই৷ তাইসারা ভারতে ট্রান্সজেন্ডারদের সংখ্যা বা অবস্থার সম্পর্কে কিছু জানা যায়নি৷ এর আগে কোনো সরকার ট্রান্সজেন্ডারদের জীবিকা নিয়ে এমনটা ভাবেননি৷ মমতার এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছেন মুম্বইয়ের সমাজকর্মী গৌরী সাওয়ান্ত৷ ২০১৪ সালে দেশের সর্বোচ্চ আদালত তৃতীয় লিঙ্গকে স্বীকৃতি দেয়৷ সেই স্বীকৃতির জন্য পিটিশন করেছিলেন মুম্বইয়ের বাসিন্দা গৌরী৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বললেন, ‘‘মহারাষ্ট্রে তিন লাখ বৃহন্নলা ভিক্ষা করে৷ শুধু মহারাষ্ট্র কেন, সারা দেশেই হিজড়াবৃত্তি, সেক্স ওয়ার্ক বা ভিক্ষাবৃত্তি আছে৷ কী করবে তারা? পড়াশুনো জানা নেই৷ স্কুল-কলেজে কাউকে পড়তে দেয় না৷ এদের মানবসম্পদ হিসেবে কাজে লাগিয়ে কর্মসংস্থান করে দেওয়ার পরিকাঠামো নেই৷ মানবী বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো মাঝবয়সে অধ্যক্ষ হওয়ার জন্য পড়াশোনার যোগ্যতা সবার তো থাকে না৷''

বৃহন্নলাদের জীবিকা নিয়ে রূপান্তরকামীদের সংগঠনগুলি কিছু ভাবছে না? অ্যাসোসিয়েশন অফ ট্রান্সজেন্ডার অ্যান্ড হিজড়া ইন বেঙ্গল সংগঠনের অধিকর্তা রঞ্জিতা বলেন, ‘‘এখনো অবধি রাজ্যের বোর্ড এই নিয়ে কোনো কাজ করেনি৷ তবে আমাদের সংস্থা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের যোগ্যতা অনুযায়ী মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ ট্রেনিং, সেলাইয়ের প্রশিক্ষণ, নাচ-গান শেখাচ্ছে, যাতে তারা পরবর্তীকালে এসব পেশা হিসেবে নিতে পারে৷'' 

ভিক্ষার মতো হিজড়াবৃত্তিতেও বহু তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের রুটিরুজি জড়িয়ে। এদের মধ্যে অনেকেই স্নাতক বা অন্যান্য ডিগ্রিধারী৷ কিন্তু শুধুমাত্র তৃতীয় লিঙ্গ এই পরিচয়ের জন্যই তাঁদের কোথাও কিছু সুযোগ নেই৷ এমন উদাহরণ ভূরি ভূরি৷ কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালের ওটি টেকনিশিয়ান জিয়া দাসের বিএসসি ডিগ্রি থাকা সত্ত্বেও তৃতীয় লিঙ্গের পরিচিতির কারণে কোথাও কাজের সুযোগ পাচ্ছিলেন না৷ সে জন্য তাকে বিহারে ‘লৌন্ডা ডান্স'-এর নামে একপ্রকার ভিক্ষাবৃত্তি করতে হয়েছে৷ বিয়েবাড়িতে ‘শগুন ডান্সার' হতে হয়েছে৷ এমনকী বন্দুকের নলের সামনেও নাচতে হয়েছে৷ বিহার ছেড়ে এ রাজ্যে এসে তাঁকে ট্রেনে ভিক্ষাবৃত্তিও করতে হয়েছে৷

‘রূপান্তরিত পুরুষ হয়েই চাকরির চেষ্টা চালাবো,নিজের অস্তিত্বকে বিসর্জন দেব না’

This browser does not support the audio element.

জিয়া ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘তৃতীয় লিঙ্গের কারণে আমার শিক্ষাগত যোগ্যতা দেখা হতো না৷ রিসেপশনিস্টের ইন্টারভিউতে আমাকে নাচ-গানের কথা জিজ্ঞেস করা হয়েছিল৷ একটা কলসেন্টারে টাইপিস্টের চাকরির জন্য আমাকে একরাতের শয্যাসঙ্গিনী হতে বলা হয়েছিল৷ শেষে ট্রেনে ভিক্ষে করে টাকা-পয়সা তুলতে বাধ্য হয়েছিলাম৷''

জিয়ার কথায় উঠে আসে তৃতীয় লিঙ্গের জন্য সংরক্ষণের প্রসঙ্গ৷ জিয়া বলেন, ‘‘আমাদের যদি একটা সংরক্ষণ থাকত, তাহলে অনায়াসে যে সব কাজ আমাকে বাধ্য হয়ে করতে হয়েছে, সেগুলো না করে অন্য কাজের জন্য আবেদন করতে পারতাম৷ সবাই নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী কাজ করতে পারে তাহলে৷ কোনো কাজে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ না করলে জোর করে তো কাজ করানো যাবে না৷ সিভিক পুলিশের চাকরিও যেন চাপিয়ে দেওয়া না হয়৷''    

এমনই গল্প শ্রেয়া বা বৈশালীরও৷তৃতীয় লিঙ্গের পরিচয় সামনে এসে যাওয়ায় তাঁদের মেধা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলেনি৷ স্রেফ নাকচ করে দেওয়া হয়েছে তাঁদের যোগ্যতাকে৷ তাই জীবিকা নির্বাহের জন্য এঁদের সেক্স ওয়ার্ক বা ‘লৌন্ডা ডান্স' করতে হয়৷ ইসলামপুরের লোক আদালতের বিচারক জয়িতা মণ্ডলকেও একসময় ভিক্ষাকেই জীবিকা বলে মেনে নিতে হয়েছিল৷ তাঁর কাছে উপার্জনের অন্য উপায় ছিল না৷ বৈশালী ১০ বছর নিম্ন আদালতে ক্লার্কের কাজ করেও আজ ট্রান্সজেন্ডার পরিচয়ের জন্য লৌন্ডা ডান্স করছেন৷

জিয়া, শ্রেয়ার মতো আরও অনেকের উদাহরণ টেনে রঞ্জিতা প্রশ্ন তোলেন, ‘‘প্রথমেই সিভিক পুলিশ বা সমাজকল্যাণের কাজের কথা বলা হচ্ছে কেন? যোগ্যতা অনুযায়ী কাজের কথা বলা হচ্ছে না কেন? যে আইনজীবী হতে পারে, তাকে সিভিক পুলিশ হতে হবে কেন?''

“আমাদের একটা সংরক্ষণ থাকলে, চাপিয়ে দেওয়া কাজ না করলেও চলতো’

This browser does not support the audio element.

কবিরাগ পোদ্দার রূপান্তরিত পুরুষ হিসেবে ফর্মে লেখার পর থেকেই তাঁর জন্য চাকরির দরজাগুলি বন্ধ৷ তিনি যোগ্যতায় ডাবল এমএ৷ আগে একটি নামী সংস্থার উচ্চ পদে চাকরি করতেন৷ কিন্তু তৃতীয় লিঙ্গের পরিচয়ের কারণে তাঁর এখন আর কোনো চাকরি নেই৷ তিনি বলেন, ‘‘আসল-নকল নিয়ে কথা হচ্ছে৷ যোগ্যতাটা কেউ খতিয়ে দেখছে না৷ পেট চালানোর জন্য কাউকে কিছু তো করতেই হবে৷ সে জন্যই ভিক্ষাবৃত্তি বা সেক্স ওয়ার্ক করতে হয় সিগন্যালে দাঁড়িয়ে৷ আমাকে পরিবার থেকে নিঃশব্দ সমর্থন করে বলে আমার চলে যায়৷ এটা তো সবার ক্ষেত্রে সম্ভব হয় না৷ এ জন্যই বৃহন্নলাদের আরো প্রশিক্ষিত হতে হবে৷ যোগ্য হয়ে উঠতে হবে৷''

কবিরাগ এখন অ্যাসোসিয়েশন অফ ট্রান্সজেন্ডার অ্যান্ড হিজড়া ইন বেঙ্গল-এর তরফে বৃহন্নলাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা বাড়ানোর দায়িত্ব নিয়েছেন৷ স্বনির্ভর গোষ্ঠীর প্রশিক্ষণে তদারকি করছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘আমাদের গোষ্ঠীতে মূলত বেশিরভাগই ড্রপ আউট৷ আর অন্যেরা পরিচয়ের জন্য কাজই পাবে না৷ সমাজই পিছিয়ে দিচ্ছে আদতে পিছিয়ে-থাকাদের৷''

বিতর্ক শুধু এখানেই থেমে নেই৷ মুখ্যমন্ত্রীর কথা অনুযায়ী, প্রকৃত বৃহন্নলাদের যাচাই করবে পুলিশ! এ ব্যাপারে গৌরী সাওয়ান্ত বলেন, ‘‘পুলিশ এখানে কী করবে? যেখানে সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, সেল্ফ ডিক্লেয়ারেশন হতে হবে৷ অন্য কাউকে বলতে হবে না৷ কেউ যদি বলে, আমি ট্রান্সজেন্ডার, তাহলে সেটাই মেনে নিতে হবে৷ কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলবে না৷ সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তের সামনে মমতা কেউ নন৷''

তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র দেশে দুবেলা আহারের জন্য অনেক পুরুষই বৃহন্নলা সেজে ভিক্ষাবৃত্তিতে যোগ দেন৷ সংবাদ শিরোনামে অনেক সময় তা উঠে আসে৷ কিন্তু তার মানে এই নয় যে, ২০ জন ঠগের জন্য ৮০ জন বৃহন্নলা ভালো সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবেন৷ এমনটাই মনে করেন গৌরী৷ তাঁর পরামর্শ, ‘‘আইডি প্রুফ হিসেবে আধার কার্ডসহ ডকুমেন্ট তৈরি করিয়ে নিলেই তো হয়৷ আর এভাবে শুরুটা করা দরকার৷ নকল বৃহন্নলার ভয়ে কাজটা যেন ব্যাহত না হয়৷ সরকার নিজের কর্মসংস্থানের নীতি বদলাক৷ সরকারি দপ্তরে রূপান্তরকামীদের নেওয়াটা আবশ্যিক করে তুলুক৷''

রঞ্জিতা বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী যেটা ভেবেছেন, সেটাতে খুশি হচ্ছি৷ তবে শঙ্কাও আছে৷ নালসা রায়কে মানা হচ্ছে না? কোথাও গিয়ে মনে হচ্ছে দ্বিচারিতা চলতে পারে এ ব্যাপারটি নিয়ে৷ কেউ যদি শরীরে পুরুষ হয়, আর মনে নারী হয়, তাহলে বাইরে থেকে পুলিশ কীভাবে চিহ্নিত করবে? সবার পক্ষে খরচ করে হরমোন থেরাপি নিয়ে রূপান্তরিত হওয়া সম্ভব নয়৷''   

সংরক্ষণ থাকা নিয়েও কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন৷ অনেকেই প্রশ্ন করছেন, সারা কলকাতায়, বিশেষ করে মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ি কালীঘাট এলাকাতেই যাঁরা ভিক্ষা করেন, তারা সবাই কি বৃহন্নলা? সেখানে নারী, বৃদ্ধ, শিশু, প্রতিবন্ধী নেই? তাহলে তাঁদের জন্য সৌন্দর্যায়নের সমস্যা হয় না৷ সমস্যা কেবল বৃহন্নলাদের জন্যই?

ভারতের আইনে ভিক্ষাবৃত্তি অপরাধ নয়৷ আর যাঁদের ন্যূনতম স্বাস্থ্য পরিষেবা নেই, যোগ্যতা অনুযায়ী সম্মান নেই, তাঁদের জন্য আর কিছু ভাবনা নেই প্রশাসনের? কতজনকে সিভিক পুলিশ হিসাবে নিয়োগ দেবে প্রশাসন? সেই প্রশ্ন তোলেন কবিরাগ৷ তিনি বলেন, ‘‘আমি কেতকী হয়ে চাকরি খুঁজলে এখনই চাকরি পেয়ে যাবো৷ কিন্তু আমি কবিরাগ, একজন রূপান্তরিত পুরুষ হয়েই চাকরির চেষ্টা চালিয়ে যাবো৷ নিজের অস্তিত্বকে বিসর্জন দেবো না৷''

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য
স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ