তারপরও ইয়েমেন যুদ্ধে সৌদি আরবের পাশে থাকবেন ট্রাম্প
১৭ এপ্রিল ২০১৯
ইয়েমেন যুদ্ধে সৌদি আরবকে সহায়তা দেয়া বন্ধে কংগ্রেসের সিদ্ধান্তে ভেটো দিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প৷ এর মাধ্যমে ‘অ্যামেরিকার লজ্জাজনক অংশগ্রহণ চিরস্থায়ী হলো' বলে অভিহিত করেছেন হাউস স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি৷
বিজ্ঞাপন
ইয়েমেন যুদ্ধে সৌদি আরবকে যেন আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সামরিক সহায়তা না দেয় তা নিয়ে বিল পাস করেছিল কংগ্রেসের দুই কক্ষই৷ কিন্তু তাতে ভেটো দিলেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প৷
এ নিয়ে দ্বিতীয় দফায় দেশটির আইনসভার কোনো বিল প্রত্যাখ্যানের ক্ষমতা ব্যবহার করলেন তিনি৷ প্রেসিডেন্টের ভেটো উপেক্ষা করতে হলে বিলটিতে দুই তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থন থাকতে হয়, যা বর্তমান বিভাজিত কংগ্রেসে নেই৷
তবে হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভ ও সেনেট দুই কক্ষেই সিদ্ধান্তটি পাস হওয়া দেশটির রাজনীতির জন্য একটি ঐতিহাসিক ঘটনা৷ যুদ্ধের বিষয়ে কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত দেয়ার এই ক্ষমতা ১৯৭৩ সালে চালু হওয়ার পর এই প্রথম কোনো বিল প্রেসিডেন্টের টেবিল পর্যন্ত পৌঁছানোর সুযোগ পেলো৷
দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের জন্য ক্ষতিকর
বিলটিতে ট্রাম্প ভেটো দেবেন তা অনেকটা প্রত্যাশিতই ছিল৷ সাংবাদিক জামাল খাসোগজির হত্যাকাণ্ডে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের জড়িত থাকা নিয়ে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তথ্যের পরও সৌদি আরবকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন ট্রাম্প৷ কংগ্রেসের বিলটির যৌক্তিকতা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন তিনি৷
‘‘এই সিদ্ধান্তটি আমার সাংবাধিনিক কর্তৃত্বকে দুর্বল করার জন্য অপ্রয়োজনীয় ও ক্ষতিকর একটি প্রচেষ্টা৷ এটি অ্যামেরিকার নাগরিক, সাহসী চাকুরিজীবী সবার জীবনকেই বর্তমান ও ভবিষ্যতে হুমকির মধ্যে ফেলবে,'' ভেটোর কারণ হিসেবে দেয়া ব্যাখ্যায় এমনটাই উল্লেখ করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট৷
শান্তি নেই ইয়েমেনবাসীর
যুদ্ধবিদ্ধস্ত, ক্ষুধাপীড়িত ইয়েমেনিদের খবর গণমাধ্যমে নতুন নয়৷ বিদ্যমান দুর্ভোগের সাথে তাঁদের কপালে নতুন যে মাত্রা যুক্ত হয়েছে তা হলো কলেরার প্রাদুর্ভাব৷ দেশটিতে মহামারি আকারে রূপ নিয়েছে কলেরা, বলছে জাতিসংঘ৷
ছবি: Reuters/M. al-Sayaghi
মৃত্যুর কিনারায় ১০ লক্ষ লোক
২০১৫ সাল থেকে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোট হামলা চালিয়ে যাওয়ার সময় থেকেই ইয়েমেনবাসীর নেই বেঁচে থাকার নিরাপত্তা৷ দু’মুঠো খাবারের জন্য রয়েছে নিত্য হাহাকার৷ এরই মধ্যে যুক্ত হলো পানিবাহিত রোগ কলেরা৷ ১০ লাখ ইয়েমেনবাসীর জন্য এ আরেক নতুন দুর্যোগ, বললেন স্থানীয় ডাক্তার মোহাম্মদ আবদুল-মুঘনি৷
ছবি: Reuters/M. al-Sayaghi
বাড়ছে লাশ!
যুদ্ধ আক্রান্ত এ দেশটিতে এমনিতেই প্রতিনিয়ত বাড়ছে লাশের সারি৷ নতুন করে যুক্ত হওয়া এ মহামারি আরো বাড়াচ্ছে মৃতের সংখ্যা৷ জাতিসংঘ বলছে গত দু’মাসে দেশটিতে কলেরায় আক্রান্ত হয়ে নিহতের সংখ্যা ছিল অন্তত ২০০৷
ছবি: Reuters/K. Abdullah
আক্রান্ত হচ্ছে প্রতিদিন
জাতিসংঘ বলছে, গত দু’মাসে দেশটিতে কলেরায় আক্রান্তের সংখ্যা এক লক্ষ ছাড়িয়ে গেছে৷ দেশটির সানা অঞ্চলের একটি অস্থায়ী হাসপাতালে কাজ করেন মোহাম্মদ আবদুল-মুঘনি৷ তিনি জানান, প্রতিদিন অন্তত ১৫০ থেকে ২০০ জন কলেরা আক্রান্ত রোগী তাঁর হাসপাতালটিতে ভর্তি হন৷
ছবি: Reuters/M. al-Sayaghi
মরার উপর খরার ঘা
আক্রান্তের তালকায় রয়েছেন শিশু থেকে বৃদ্ধ৷ এদিকে রোগীদের অনেকেই কিডনি সমস্যাসহ নানারকম শারীরিক জটিলতা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন৷ যে কারণে তাঁদের শরীরে পানিশূন্যতা পূরণের জন্য প্রয়োজনীয় ইনজেকশনের সুই প্রবেশ করানোও কঠিন হয়ে পড়ে বলে জানাচ্ছেন ডাক্তাররা৷
ছবি: Reuters/K. Abdullah
পানির জন্য হাহাকার
আরব সাগরের তীরে অবস্থিত এ উপদ্বীপটিতে চলছে তীব্র খাবার পানির সংকট৷ যে পরিমাণ পানি পাওয়া যাচ্ছে তার পুরোটা খাওয়ার উপযোগী নয়৷ দুর্গন্ধযুক্ত এ পানিই মূলত ছড়াচ্ছে জীবানুবাহিত বিভিন্ন রোগ, বলছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা৷
ছবি: Reuters/K. Abdullah
চেষ্টা চালাচ্ছে প্রশাসন
কলেরার এ প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে দেশটির সরকার৷ বিভিন্ন ধরণের কীটনাশক ছিটিয়ে রোগজীবাণু ধ্বংসের চেষ্টা করছেন স্বাস্থ্যকর্মীরা৷
ছবি: Reuters/M. al-Sayaghi
6 ছবি1 | 6
বিলটি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি ও দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে হূমকির মধ্যে ফেলবে বলেও যুক্তি দেখান ট্রাম্প৷ ‘‘ইয়েমেনে শান্তি প্রতিষ্ঠার বিষয়টি আলোচনাসাপেক্ষ ব্যাপার,'' বলেন তিনি৷ যুক্তরাষ্ট্র আল কায়দা ছাড়া কারো বিরুদ্ধে সরাসরি শত্রুতায় যায়নি বলেও তিনি দাবি করেন৷
ট্রাম্পের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে ইয়েমেনে হামলায় সৌদি আরবের প্রধান মিত্র সংযুক্ত আরব আমিরাত৷ এক টুইট বার্তায় ট্রাম্পের বিবৃতিটিকে ইতিবাচক সংকেত হিসেবে অভিহিত করেছেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনোয়ার গারগাশ৷
কংগ্রেসের প্রতিক্রিয়া
যুক্তরাষ্ট্র ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীদের দমনে সৌদি নেতৃত্বাধীন হামলায় কয়েক বিলিয়ন ডলার খরচ করছে৷ পাস হওয়া বিলটির মাধ্যমে কংগ্রেস সদস্যরা ২০১৪ সাল থেকে জোটের চালানো বিমান হামলায় কয়েক হাজার নাগরিকের মৃত্যুতে উদ্বেগ প্রকাশ করেন৷
এই হামলায় যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা দেয়া বন্ধে কংগ্রেসের সিদ্ধান্তে ট্রাম্প ভেটো দেয়ায় নিন্দা জানিয়েছেন হাউসের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি৷ এর মাধ্যমে ‘‘হৃদয়বিদারক একটি সংকটে অ্যামেরিকার লজ্জাজনক অংশগ্রহণ চিরস্থায়ী হলো'', বলে মন্তব্য করেন তিনি৷
নিজের দেশেই পলাতক ইয়েমেনিরা
ইয়েমেনে যুদ্ধ শুরুর আগে অল্পসংখ্যক মানুষ দেশের বাইরে পালিয়ে যেতে পেরেছে৷ তবে বেশিরভাগই দেশের ভেতরেই লুকিয়ে আছেন৷ কিন্তু যারা শরণার্থী শিবিরে পালিয়ে যেতে পেরেছে তারাও যে আশঙ্কামুক্ত বা নিরাপদে আছে, তা কিন্তু নয়৷
ছবি: Reuters/K. Abdullah
কোনো কিছুই যথেষ্ট নয়
ইয়েমেনে যুদ্ধ চলছে গত চার বছর ধরে৷ কবে এ যুদ্ধ শেষ হবে, তা কেউ জানেনা৷ ইতিমধ্যে প্রায় তিন লাখ মানুষ দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছে৷ কিন্তু দেশটির জনসংখ্যার একটি বড় অংশই নিজের দেশেই বিভিন্ন জায়গায় লুকিয়ে আছে৷ হাজ্জাহ রাজ্যের আবস শহরে নির্মিত অস্থায়ী শিবিরের মতো কেন্দ্রগুলোতে ২০১৫ সাল থেকে প্রায় তিন মিলিয়ন মানুষ আশ্রয় নিয়েছে৷এসব কেন্দ্রে পানি, খাবার, ওষুধপত্র কোনো কিছুই বাসিন্দার সংখ্যার তুলনায় যথেষ্ট নয়৷
ছবি: Reuters/K. Abdullah
বিশ্বের সবচেয়ে বড় মানবিক সংকট
২৪ মিলিয়ন অর্থাৎ সেদেশের জনসংখ্যার ৮০ ভাগ মানুষেরই জরুরিভাবে সাহায্যের প্রয়োজন৷ বিশেষ করে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে শিশুরা৷ ইউনিসেফের মতে, ক্ষুধা ও অপুষ্টির কারণে প্রতি দশ মিনিটে অন্তত একজন শিশু মারা যায়৷ সম্প্রতি জাতিসংঘের উদ্যোগে আয়োজিত দাতাদের এক সম্মেলনে চলতি বছর ইয়েমেনের জন্য ২.৬ বিলিয়ন ডলার সহায়তার অঙ্গীকার পাওয়া গেছে৷
ছবি: Reuters/K. Abdullah
আগে থেকেই সংকট ছিল
২০১৫ সালের অনেক আগে থেকেই ইয়েমেনে রাজনৈতিক সংকট চলছিল৷ সরকার, বিদ্রোহী ও জঙ্গি গোষ্ঠীর মধ্যে ক্ষমতার নানারকম দ্বন্দ্বের কারণে বহু মানুষকে পালিয়ে যেতে হয়৷ সে সময় শতকরা ৫০ ভাগ মানুষই দারিদ্রসীমার নীচে বাস করতো৷ শতকরা ৭০ ভাগ মানুষেরই বিশুদ্ধ পানি এবং চিকিৎসা সেবার সুযোগ ছিলো না৷ তাছাড়া যুদ্ধের শুরুতেই সাংঘাতিকভাবে শরণার্থীদের সংখ্যা বেড়ে যায়৷
ছবি: Reuters/K. Abdullah
যেসব শিশুর ভবিষ্যত নেই
সংঘাতপূর্ণ অঞ্চল থেকে অনেক পরিবার হাজ্জাহ প্রদেশে আসে, যেখানে মোট শরণার্থীদের এক-পঞ্চমাংশের বসবাস৷ তবে এই জায়গাটিও কিন্তু তাদের জন্য পুরোপুরি নিরাপদ নয়, বিশেষ করে, ছোট মেয়েদের জন্য তো নয়ই৷ সাহায্য সংস্থা অক্সফাম-এর মতে, অনেক মা-বাবা বাধ্য হচ্ছে তাদের শিশু কন্যাদের বিয়ে দিতে, যাতে যৌতুকের টাকা দিয়ে তারা খাবার কিনতে পারেন৷
ছবি: Reuters/K. Abdullah
কলেরা সংক্রমণ
সংকট ব্যাপকতর হওয়ার আগে দেশটি ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ খাবার আমদানি করতো৷ বর্তমানে বিমানবন্দরগুলোতে সংঘাত চলায় রাজধানী সানার বিমানবন্দর বন্ধ৷ ফলে দেশটিতে গুরুত্বপূর্ণ ত্রাণ সামগ্রী আসা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে৷ ১৩ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ বিশুদ্ধ পানি থেকে বঞ্চিত হওয়ায় নানা রোগ ছড়াচ্ছে৷ আর ২০১৭ সালের শেষ নাগাদ প্রায় এক মিলিয়ন মানুষ কলেরায় আক্রান্ত হয়৷
ছবি: Reuters/K. Abdullah
অস্থায়ী বাড়িঘর
দেশের ভেতরে পালিয়ে থাকা শরণার্থীরা আবস শিবিরে অস্থায়ীভাবে ঘরবাড়ি তৈরি করেছে৷ জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর গত বছর শরণার্থীদের সাথে মিলিতভাবে ৪,৭০০টি পরিবেশবান্ধব ঘর তৈরি করে৷ ঘর তৈরির প্রধান উপকরণগুলোর মধ্যে ছিলো মাটি, ঘাস এবং গরুর গোবর৷ বাড়িগুলো যাতে মানুষকে বৃষ্টি এবং গরম থেকে রক্ষা করতে পারে সেভাবেই তৈরি করা হয়েছে৷ এই অসহায় মানুষগুলো কি আবার কখনো নিজেদের ভিটেমাটিতে ফিরতে পারবে?
ছবি: Reuters/K. Abdullah
যুদ্ধ শুরুর জন্য তো শিশুরা দায়ী নয়
‘শিশুরা তো যুদ্ধ শুরু করেনি, কিন্তু তাদেরই দিতে হচ্ছে সর্বোচ্চ মূল্য’ - একথা বলেছেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস৷ সেভ দ্য চিলড্রেনের এক হিসেব বলছে, ২০১৫ সাল থেকে পাঁচ বছরের কমবয়সি ৮০,০০০ শিশু অনাহারে ছিলো৷ তাছাড়া এক লক্ষ বিশ হাজারেরও বেশি শিশু বর্তমানে ক্ষুধা হুমকির মুখে রয়েছে৷ দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, খুবই অল্পসংখ্যক শিশুই ফুটবল খেলার সুযোগ পেয়ে থাকে৷
ছবি: Reuters/K. Abdullah
7 ছবি1 | 7
বিলের উদ্যোক্তা ডেমোক্র্যাট কংগ্রেস সদস্য রো খান্না বলেছেন, ‘‘ট্রাম্প ইয়েমেনের জনগণকে দুর্ভিক্ষ, বিমান হামলা আর সৌদি শাসকদের যুদ্ধাপরাধের ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিয়েছেন৷''
মার্কিন প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্তে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও হতাশা প্রকাশ করেছে৷ ইন্টারন্যাশনাল রেসকিউ কমিটির প্রেসিডেন্ট ও প্রধান নির্বাহী ডেভিড মিলব্যান্ড বলেন, এই ভেটোর মাধ্যমে বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ মানবিক সংকটের জন্ম দেয়া যুদ্ধটি চালিয়ে যাওয়ার সবুজ সংকেত কার্যকর হলো৷