তাজপুরে গভীর সমুদ্রে বন্দর প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে কবে?
৫ ডিসেম্বর ২০২৫
রাজ্য সরকার পূর্ব মেদিনীপুরের তাজপুরে গভীর সমুদ্র বন্দর তৈরির জন্য নতুন করে আন্তর্জাতিক টেন্ডার ডেকেছে। ১ ফেব্রুয়ারি থেকে দরপত্র জমা নেওয়া শুরু হবে।
নয়া টেন্ডার
নতুন টেন্ডারে আগের বেশিরভাগ শর্তই অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। সরকার আশ্বাস দিয়েছে যে, বন্দর ও শিল্প প্রকল্পের জন্য হাজার একর জমি দেওয়া হবে এবং সেই জমির উপরে নিয়ন্ত্রণ থাকবে প্রকল্প রূপায়ণকারী সংস্থারই।
নতুন টেন্ডারে বলা হয়েছে—বন্দরের নকশা, নির্মাণ, অর্থ সংগ্রহ ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নেওয়ার অভিজ্ঞতা আছে এমন সংস্থাই দরপত্র জমা দিতে পারবে। আট হাজার কোটি টাকার মতো বড় বন্দর প্রকল্পে কাজের অভিজ্ঞতাও থাকতে হবে। এই প্রকল্পে রেল ও সড়ক যোগাযোগ গড়ে তুলতেও রাজ্য সরকার সহায়তা করবে সংস্থাটিকে।
আগের টেন্ডারে আদানি গোষ্ঠী বাজিমাত করলেও পরে পুরো প্রক্রিয়া বাতিল হয়ে যায়। এখন নতুন করে টেন্ডার ডাকা হয়েছে। টেন্ডার ঘোষণার পরে জল্পনা তৈরি হয়েছে যে, আগের মতবিরোধ ভুলে আদানি গোষ্ঠী আবার এই প্রকল্পে আগ্রহ দেখাতে পারে। বিশেষত মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে গোষ্ঠীর কর্ণধার গৌতম আদানির সাক্ষাতের পরে। যদিও এ বিষয়ে সরকারিভাবে কিছু জানানো হয়নি।
আগের টেন্ডার বাতিল
তাজপুরে গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল আদানি গোষ্ঠীকে। কেন্দ্রীয় সরকারের স্বরাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা, বিদেশ ও জাহাজ মন্ত্রকের পরীক্ষায় প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণ করতে না পারায় এই গোষ্ঠীকে দেয়া ‘লেটার অফ ইনটেন্ট’ বাতিল করে দেয় রাজ্য সরকার।
পূর্ব মেদিনীপুরের তাজপুরে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে গ্রিনফিল্ড প্রযুক্তিতে গভীর সমুদ্র বন্দর তৈরির পরিকল্পনা করেছিল রাজ্য সরকার। একই সঙ্গে পরিকাঠামো নির্মাণে আরও ১০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের কথা ছিল।
প্রথম গ্লোবাল টেন্ডার ডাকা হয় ২০২০ সালের অক্টোবরে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে জমা হওয়া দরপত্রের ভিত্তিতে আদানি পোর্টস অ্যান্ড স্পেশাল ইকনমিক জোন প্রকল্প রূপায়ণের বরাত পায়। সেই বছরে অক্টোবরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আদানি গোষ্ঠীর হাতে লেটার অফ ইনটেন্ট তুলে দেন। কিন্তু এরপরও প্রকল্পে অগ্রগতি হয়নি।
সূত্রের দাবি, লেটার অফ ইনটেন্ট পাওয়ার পরে কেন্দ্রীয় চার মন্ত্রকের ছাড়পত্র চাওয়া হয়। কিন্তু আদানি গোষ্ঠী সামগ্রিক শর্ত পূরণ না করায় অনুমোদন মেলেনি। তাই সরকার সিদ্ধান্ত নেয়, এই প্রকল্প এই গোষ্ঠীর হাতে রাখা সম্ভব নয়। রাজ্যের তরফে আদানিদের জানানো হয় যে, কেন্দ্রীয় ছাড়পত্র না পাওয়ার কারণেই আগের টেন্ডার বাতিল করা হয়েছে।
হিন্ডেনবার্গ ফ্যাক্টর
এই পরিস্থিতির নেপথ্যে আরও একটি কারণ উল্লেখযোগ্য। ২০২৩ সালে হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পরে আদানি গোষ্ঠীকে নিয়ে বিভিন্ন অভিযোগ ওঠায় প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়।
এর পাশাপাশি ওড়িশার ধামরা ও পারাদ্বীপ, দুটি বড় বন্দর আগেই আদানি গোষ্ঠীর হাতে থাকায় তাজপুর প্রকল্পে তাদের আগ্রহ কতটা থাকবে, তা নিয়েও জল্পনা চলছিল। একই সঙ্গে এই প্রকল্পে এক লক্ষ কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হওয়া কতটা সম্ভব, তা নিয়ে সংশয় ছিল।
এত বড় প্রকল্প তৈরির জন্য ব্যাপক আকারে পরিকাঠামো তৈরি করার প্রয়োজন রয়েছে। সে দিক থেকেও সমস্যা রয়েছে।
তাজপুর থেকে রেলের দূরত্ব নয় কিলোমিটার এবং হাইওয়ের দূরত্ব পাঁচ কিলোমিটার। এই দুই এলাকার মধ্যে বিস্তীর্ণ জনবসতি থাকায় জমি অধিগ্রহণের প্রয়োজন হতো, যা রাজ্যের নীতি-বিরোধী। পুনর্বাসন করা গেলেও বিপুল কর্মসংস্থানের দাবি নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছিল।
এসব কারণ মিলিয়েই রাজ্য সরকার আদানি গোষ্ঠীকে প্রকল্প থেকে সরিয়ে নতুন দরপত্রের মাধ্যমে তাজপুর বন্দর গড়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন
নির্বাচনের ঠিক আগে নতুন করে টেন্ডার ডাকার এই সিদ্ধান্ত নিয়ে অর্থনীতি ও রাজনীতির বিশেষজ্ঞদের প্রতিক্রিয়া মিশ্র।
অর্থনীতিবিদ অশোক লাহিড়ী এই দীর্ঘসূত্রিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁর মতে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জন্য একটি আধুনিক বন্দর পশ্চিমবঙ্গের জন্য অত্যন্ত জরুরি, যেখানে অন্যান্য উপকূলবর্তী রাজ্য এই সুবিধা কাজে লাগিয়ে শিল্প কেন্দ্র গড়ে তুলেছে।
তিনি ডিডাব্লিউকে বলেন, "বহু বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গকে জব চার্নকের আমলের কলকাতা বন্দরের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে, যা বর্তমানে অচল। তাজপুর বা সাগর বন্দরের মতো প্রকল্পের কথা শোনা গেলেও, ১৫ বছর ধরে কিছুই হয়নি। এই পরিস্থিতিতে নির্বাচনের ঠিক আগে আবার নতুন করে দরপত্র হাঁকাটা কতটা লোক দেখানো বা কতটা সত্যি, তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়।"
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক রাজাগোপাল ধর চক্রবর্তী মনে করেন, রাজ্যের বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকারি দুর্নীতির কারণে চাকরি হারানোর যে ব্যাপক হতাশা, তার বিপরীতে শুধু টেন্ডারের ঘোষণা খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ হবে না।
তিনি ডিডাব্লিউকে বলেন, "তাজপুর গভীর সমুদ্রিক বন্দর এবং দেউচা পাঁচামি কয়লা খনি— এই দুটি বৃহৎ প্রকল্পে দীর্ঘদিন ধরে কর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রতিশ্রুতি দেয়া হলেও নানা কারণে বাস্তবায়নে বিশেষ এগোতে পারেনি। তাজপুর বন্দরের ক্ষেত্রে আদানি গোষ্ঠী বিনিয়োগকারী হিসেবে এলেও বন্দরের বাণিজ্যিক সম্ভাবনা এবং পার্শ্ববর্তী পরিকাঠামোর অভাবে তারা খুব একটা আগ্রহ দেখায়নি, যদিও পশ্চিমবঙ্গ সরকার অর্থনৈতিক অগ্রগতির আশায় তাদের স্বাগত জানিয়েছিল। মানুষ শুধু টেন্ডার নয়, চাকরি হচ্ছে, এই দৃশ্য দেখতে চায়। বেকার যুবসমাজ একটি ভদ্রস্থ কর্মসংস্থান চায়। তাই নির্বাচনের উপর এই পদক্ষেপ কোনো বড়সড় প্রভাব ফেলবে বলে আমি মনে করি না।"
সাংবাদিক শুভাশিস মৈত্রের মতে, এই টেন্ডার যদি ইতিবাচক পথে এগোয়, তবে ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস নির্বাচনী প্রচারে কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগ হিসেবে এটিকে অবশ্যই ব্যবহার করবে।
তিনি ডিডাব্লিউকে বলেন, "কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের টানাপড়েনের সম্ভাবনাও রয়েছে, বিশেষ করে যদি গতবার আদানির বরাত বাতিল হওয়ার পরে এবার তারা ফের আগ্রহ দেখায়। তবে যদি তৃণমূল কংগ্রেসই পুনরায় ক্ষমতায় ফেরে, সেক্ষেত্রে আদানি গোষ্ঠী কতখানি আগ্রহ দেখাবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।"
তার বক্তব্য, "পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে একটি শিল্প-বিরোধী ইমেজ তৈরি হয়েছে, যা ভেঙে বেরিয়ে আসা কঠিন। যতক্ষণ পর্যন্ত টেন্ডার কোনও নির্দিষ্ট রূপ না নিচ্ছে এবং বাস্তবে কাজ শুরু না হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত এর প্রভাব জনমানসে পড়বে না।"