তাইওয়ান প্রণালীতে মার্কিন যুদ্ধজাহাজ, ক্ষুব্ধ চীন
৬ জানুয়ারি ২০২৩
বৃহস্পতিবার যুক্তরাষ্ট্রের একটি যুদ্ধজাহাজ স্পর্শকাতর তাইওয়ান প্রণালীর মধ্য দিয়ে যাত্রা করে। মার্কিন সামরিক বাহিনী বিষয়টিকে রুটিন কার্যক্রমের অংশ বলে অভিহিত করলেও এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়েছে চীন।
বিজ্ঞাপন
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, মার্কিন যুদ্ধজাহাজ এবং সময়ে সময়ে তার মিত্র ব্রিটেন এবং ক্যানাডার যুদ্ধজাহাজ এই প্রণালীর মধ্য দিয়ে যাত্রা করেছে, যা চীনের ক্রোধের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
এক বিবৃতিতে মার্কিন সামরিক বাহিনী বলেছে, আরলেই বার্ক-শ্রেণির গাইডেড-মিসাইল ডেস্ট্রয়ার চুং-হুন তাইওয়ান প্রণালীর মধ্য দিয়ে যাত্রা করেছে। "তাইওয়ান প্রণালী দিয়ে চুং-হুন যুদ্ধজাহাজের ট্রানজিট মুক্ত ও অবাধ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতিকেই তুলে ধরে,” বিবৃতিতে বলা হয়।
তবে প্রতিক্রিয়া জানাতে দেরি করেনি চীন। ওয়াশিংটনে চীনের দূতাবাসের মুখপাত্র লিউ পেংইউ এক বিবৃতিতে দৃঢ়ভাবে এই পদক্ষেপের বিরোধিতা করেছে এবং যুক্তরাষ্ট্রকে "সমস্যা উস্কে দেয়া, উত্তেজনা বৃদ্ধি করা ও তাইওয়ান প্রণালী জুড়ে শান্তি ও স্থিতিশীলতা নষ্ট করার মত কার্যক্রম অবিলম্বে বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছে”।
বিবৃতিতে বলা হয়, "যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধজাহাজগুলো চলাচলের স্বাধীনতা ভোগের নামে প্রায়ই শক্তি প্রদর্শন করে। এটা এই অঞ্চলকে মুক্ত ও অবাধ রাখার কোন বিষয়ে নয়।"
"চীন সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করবে এবং সব ধরনের হুমকি ও উস্কানির বিরুদ্ধে জবাব দিতে সর্বদা প্রস্তুত থাকবে। একই সাথে নিজ সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতা দৃঢ়ভাবে রক্ষা করবে চীন,” বিবৃতিতে বলা হয়েছে।
তাইওয়ানকে শক্তি দেখালো চীন
00:37
এদিকে চাইনিজ পিপলস লিবারেশন আর্মির ইস্টার্ন থিয়েটার কমান্ডের একজন মুখপাত্র বলেছেন, মার্কিন যুদ্ধজাহাজের চলাচল পর্যবেক্ষণ ও পাহারা দেওয়ার জন্য তারা সৈন্যদের নিয়োজিত করে এবং "সবকিছুই নিয়ন্ত্রণে ছিল”।
তাইওয়ানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, মার্কিন যুদ্ধজাহাজটি প্রণালী দিয়ে উত্তর দিকে যাত্রা করে। তাইওয়ানের বাহিনী জাহাজটির চলাচল পর্যবেক্ষণ করেছে, যা নিতান্তই সাধারণ একটি ঘটনা ছাড়া ভিন্ন কিছু না।
উল্লেখ্য, ১৯৪৯ সালে প্রজাতন্ত্রী চীন সরকার কমিউনিস্টদের সাথে গৃহযুদ্ধে হেরে তাইওয়ানে পালিয়ে যাওয়ার পর গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠা হয়। তখন থেকেই তাইওয়ান প্রণালী সামরিক উত্তেজনার একটি বিষয় হয়ে উঠে।
তাইওয়ানের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনও আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই, তবে দ্বীপটিকে আত্মরক্ষা করতে সাহায্য করার জন্য আইনত বাধ্য।
চীন তাইওয়ানকে মুল ভূখণ্ডের অংশ হিসেবে দাবী করে আসছে। নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে চীন কখনোই শক্তি প্রয়োগের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়নি। তবে আক্রমণ করা হলে নিজেকে রক্ষা করার জন্য তাইওয়ান প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তাইওয়ান বলেছে, গণপ্রজাতন্ত্রী চীন কখনো দ্বীপটি শাসন করেনি, তাদের দাবী তাই ভিত্তিহীন।
চীন, অ্যামেরিকা, তাইওয়ানের দীর্ঘ জটিল সম্পর্ক
পেলোসির সফর ঘিরে চীন, তাইওয়ান এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে এখন উত্তেজনা তুঙ্গে। এই তিন দেশের দীর্ঘ সম্পর্কের ইতিহাস যথেষ্ট জটিল।
ছবি: Rod Lamkey/CNP/picture alliance--Shen Hong/picture alliance/Xinhua
দুই দেশের জন্ম
১৯৪৯ সালে চীনের সিভিল ওয়ারের পর দুইটি স্বঘোষিত চীনা রাষ্ট্রের জন্ম হলো। পিপলস রিপাবলিক অফ চায়না(পিআরসি) বা গণপ্রজাতন্ত্রী চীন এবং তাইওয়ান ভিত্তিক রিপাবলিক অফ চায়না(আরওসি)। পিআরসি-র ঘোষণা হলো বেজিংয়ে, করলেন মাও জেদং। উপরের ছবিটি মাওয়ের।
ছবি: AP
দীর্ঘদিনের স্থিতাবস্থা
পিআরসি-র নিয়ন্ত্রক হলো চীনা কমিউনিস্ট পার্টি। কিন্তু তাইওয়ানের ক্ষেত্রে তাদের কোনো নির্দেশ চলে না। তাইওয়ানের শাসকরা ১৯৯০ থেকে গণতান্ত্রিক পথে ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হন। তাদেরও পিআরসি-র উপর কোনো প্রভাব নেই। বহুদিন ধরে এই স্থিতাবস্থা চলেছিল। উপরের ছবিটি তাইওয়ান খাঁড়িতে তাদের নৌবহরের।
ছবি: AP
অবস্থার পরিবর্তন
২০০৫ সালে অবস্থার পরিবর্তন হলো। চীন বিচ্ছিন্নতা-বিরোধী আইন পাস করলো। সেখানে বলা হলো, তাইওয়ান যদি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করে, তাহলে চীনের সেনার সেখানে গিয়ে হস্তক্ষেপ করার অধিকার আছে। এরপর চীন ও তাইওয়ানের মধ্যে উত্তেজনা আরো বাড়লো।
ছবি: Roman Pilipey/AP/picture alliance
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি
১৯৭০-এর প্রথমভাগ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক স্তরে তাইওয়ানের পরিচিতি ছিল রিপাবলিক অফ চায়না হিসাবে। কিন্তু ১৯৭১ সালে জাতিসংঘে ভোটাভুটি হলো এই নিয়ে যে, পিআরসি বা গণপ্রজাতন্ত্রী চীনই একমাত্র সেখানে থাকবে। এরপর ভ্যাটিকান-সহ মাত্র ১৪টি দেশ তাইওয়ানকে স্বীকৃতি দেয়। উপরের ছবিটি তাইওয়ানের পার্লামেন্টের।
ছবি: Daniel Ceng Shou-Yi/ZUMA Wire/picture alliance
অ্যামেরিকার সিদ্ধান্ত
১৯৭৯ সালে অ্যামেরিকা জানায়, তারা একমাত্র গণপ্রজাতন্ত্রী চীনকেই স্বীকৃতি দিচ্ছে। কিন্তু মার্কিন কংগ্রেসে তাইওয়ান রিলেশনস আইন পাস হয়। সেখানে বলা হয়েছে, তাইওয়ানকে অস্ত্র বিক্রি করে যাবে অ্যামেরিকা। ওই অঞ্চলে শান্তি বজায় রাখতে অ্যামেরিকা দায়বদ্ধ থাকবে। উপরের ছবিটি তাইওয়ানের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেওর।
ছবি: TAIWAN PRESIDENTIAL OFFICE/REUTERS
মার্কিন পার্লামেন্ট সদস্যদের মত
দলমত নির্বিশেষে মার্কিন পার্লামেন্ট সদস্যরা মনে করেন, তাইওয়ান যেন বেজিংয়ের কাছে আত্মসমর্পন না করে। ঠান্ডা যুদ্ধের সময়, অ্যামেরিকা ও তাইওয়ান হাত মিলিয়ে কমিউনিস্ট চীনের বিরোধিতা করেছে। চীনের যত উত্থান হয়েছে, অ্যামেরিকা ততই তাইওয়ানের পাশে থেকেছে।
ছবি: Artur Gabdrahmanov/Sputnik/dpa/picture alliance
পেলোসির সফর
মার্কিন হাউস অফ রিপ্রেজেন্টেটিভসের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি তাইওয়ানে গিয়ে বলেছেন, ''আমাদের প্রতিনিধিদল তাইওয়ান এসে একটা কথা স্পষ্ট করে দিতে চায়, তা হলো, আমরা কখনোই তাইওয়ানকে পরিত্যাগ করব না। আমাদের দীর্ঘ সম্পর্ক নিয়ে আমরা গর্বিত।''
ছবি: Ann Wang/REUTERS
চীনের দাবি
চীন দাবি করে, তাইওয়ান তাদের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাই তারা বারবার 'ওয়ান চায়না' বা 'এক চীন' নীতির কথা বলে। যেভাবে হংকং এখন চীনের অংশ, সেইভাবেই তাইওয়ানকেও নিজেদের অংশ করতে চায় চীন। কিন্তু তাইওয়ানের বক্তব্য, হংকংয়ের ক্ষেত্রে দুই তরফই তাতে রাজি ছিল। কিন্তু তাইওয়ান কখনোই চীনের সঙ্গে মিশে যেতে রাজি নয়। তারা আলাদা অস্তিত্ব বজায় রাখতে চায়। উপরের ছবিটি চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের।
ছবি: Selim Chtayti/REUTERS
জনগণ বিভক্ত
চীনের সঙ্গে মিশে যাওয়া নাকি স্বাধীনতা ঘোষণা, কোনটা করা উচিত, তানিয়ে তাইওয়ানের সাধারণ মানুষ বিভক্ত।
ছবি: Ann Wang/REUTERS
অনড় চীন
তাইওয়ান সরকার এখন নিজেদের আইল্যান্ড অফ তাইওয়ান বলে। এতে চীনের প্রবল আপত্তি। তাদের দাবি, আগের মতো রিপাবলিক অফ চীন বলা উচিত। বেজিং তাইওয়ানের আলাদা জাতীয় সংগীত ও পতাকাও মানে না। উপরের ছবিতে তাইওয়ানের পতাকা।