একেবারে ছোটবেলার কথা৷ বাসায় একাধিক কাজের লোক ছিলেন৷ পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য বাবাকে যেতে হতো বহুদূর৷ ছয় ভাইবোনের বিরাট সংসার সামলাতে মা'কে সাহায্য করতে আসতেন তাঁরা৷
বিজ্ঞাপন
একজন আয়ার দায়িত্ব ছিল আমাকে আর আমার পিঠাপিঠি বড় ভাইয়ের দেখাশোনা করা৷ তাঁকে আমরা ‘আইয়া' বলে ডাকতাম৷ যতটুকু মনে পড়ে, তিনি যখন চলে যান তখন আমার খুব মন খারাপ হয়েছিল৷ আমি বলতাম, ‘‘আইয়ার জন্য পরান পুড়ে৷''
এরপর অনেক কাজের লোক এসেছেন আমাদের বাসায়৷ তাঁদের সবার মধ্যে একটা বিষয় খুব কমন ছিল৷ তা হলো, তাঁরা সবাই আমার মা'কে খুব ভালোবাসতেন৷ তাঁরা কাজ ছেড়ে দিয়ে চলে গেলেও বারবার এসেছেন মায়ের কাছে৷ এমনকি আমার মা মারা যাবার পরও অনেকে এখনো আমাদের বাড়িতে আসেন৷ আমার মায়ের জন্য তাঁরা মন খারাপ করেন৷
আসলে বাড়িতে যখন কোনো কাজের লোক অনেকদিন থাকেন, তখন অজান্তেই তাঁরাও পরিবারের সদস্য হয়ে যান৷ অনেকের ভিন্নরকমের অভিজ্ঞতা আছে৷ কিন্তু আমাদের বাড়িতে অভিজ্ঞতা কম-বেশি অনেকটা এমনই ছিল৷ এমনকি যেসব নারীর শিশু সন্তান ছিল, তাঁরা সেই সন্তানকেও নিয়ে আসতেন৷ সেই শিশুরাও আমাদের বাড়ির সদস্য হয়ে যেতো৷
অনেক মজার স্মৃতিও থাকে এদেরকে নিয়ে৷ একটা ঘটনা বলি৷ স্কুলের পর ঢাকায় পড়াশুনা করতে আসি৷ থাকি বোনের বাসায়৷ সেখানেও এক বুয়া বহু বছর ধরে কাজ করতেন৷ তাঁকেও দেখেছি ঠিক বাড়ির লোকদের মতোই আচরণ করতে৷ বয়স্ক হলেও সেই বুয়া ছিলেন নায়ক মান্নার বিরাট ভক্ত৷
একবার হলো কি, চ্যানেল ঘোরাতে ঘোরাতে দেখি মান্না অভিনীত কোনো এক চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হচ্ছে কোনো এক চ্যানেলে৷ আমি চ্যানেলের সাউন্ড বাড়িয়ে দিলাম৷ কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে বুয়া হাজির দরজার সামনে৷ স্ক্রিনে তখন মান্নার ফাইটিং দৃশ্য৷ মান্না তাঁর দিগ্বিজয়ী অ্যাকশনে ঘায়েল করছেন সব শত্রুকে৷ কিছুক্ষণ পর দেখি বুয়া নিচু কণ্ঠে বলছেন, ‘‘মার, মার অরে৷'' তাকিয়ে দেখি, তিনি খুব সিরিয়াস৷ হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ি৷
বহুবার এমন হয়েছে, বুয়া তাঁর বাড়িতে রান্না করা খাবার নিয়ে এসেছেন আমাদের জন্য৷ তাঁর এই যে বাড়তি ভালোবাসা, তা কোনোভাবেই মাস গেলে বেতন দিয়ে মাপা সম্ভব নয়৷
আমি বলছি না, সবার অভিজ্ঞতা এক হবে৷ কিন্তু এই কাজের লোকগুলোই অনেক সময় পরিবারের গুরুদায়িত্ব পালন করেন৷ এমন অনেক সময় হয়েছে যে, বাড়ি তাঁদের ওপর পুরোপুরি ছেড়ে যেতে হয়েছে৷ আমার পরিবারের অভিজ্ঞতা হলো, তাঁরা খুব ভালোভাবেই তাঁদের দায়িত্ব পালন করেছেন৷
বলছি না যে, সবার অভিজ্ঞতা এক হয়৷ অনেকেরই কাজের লোক নিয়ে বিব্রতকর অভিজ্ঞতাও হয়েছে৷ এছাড়া এখন সময় বদলেছে৷ কাজের লোকদের চাহিদা বেড়েছে৷ বেড়েছে তাঁদের ব্যস্ততা৷ এখন সবাই খুব পেশাদার৷ তাই কাজের লোকদের সঙ্গে সেই যে পারিবারিক সম্পর্ক তৈরি হওয়ার সুযোগ, তা-ও সংকুচিত হয়ে গেছে৷ তবে পুরোপুরি পেশাদার হওয়াও ভালো৷
আমাদের সমাজে বাড়ির লোকদের কাজকে ‘কাজ' হিসেবে মূল্যায়ণ করা হয় না৷ তাই কাজের বুয়াদের কাজকেও শ্রমের প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়া হয় না৷ যে যার যার মতো করে বেতন দেন৷ শুধু মাস শেষে বেতন আর উৎসবে কিছু উপরি৷ এর বাইরে বুয়াদের শ্রমের কোনো কাঠামো না থাকার ফলে কাজের প্রশিক্ষণেরও সুযোগ নেই৷
তবে ইদানিং কিছু এজেন্সির মতো প্রতিষ্ঠান কাজের লোক সরবরাহ করে থাকেন৷ এটি ভালো উদ্যোগ৷ এই উদ্যোগকে আরো পেশাদার পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে৷ তবে সবার মঙ্গল হবে৷
বিশ্বজুড়ে গৃহকর্মীদের অধিকার
গৃহকর্মকে এশিয়া ও আফ্রিকার বেশিরভাগ দেশেই অন্যান্য কাজের সমান মর্যাদা দেয়া হয় না৷ কর্মীর কর্মঘণ্টা, জীবনযাত্রার মান, বেতনও নির্ধারণ হয় না সঠিকভাবে৷ অধিকার রক্ষায় নেই সরকারি কোনো উদ্যোগও৷
ছবি: DW/M. Mostafigur Rahman
বাংলাদেশ
পশ্চিমা বিশ্ব এখন ঘরের কাজে রোবট ব্যবহারের দিকে ঝুঁকছে৷ এই নিয়ে চলছে বিস্তর গবেষণা৷ তবে বাংলাদেশের পরিস্থিতি ভিন্ন৷ সেদেশে ঘরের কাজের জন্য অধিকাংশ বাড়িতে রয়েছেন গৃহকর্মী৷ যাঁদের মাসিক গড় বেতন ৫১০ টাকা৷ আর দিনে কাজ করতে হয় কমপক্ষে দশ ঘণ্টা৷
ছবি: imago/imagebroker
তানজানিয়া
তানজানিয়ায় গৃহকর্মীদের রক্ষায় বিশেষ কোনো আইন নেই৷ ব্যবসা ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রমিকদের জন্য যে আইন, সেটি তাঁদের জন্যও প্রযোজ্য৷ অল্পবয়সি নারীরাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেশটিতে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করে থাকেন৷ তাদের বেতনও সর্বনিম্ন বেতনের চেয়ে কম৷ আইন অনুযায়ী গৃহকর্মীদের ট্রেড ইউনিয়ন করার সুযোগ থাকলেও সেটি বেশিরভাগ গৃহকর্মীই জানেন না৷
ছবি: Human Rights Watch/Rothna Begum
ফিলিপাইন্স
২০১০ সালের পরিসংখ্যান বলছে, ফিলিপাইন্সে ১৯ লাখ গৃহকর্মীর বয়সই ১৫ বছর বা তার চেয়েও কম৷ এর মধ্যে ৮৫ শতাংশই নারী৷ বেশিরভাগই অর্থের অভাবে পড়াশোনা ছেড়ে কাজে যোগ দিতে বাধ্য হয়েছে৷ কর্মক্ষেত্রেই তাদের নির্যাতনের শিকার হতে হয়৷ ২০১৩ সালে ডমেস্টিক ওয়ার্কার্স অ্যাক্ট পাস করা হলেও অবস্থার তেমন উন্নতি হয়নি৷
ছবি: OM
পাকিস্তান
পাকিস্তানে অনেক ক্ষেত্রে গৃহকর্মীদের শ্রমিক হিসেবেই স্বীকৃতি দেয়া হয় না৷ কিন্তু পাঞ্জাব সরকার একটি ব্যতিক্রমী পদক্ষেপ নিয়ে ২০১৪ সালে চালু করেছে গৃহকর্মী ইউনিয়ন৷ শুরুতে এতে মাত্র ২৩৫ জন সদস্য থাকলেও ধীরে ধীরে এ সংখ্যা বেড়েই চলেছে৷ তবে দেশটির অন্যান্য অঞ্চলে, বা রাষ্ট্রীয়ভাবে এখনও তা চালু হয়নি৷
ছবি: DW/Unbreen Fatima
ভারত
ভারতে গৃহকর্মীদের অনেক ধরনের নির্যাতনের শিকার হতে হয়৷ বিভিন্ন দরিদ্র অঞ্চল ও পরিবার থেকে আসায় শ্রমবাজার সম্পর্কেও তাঁদের ধারণা থাকে কম৷ বেতন বৈষম্য, জীবনযাত্রার নিকৃষ্ট মান, নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টার অভাব ছাড়াও সহিংসতা, যৌন হয়রানি এমনকি মানবপাচারকারীদের শিকারও হতে হয় গৃহকর্মীদের৷ কোনো কোনো ক্ষেত্রে সপ্তাহে ৭ দিনই ১৫ ঘণ্টা করে কাজ করতে হয় তাঁদের৷
ছবি: Reuters/J. Dey
চীন
১৯৭৮ সাল থেকে মুক্তবাজার অর্থনীতিতে প্রবেশ করার পর থেকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন চীনের নারীরা৷ প্রাইভেটাইজেশনের ফলে অনেক নারীর চাকরি চলে গেছে, কমেছে কর্মক্ষেত্রে পাওয়া সুযোগ-সুবিধার হারও৷ নারীদের বেকারত্বের হার কমাতে সরকারি উদ্যোগে গৃহকর্মীদের উৎসাহী করা হয়৷ বর্তমানে দেশটির ৮৫ শতাংশ গৃহকর্মী নারী৷ কিন্তু তাঁদের নানা ধরনের হয়রানির শিকার তো হতে হয়ই, সামাজিকভাবেও গৃহকর্মীদের দেখা হয় বাজে চোখে৷
ছবি: Reuters/J. Lee
সৌদি আরব
সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বেশিরভাগ দেশেই গৃহশ্রমিক আসেন এশিয়া ও আফ্রিকার দরিদ্র দেশগুলো থেকে৷ স্বেচ্ছায় কাজ পরিবর্তনের সুযোগ না থাকায় এবং নিয়মিত সরকারি নজরদারি না থাকায়, বিশেষ করে নারী শ্রমিকদের মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতে হয় ব্যাপকভাবে৷ ব্র্যাকের হিসাব বলছে, ২০১৮ সালে এখন পর্যন্ত সৌদি আরবে নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশ ফেরত এসেছেন প্রায় ১০০০ নারী গৃহকর্মী৷