1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

তারুণ্য ডুবে আছে ভার্চুয়াল বিনোদনে

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
১৯ মার্চ ২০১৯

তরুণদেরও যে বিনোদন প্রয়োজন, তাঁদেরও যে একটা অবসরজগত আছে, সেই খোঁজ অনেকে রাখেন না৷ শিশুদের জন্য খেলার মাঠের কথা বলা হয়, খোলা আকাশের কথা বলা হয়৷ কিন্তু তরুণরা কোথায় যাবে!

Symbolbild Facebook Ausfall 27.01.2015
ছবি: Reuters/D. Ruvic

বয়স ১৮ বছর পর্যন্ত হলে শিশু-কিশোর ধরা হয়৷ তাহলে তরুণ কারা? এখন তো ৫০-এও তরুণ৷ তাই তরুণদের একটা বয়সসীমা দরকার৷ ধরা যাক সেটা ১৪ থেকে ৩০৷ প্রশ্ন উঠতে পারে, কিশোর বয়সকে কেন তরুণ বয়সের সীমায় ফেলা হলো? রবীন্দ্রনাথের গল্পের ফটিক চক্রবর্তীর কথা মনে আছে? ছোট গল্পের সেই মূল চরিত্র ফটিকের বয়স সম্ভবত ১৪ বছরই ছিল৷ তো ফটিক যে বয়সের, সেই বয়সটা বড় জটিল৷ না ঘরের, না পরের৷ শিশুদের মতো আচরণ করলে কেউ মেনে নিতে চায় না, আবার বড়দের মতো আচরণ করলে নাম হয়ে যায় ‘ইঁচড়ে পাকা'৷

তারপরও রবীন্দ্রনাথের ফটিকদের একটা দল ছিল৷ তারা কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে তা বস্তবায়ন করতে পারত৷ কিন্তু সেই ফটিক শহরে গিয়ে কিন্তু পানি ছাড়া মাছ যেরকম, সেই অবস্থায় পড়ে৷ কিশোর ফটিকের জগত হারিয়ে যায়৷

সেই ফটিকরা এখনো আছে৷ বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজ থেকে মাস্টার্স পাশ করে ঢাকায় এসেছেন সোহেল রানা৷ আত্মীয়ের বাসায় থাকেন৷ হঠাৎ করেই তাঁর জীবন এক নতুন বাঁক নেয়৷ তাঁর স্কুল আর কলেজ জীবনের দিগন্তজোড়া খেলার মাঠ নেই৷ নেই বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরে বেড়ানো অথবা পাড়ার সেই পাঠাগারে গিয়ে দল বেধে বই পড়ার সুযোগ৷

সোহেল ঢাকায় একটা চাকরিও পেয়েছেন৷ আরো ভালো বেতনের চাকরি খুঁজছেন৷ কিন্তু তারপরও তাঁর অবসর থাকে৷ তিনি বলেন, ‘‘আমি ঢাকায় কোথায় খেলার মাঠ পাবো? আর এখানে তেমন বন্ধু বান্ধবও নেই৷ বলতে পারেন আমি এখন বিনোদনবঞ্চিত৷ যেটুকু বিনোদন তা ফেসবুক, ইউটিউব আর টেলিভিশন দেখা৷ আর এসবই এখন মোবাইল ফোনভিত্তিক৷ মোবাইল ফোনই যেন এখন আমাদের বিনোদন৷''

সোহেল রানা

This browser does not support the audio element.

এক সময় ঢাকা শহরে পাড়াভিত্তিক অনেক পাঠাগার ছিল৷ ছিল ব্যায়ামাগার৷ অনেক ক্লাব ছিল৷ তা-ও হারিয়ে গেছে৷ একসময় পুরো ঢাকায় সিটি কর্পোরেশন এলাকায় মোট ২৩টি পাঠাগার ছিল৷ বর্তমানে তা কমে ৭টিতে নেমে এসেছে৷ সেগুলোও নিয়মিত খোলে না৷ পাঠকও নেই তেমন৷ নতুন বই কেনা হয় না বহুদিন৷

দুই সিটি কর্পোরেশন মিলিয়ে এখনো কাগজে-কলমে ২৩টি ব্যায়ামাগার আছে৷ এর মধ্যে ২১টিই দক্ষিণ সিটিতে৷ কিন্তু ব্যায়ামাগারগুলো নামেই আছে৷ নেই প্রশিক্ষক, নেই আধুনিক শরীরচর্চার সরঞ্জাম, নেই পরিবেশ৷ ভবনগুলো পুরোনো, জরাজীর্ন৷ আর ঢাকার ক্লাব বলতে আছে শুধু পরিচিত কিছু ফুটবল ক্লাব৷ যেসব ক্লাবে আগে নানা ধরনের খেলা ও বিনোদনমূলক আয়োজন হতো তা হরিয়ে গেছে৷

ঢাকা মহানগরীর ৬৪ শতাংশ স্কুলে খেলাধুলার কোনো ক্লাসই নেয়া হয় না৷ বেশিরভাগ স্কুলেই খেলার মাঠ নেই৷ রাজউক এবং ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের হিসাব অনুযায়ী রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় সরকারি জায়গায় প্রতিষ্ঠিত পার্ক ৪৭টি৷ কিন্তু বাস্তবে অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় বড়জোর ১০টি, সেগুলোও নানা কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে৷ আর ১৯টি খেলার মাঠের মধ্যে ৮টি কোনোমতে টিকে আছে৷ বাকিগুলো বেদখল হয়ে গেছে নগর কর্তৃপক্ষের লোকজনের চোখের সামনেই৷

নাদিম হোসেন রোহান

This browser does not support the audio element.

এর বিপরীতে এখন ঢাকায় গড়ে উঠেছে স্নুকার ও বিলিয়ার্ড ক্লাব৷ আছে সাইবার ক্যাফে৷ আছে ফাস্টফুড আর ফুডকোর্টের আধিক্য৷ আছে কর্পোরেট জিমনেশিয়াম৷ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ক্লাব কালচার আছে৷ ডিবেটিং ক্লাব, সায়েন্স ক্লাব, বিজনেস ক্লাব, পর্যটন ক্লাব আছে৷ আছে চলচ্চিত্র সংসদ৷ তবে তা নামকরা ও হাতে গোনা কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে৷ এছাড়া শহরজুড়ে পাড়ায় পাড়ায় রয়েছে ভিডিও গেমের ব্যবসা৷ শপিংমলগুলোতে গড়ে উঠছে সিনেপ্লেক্স৷

স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির সপ্তম সেমিস্টারের ছাত্র নাদিম হোসেন রোহান বলেন, ‘‘আমার বাসা গেন্ডারিয়া৷ ধানমন্ডিতে ক্লাস করে আমি বাসায় চলে যাই৷ কিন্তু গেন্ডারিয়া এলাকায় কোনো খেলার মাঠ নেই৷ তাই ঘরেই বসে থাকি৷আমার বিশ্ববিদ্যায়েও খেলার মাঠ নেই যে খেলবো৷ বাসায় মোবাইল ফোনেই আমার বিনোদন৷ ফেসবুক, ভিডিও গেমে আমরা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি৷ মাঝে মাঝে বন্ধুরা মিলে ফাস্টফুড সেন্টারে আড্ডা দেই৷''

তিনি আরো বলেন, ‘‘ঢাকার অভিজাত এলাকায় বিলিয়ার্ড ও স্নুকার ক্লাব আছে৷ ওখানে যারা যায়, তাদের অধিকাংশই উচ্চবিত্ত ঘরের সন্তান৷ তাছাড়া ওখানকার পরিবেশ নিয়েও নানা কথা আছে৷''

ইদানীং তরুণদের একাংশের মাঝে শিশা বারের দিকেও ঝোঁক দেখা যাচ্ছে৷ সেখানে আছে আয়েশি ধূমপানের ব্যবস্থা৷ আর কিশোরদের জন্য আছে ভার্চুয়াল গেমের কর্নার৷ ফাস্ট ফুডের দোকানের সঙ্গেই এগুলোর অবস্থান৷ আর সেইসব প্লে-জোনে ভার্চুয়াল কিশোররা বন্দুক চালানো বা কার ড্রাইভিংয়ের মতো গেমসে অভ্যস্ত হচ্ছে৷

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ফিল্ম সোসাইটির সাবেক সভাপতি বিপ্লব মোস্তাফিজ বলেন, ‘‘ব্যায়ামগার নেই, আছে জিম৷ আর এই জিমনেশিযাম এখন কর্পোরেট বাণিজ্যের অংশ৷ তরুণরা সেখানে যেতে পারেন না৷ তাঁদের এত টাকা নেই৷ তবে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের মতো কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান এখনো তরুণদের বই পড়ানোর জন্য কাজ করছে, কিন্তু তা প্রয়োজনের তুলনায় কম৷ সিনেমা হল এখন একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে৷ তার পরিবর্তে হচ্ছে সিনেপ্লেক্স, যার টিকেটের দাম অনেক৷''

তিনি আরো বলেন, ‘‘তরুণদের বিনোদনের জন্য সামাজিক উদ্যোগ এখন আর নেই৷ আগে পাড়ায় পাড়ায় ক্লাব ছিল৷ দাবা খেলা হতো৷ ফুটবল আর ক্রিকেট খেলা হতো৷ নাটক, থিয়েটারের ব্যবস্থা ছিল৷ আয়োজন করা হতো নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের৷ তরুণরা অংশ নিতো৷ আয়োজন করতো৷ অনেক সামাজিক উদ্যোগ তাঁদের মাধ্যমেই হতো৷ কিন্তু এখন আর হয় না৷ তখন নানাভাবে নেতৃত্ব গড়ে উঠত, উদ্যোক্তা বেরিয়ে আসতো৷ এখন এর বিপরীতে বাড়ছে নেশার জগত৷''

বিপ্লব মোস্তাফিজ বলেন, ‘‘এখনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ফিল্ম সোসাইটি আছে৷ ডিবেটিং ক্লাব আছে৷ কিন্তু সেখানে প্রাণচাঞ্চল্য নেই৷ সবখানেই যেন কর্পোরেট ছোয়া৷''

বিপ্লব মোস্তাফিজ

This browser does not support the audio element.

তাঁর মতে, ‘‘এখন আমাদের জনসংখ্যার ১৪ থেকে ৩০ বছর বয়সিই ৩০ ভাগ, কিন্তু তাদের দিকে তেমন নজর দেয়া হচ্ছে না৷ একটি প্রজন্ম এখন মোবাইল ফোন, ফেসবুক, ইউটিউবে তাদের অবসর কাটায়৷ তারা যেন ভার্চুয়াল জগতের বাসিন্দা হয়ে যাচ্ছে৷ কেউ কেউ ধুলোমাটি ছেড়ে যেন এখন কল্পলোকে বাস করেন৷ পাঠাভ্যাস কমে যাচ্ছে, যা উদ্বেগজনক৷''

তারপও কিছু তরুণ আছেন, যাঁরা নিজেদের বিনোদনের জগত নিজেরাই তৈরি করে নিচ্ছেন৷ তাঁরা সাইক্লিং করছেন, গড়ে তুলছেন বাইকার গ্রুপ৷ আবার দলবেঁধে পর্যটনের প্রতি আগ্রহও বাড়ছে তরুণদের৷ বিশেষ করে অভ্যন্তরীণ পর্যটনে তাঁদের আগ্রহ ক্রমশই বাড়ছে৷ তরুণরা নিজেরা এক হয়ে জনসেবামূলক কাজও করছেন৷ বঞ্চিতদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন৷ বিয়ে বাড়ির উদ্বৃত্ত খাবার সংগ্রহ করে কেউ কেউ পৌঁছে দিচ্ছেন অভুক্তদের মাঝে৷ তরুণদের অনেকে উদ্যোক্তা হতেও দলবেঁধে কাজ করছেন৷ শুধু প্রয়োজন তাদের একটু জায়গা, সুস্থ বিনোদনের একটু সুযোগ৷ প্রয়োজন ভার্চুয়াল জগত থেকে বাস্তব পৃথিবীতে নামিয়ে আনা৷ বন্ধুরা যেন শুধু ফেসবুকবাসী না হয়, তারা যেন বাস্তবের বন্ধু হয়, ভালোবাসার মানুষ হয়৷

ড. নুরুন্নবী

This browser does not support the audio element.

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. নুরুন্নবী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘১৪ থেকে ৩০ বছর বয়সের এই যে তরুণরা, তারা না ঘরকা না ঘাটকা৷ অথচ তারাই ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট-এর জন্য সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনাময়৷ তারা না শিশুদের নিয়ে পরিকল্পনায় আছে, না আছে তরুণদের নিয়ে পরিকল্পনায়৷ ১৮ বছর পর্যন্ত সবাই শিশু৷ কিন্তু বাস্তবে ১৪ থেকে কৌশোর৷ আবার তরুণ মানে ৩৫৷ তাহলে এরা যাবে কোথায়? এরা ডেমোগ্রাফিক ওয়েস্টেজে পরিণত হচ্ছে৷ তাদের যদি বিনোদন থেকে শুরু করে সব ধরনের পরিকল্পনায় না আনা যায়, তাহলে আমরা ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট ঘরে তুলতে পারবো না৷''

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য
স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ