তাঁরা মানে জামা-কাপড়ের ক্রেতা৷ সারা বিশ্বের অনেক ক্রেতাই জানতে চাইছেন তাঁদের পোশাক কোথায়, কোন পরিস্থিতিতে তৈরি হয়েছে৷ আর এ জন্য বিভিন্ন ব্র্যান্ডের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছেন তাঁরা৷
বিজ্ঞাপন
টুইটারে ‘হু মেড মাই ক্লোদস' হ্যাশট্যাগ (#WhoMadeMyClothes) ব্যবহার করে এর উত্তর জানতে চান পোশাকের ক্রেতারা৷ ‘ফ্যাশন রেভ্যুলেশন' নামের একটি সংস্থা এই হ্যাশট্যাগ চালু করেছে৷ এর মাধ্যমে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডকে তাদের পোশাক কোথায়, কোন পরিস্থিতিতে তৈরি হচ্ছে সে ব্যাপারে খোঁজ নিতে উৎসাহী করে তুলতে চায় সংস্থাটি৷ সেটা সম্ভব হলে পোশাক তৈরিতে শ্রমিকদের অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে কিনা, তাঁদের জীবন ঝুঁকির মুখে কিনা, তা জানা যাবে৷
ফ্যাশন রেভ্যুলেশন সংস্থার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ক্যারি সমার্স বলেন, ‘‘কোথায় পোশাক তৈরি হচ্ছে, কে করছেন আর কোন পরিস্থিতিতে করছে – এই তথ্যগুলো না জানলে কোম্পানিগুলোর পক্ষে তাদের পোশাক তৈরিতে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে কিনা, তা জানা সম্ভব নয়৷''
বাংলাদেশে ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ধসে এক হাজারেরও বেশি পোশাক শ্রমিকের প্রাণহানির ঘটনা সারা বিশ্বে আলোচিত হয়েছে৷ এর প্রেক্ষিতে পোশাক কারখানায় কাজের পরিবেশ ও শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে বেশ কিছু উদ্যোগ নেয়া হয়েছে৷
ফিরে দেখা: আগুন, ভবন ধসে ক্ষতিগ্রস্ত পোশাক খাত
বাংলাদেশে তৈরি পোশাক ইউরোপ, অ্যামেরিকার প্রায় সব শপিং মলেই পাওয়া যায়৷ পোশাক খাত বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকা শক্তি৷ আর এই খাত যেসব দুর্ঘটনায় ক্ষতির মুখে পড়েছে সেগুলো থাকছে এই ছবিঘরে৷
ছবি: Reuters
২৫.০২.২০১০: ‘গারিব এন্ড গারিবে’ আগুন
সুইডেনের একটি জনপ্রিয় ফ্যাশন চেইনের জন্য কাপড় তৈরি করার সময় আগুনে প্রাণ হারান গারিব এন্ড গারিব ফ্যাক্টরির কমপক্ষে ২১ শ্রমিক৷ নিহতদের মধ্যে ১৩ জন ছিলেন নারী আর কারখানাটি ছিল গাজীপুরে৷
ছবি: Imago/Xinhua
১৪.১২.২০১০: দ্যাটস ইট স্পোর্টসওয়ারে আগুন
সে আগুন প্রাণ হারান কমপক্ষে ২৯ ব্যক্তি, আহত অন্তত ২০০৷ হাম্মিম গ্রুপের কারখানাটি আধুনিক ভবনে অবস্থিত হলেও অভিযোগ রয়েছে অগ্নি নির্বাপকের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা তাতে ছিল না৷ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ব্র্যান্ডের পোশাক উৎপাদন হতো কারখানাটিতে৷ (ফাইল ফটো)
ছবি: picture-alliance/AP
২৪.১১.২০১২: তাজরীন ফ্যাশনসে আগুন
ঢাকার অদূরে আশুলিয়ায় তাজরীন ফ্যাশন ফ্যাক্টরিতে অগ্নিকাণ্ডে নিহত কমপক্ষে ১১২, আহত কয়েকশত৷ নয় তলা ভবনটিতে আগুন লাগার পর অনেক পোশাক কর্মী লাফিয়ে পড়তে গিয়েও প্রাণ হারান৷ কেউ কেউ হয়েছেন জীবন্ত দগ্ধ৷ ভবনটির জরুরী বাইরে যাওয়ার গেটগুলো হয় বন্ধ ছিল, অথবা ব্যবহার অনুপযোগী ছিল৷
ছবি: picture-alliance/dpa
তাজরীনের মালিকের বিচার শুরু
আশার কথা হচ্ছে, তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় প্রতিষ্ঠানটির মালিক ও তাঁর স্ত্রীসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে বিচার শুরু হয়েছে৷ ঢাকার একটি আদালতে বিচার কাজ চলছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
১৪.০৪.২০১৩: রানা প্লাজা ধস
ঢাকার অদূরে সাভারে রানা প্লাজা ভবন ধসে প্রাণ হারান কমপক্ষে ১,১৩৮ ব্যক্তি, আহত কয়েক হাজার৷ ইতিহাসের অন্যতম বড় দুর্ঘটনা এটি৷ রানা প্লাজা ধসে ক্ষতিগ্রস্তরা এখনো ন্যায্য ক্ষতিপূরণ পাননি৷ এই ঘটনায় দায়ীদের বিচার নিয়েও গড়িমসি চলছে৷
ছবি: Reuters
০৯.০৫.২০১৩: মিরপুর টেক্সটাইল ফ্যাক্টরিতে আগুন
মিরপুরে পোশাক কারখানায় আগুনে নিহত হয় কমপক্ষে আট ব্যক্তি৷ সেই ঘটনায় পোশাক কারখানাটির বাংলাদেশ অংশের প্রধান এবং একজন পুলিশ কর্মকর্তাও প্রাণ হারান বলে দাবি করেছে, পোশাক রপ্তানিকারকদের প্রতিষ্ঠান বিজিএমইএ৷ দ্রষ্টব্য: গ্যালারিটি তৈরিতে ক্লিন ক্লোদস ক্যাম্পেইন থেকে তথ্য নেয়া হয়েছে৷ (ফাইল ফটো)
ছবি: Reuters
6 ছবি1 | 6
ফ্যাশন রেভ্যুলেশন সংস্থাটিও এমন এক উদ্যোগ৷ রানা প্লাজা ধসের পর এটি গড়ে তোলেন সাবেক দুই পোশাক ডিজাইনার ক্যারি সমার্স এবং ওর্সোলা দে কাস্ত্রো৷
২০১৪ সাল থেকে রানা প্লাজা ধসের দিনকে (২৪ এপ্রিল) ‘ফ্যাশন রেভ্যুলেশন দিবস' হিসেবে পালন করছে সংস্থাটি৷ গত বছর এই দিনকে ঘিরে হ্যাশট্যাগটি চালু করা হয়৷ সে সময় ৭৬টি দেশের সোয়া ছয় কোটিরও বেশি মানুষ হ্যাশট্যাগটি ব্যবহার করেন বলে জানান কাস্ত্রো৷
চলতি বছর ১৮ এপ্রিল থেকে ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত ‘ফ্যাশন রেভ্যুলেশন সপ্তাহ' পালন করা হচ্ছে৷ এবারও টুইটার ব্যবহারকারীরা #WhoMadeMyClothes হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে তাঁদের ব্র্যান্ডের কাছে উত্তর জানতে চাইছেন৷ ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সাংসদরাও আছেন এর মধ্যে৷
ভিডিও প্রচারণা
ফ্যাশন রেভ্যুলেশন সংস্থা ২০১৫ সালে জার্মানির বার্লিনে একটি ভেন্ডিং মেশিন স্থাপন করে সেখান থেকে ২ ইউরো মূল্যের টি-শার্ট বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছিল৷ তবে পোশাক কেনার জন্য ক্রেতারা যখন মেশিনে পয়সা ঢুকিয়েছিল তখন তাদের কয়েকটি তথ্য ও ছবি দেখানো হয়৷ তাদের জানানো হয় দুই ইউরো দিয়ে পোশাক বিক্রির জন্য শ্রমিকদের কীভাবে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে৷ এরপর ক্রেতাদের কাছে জানতে চাওয়া হয় তারা পোশাকটি এখনও কিনতে চায় কিনা৷ ১০ জনের মধ্যে আট জনই ‘না' বলেন৷ পুরো বিষয়টি ভিডিও করে ইউটিউবে আপলোড করা হয়৷ ভিডিওর শেষে বক্তব্যটি ছিল এরকম – মানুষ যখন জানতে পারে তখন তারা সচেতন হয়৷
চলতি বছরের ফ্যাশন রেভ্যুলেশন সপ্তাহকে ঘিরে আরও একটি প্রচারণামূলক ভিডিও প্রকাশ করেছে সংস্থার নেদারল্যান্ডস শাখা৷ এতে দেখা যাচ্ছে, ১২ বছরের একটি শিশু রাস্তায় বিভিন্ন জনকে প্রশ্ন করছে যে, তাঁরা জানেন কি না তাদের পরনের পোশাকটি কোথায়, কোন পরিস্থিতিতে তৈরি হয়েছে৷ বাকিটা দেখুন ভিডিওতে৷
বন্ধু, আপনি কি জানেন আপনার পোশাক কে বা কারা বানিয়েছেন? লিখুন আমাদের, নীচের ঘরে৷
রানা প্লাজার বিভীষিকার কথা জার্মানরা ভোলেনি...
বন শহরে ছোট্ট একটা জমায়েত৷ উদ্দেশ্যটা কিন্তু বড় এবং মহৎ৷ আয়োজকরা চান, বাংলাদেশের আর কোনো পোশাক কারখানায় যেন মৃত্যুর বিভীষিকা নেমে না আসে৷ সেই লক্ষ্যে সচেতনতা বাড়াতেই ‘স্বচ্ছ কাপড়’-এর দাবি নিয়ে হাজির হয়েছিল ফেমনেট৷
ছবি: DW/A. Chakraborty
ক্ষতিপূরণ এবং ন্যায্য মূল্য দাও
রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি তৈরি পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের দুরবস্থা সম্পর্কে ইউরোপকেও সজাগ করেছে৷ বাড়ছে সবার মাঝে সচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগ৷ ‘ফেমনেট’ নামের সংগঠনটি সেই লক্ষ্য নিয়েই কাজ করছে৷ জার্মান কোম্পানিগুলো যাতে বাংলাদেশ থেকে কাপড় কেনার সময় ‘ন্যয্য’ দাম দেয় এবং এর মাধ্যমে যাতে শ্রমিকদের দুর্ভোগ কমানোয় ভূমিকা রাখে – এই দাবি তুলছে তারা৷ বুধবার বন শহরে আয়োজিত সমাবেশেও তোলা হয়েছে এই দাবি৷
ছবি: DW/A. Chakraborty
কারা আপনার পোশাক তেরি করছে তা কি জানেন?
দর্শকদের জন্য স্ট্যান্ডে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে বাংলাদেশে তৈরি পোশাকের কিছু নমুনা৷ পোশাকের সঙ্গে সাদা কাগজে বড় করে লেখা হয়েছে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের জার্মান ক্রেতা কোম্পানিগুলোর নাম৷ এমন কিছু প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকেই রানা প্লাজার ধসে নিহত, আহতদের জন্য ক্ষতিপূরণ এবং পোশাকের ন্যায্য মূল্য দাবি করেছে ফেমনেট৷ কাপড়ের স্ট্যান্ডটির অদূরে একটি ব্যানার, তাতে লেখা, ‘কারা আপনার পোশাক তেরি করছে তা কি জানেন?’
ছবি: DW/A. Chakraborty
বন্ধুর হাত....
কফিনের কাপড় দিয়ে তৈরি ‘বডি ব্যাগ’৷ বুধবারের সমাবেশে মৃতদেহ বহনের কাজে লাগে এমন কিছু ব্যাগও ছিল৷ বাংলাদেশের শ্রমিকরা ন্যায্য মজুরি, স্বাস্থ্যসম্মত এবং নিরাপদ কাজের পরিবেশ পায় না৷ অনেক সময় কাজ করতে গিয়ে লাশ হতে হয় তাদের৷ ‘বডি ব্যাগ’-এ হাতের ছাপ দিয়ে রানা প্লাজা ট্র্র্যাজেডিতে নিহতদের স্মরণ এবং পোশাক শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের দাবি করা হলো৷
ছবি: DW/A. Chakraborty
সহমর্মী...
স্থানীয় সাংবাদিকদের একজন দায়িত্ব পালন শেষে নিজের হাতদুটোও রংয়ে রাঙালেন৷ ‘বডি ব্যাগ’-এ হাতের ছাপ দিয়ে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের কর্মীদের পাশে দাঁড়াতে হবে যে! ‘ক্লিন ক্লথ’ অর্থাৎ স্বচ্ছ পোশাক কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছে ফেমনেট৷ তাদের সঙ্গে আরো রয়েছে খ্রিশচান ইনিশিয়েটিভ রোমেরো, ইনকোটা-নেটওয়ার্ক এবং স্যুডভিন্ড ফাউন্ডেশন নামের তিনটি সংগঠন৷
ছবি: DW/A. Chakraborty
৫ মিলিয়ন ডলার দিতে হবে
স্বেচ্ছাসেবকদের সংগঠন ফেমিনেটের এক কর্মী৷ তাঁর হাতের প্ল্যাকার্ডে লেখা, ‘‘বেনেটন, পাঁচ মিলিয়ন ডলার দাও৷’’ তৈরি পোশাক ক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ের চেষ্টা ইতিমধ্যে সাফল্যের মুখ দেখেছে৷ ‘পার্টনারশিপ ফর সাস্টেনেবল টেক্সটাইল’ নামের একটি জোট তৈরি হয়েছে জার্মানিতে, যারা শ্রমিকদের স্বার্থকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়৷
ছবি: DW/A. Chakraborty
চলতে চলতে ছবি তোলা...
পোশাক কারখানার মালিকরা কম মজুরি দিয়ে যে পোশাক তৈরি করে, বিদেশি ক্রেতারা কম দামে যে কাপড় কেনে তাতে তো শ্রমিকের কষ্টের অদৃশ্য কালি লেগেই থাকে! সেই কালিমুক্ত কাপড়ের দাবি পূরণ করতে ফেমিনেট-এর এই ‘স্বচ্ছ কাপড়’ ক্যাম্পেন৷ তাদের সমাবেশের পাশ দিয়ে যাবার সময় ব্যস্ত পথচারীরা থমকে দাঁড়াচ্ছিলেন৷ কাজের তাড়া ছিল বলে যাঁরা বেশিক্ষণ থাকতে পারেননি তাঁদের অনেকেই যাবার আগে ছবি তুলে স্মৃতি রেখে দিতে ভুল করেননি৷