লাগাতার অবরোধ কর্মসূচি প্রত্যাহার না করে বিএনপি এর সঙ্গে আরও নতুন কর্মসূচি যোগ করার পরিকল্পনা করছে বলে জানা গেছে৷ অবশ্য দলটির কোনো নীতিনির্ধারক এ বিষয়ে এখনো কিছু বলেননি৷
বিজ্ঞাপন
বিএনপি নেতাদের মধ্যে যাঁরা কারাগারের বাইরে আছেন তাঁদের অধিকাংশের মোবাইল ফোনও বন্ধ৷ দুই-একজন নেতাকে পাওয়া গেলেও তাঁরা কর্মসূচি নিয়ে কিছু বলতে রাজি হচ্ছেন না৷ শুধু বলছেন টানা অবরোধ কর্মসূচি চলবে৷ নতুন কোনো কর্মসূচি যোগ করতে হলে দলীয় প্রধান খালেদা জিয়া নিজেই করবেন৷ এ ব্যাপারে তাঁকেই সব ক্ষমতা দেয়া আছে৷ তাই নতুন কি ধরনের কর্মসূচি আসতে পারে সে ব্যাপারেও তাঁরা কিছু জানেন না৷
বিএনপির সহ-দফতর সম্পাদক আসাদুল করিম শাহীন বলেন, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত লাগাতার অবরোধ কর্মসূচি চলতেই থাকবে৷ এর সঙ্গে দলের নীতিনির্ধারকরা নতুন নতুন কিছু কর্মসূচিও যোগ করবেন৷
বিএনপির একাধিক নেতা বলেছেন, লন্ডন থেকে টেলিফোনে একাধিক নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান ও খালেদা জিয়ার বড় পুত্র তারেক রহমান বলেছেন, কর্মসূচি শিথিল করা যাবে না, লাগাতার কর্মসূচি চলতে থাকবে৷ দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত কর্মসূচি চলবে৷
তবে খালেদা জিয়া টানা কর্মসূচি না দিয়ে বিরতি দিয়ে কর্মসূচির পক্ষে বলে জানান ওই নেতারা৷ শেষ পর্যন্ত তারেক রহমানের ইচ্ছায় কর্মসূচি শিথিল না করে লাগাতার অবরোধ চালানোর চিন্তাভাবনা করছেন বিএনপির নীতিনির্ধারকরা৷
বুধবার সন্ধ্যায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক বিবৃতিতে বলেছেন, প্রহসনের নির্বাচন বাতিলের দাবিতে ডাকা টানা হরতাল শেষ হলেও অবিরাম অবরোধ কর্মসূচি চলবে৷ বিবৃতিতে ‘খালেদা জিয়ার পক্ষ থেকে' চলমান আন্দোলনের অংশ হিসেবে লাগাতার অনির্দিষ্টকালের রাজপথ-রেলপথ-নৌপথ অবরোধ কর্মসূচি শান্তিপূর্ণভাবে চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান তিনি৷
অর্থনীতির অবস্থা খারাপ হবে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, বিএনপির পক্ষে এই মুহূর্তে এর বাইরে কোনো কিছু করার সুযোগ আছে বলে মনে হয় না৷ কারণ ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিএনপি একতরফা নির্বাচন করে ফেলার পর টানা আন্দোলনেই ছিল আওয়ামী লীগ৷ তখনও কিন্তু আওয়ামী লীগ টানা হরতাল ও অবরোধ কর্মসূচি পালন করেছে৷ বিএনপিও সে পথেই যাচ্ছে৷ তিনি বলেন, এভাবে আসলে কোনো সমস্যার সমাধান হবে না৷ জনগণকে দুর্ভোগের মধ্যেই থাকতে হবে৷ কারণ যতদিন পর্যন্ত না সমাধান হচ্ছে আগামী নির্বাচন কিভাবে হবে, ততদিন পর্যন্ত এভাবেই চলতে থাকবে৷ তবে নতুন সরকার গঠিত হলেও তা কিন্তু শক্তিশালী হবে না৷ কারণ এই নির্বাচন দেশীয় বা আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হচ্ছে না৷ ফলে সরকারও জোর করেই ক্ষমতায় থাকার চেষ্টা করবে, আর বিরোধী দল টানা কর্মসূচির মধ্যে থাকতে চাইবে৷ এতে দেশের অর্থনীতির অবস্থা খুবই খারাপ জায়গায় চলে যাবে৷ এ থেকে পরিত্রাণ খুবই জরুরি৷
পুড়ছে মানুষ, পুড়ছে মানবতা
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি আদায়ের জন্য বিরোধীদলের কর্মসূচিতে পুড়ছে যানবাহন, ধ্বংস হচ্ছে সম্পদ, মরছে মানুষ৷ হরতাল-অবরোধের নামে পোড়ানো অনেকে এখনো যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে৷
ছবি: Mustafiz Mamun
সারি সারি পোড়া মানুষ
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ১ নম্বর বার্ন ইউনিট এখন হরতাল-অবরোধের নামে পোড়ানো জীবিকার তাগিদ কিংবা দৈনন্দিন প্রয়োজনে রাস্তায় নামা মানুষে ভরে গেছে৷
ছবি: Mustafiz Mamun
শিশুর কষ্ট বোঝেনা তারা!
কোলের শিশুও বাঁচতে পারছেন না জ্বালাও-পোড়াওয়ে হাত থেকে৷ প্রতিপক্ষের আদর্শকে ভুল প্রমাণ করে শ্রেয়তর আদর্শ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা নয়, প্রতিপক্ষকে আঘাত করে, হত্যা করে লক্ষ্যে পৌঁছানোর চেষ্টা অনেক দেখেছে বাংলাদেশের মানুষ৷ স্বাধীন দেশে নিরীহ মানুষকে নির্বিচারে পোড়ানোও দেখতে হচ্ছে৷ ৩ নভেম্বর আট বছরের সুমি দাদীর সঙ্গে নেত্রকোনা থেকে ঢাকা আসছিল৷ জয়দেবপুর চৌরাস্তায় তাদের বাসটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়৷
ছবি: Mustafiz Mamun
বোবা কান্না...
নির্মমতার আরেকটি ছবি হয়ে আছে মজিবরের পোড়া শরীর৷ মজিবর বাকপ্রতিবন্ধী৷ কুমিল্লার দেবিদ্বারের এক ট্রাকের হেলপার৷ পিকেটারদের বোমা হামলায় বাসের সঙ্গে তাঁর শরীরও পুড়েছে৷ সবাই শুনে বুঝবে এমনভাবে কথা তিনি বলতে পারেন না, বোবা কান্নায় শুধু পারেন অসহায়ত্ব প্রকাশ করতে, আর্তনাদ করতে আর এ অন্যায়ের প্রতিকার আশা করতে৷
ছবি: Mustafiz Mamun
মেয়েকে দেখতে গিয়ে মা হাসপাতালে
জাহানারা বেগম৷ বয়স ৫২৷ পেশা – ফেরি করে কাপড় বিক্রি করা৷ হরতাল-অবরোধ থাকলে বিক্রি কমে যায় বলেই হয়তো সেদিন কাপড় নিয়ে বাড়ি বাড়ি না ঘুরে জাহানারা গিয়েছিলেন শ্যামপুরে৷ সেখানে তাঁর মেয়ের বাড়ি৷ মেয়েকে দেখে অটো রিক্সায় ফেরার সময়েই বিপদ৷ বিরোধী দলের কিছু সমর্থক সেই অটোরিক্সাতেও ছুড়ে মারে পেট্রোল বোমা৷ সন্তানের প্রতি অপত্য স্নেহের মূল্য আগুনে পুড়ে চুকাচ্ছেন জাহানারা বেগম!
ছবি: Mustafiz Mamun
তালহার অসহায়ত্ব
২৮ নভেম্বর সন্ধ্যায় রাজধানীর শাহবাগে বাসে পেট্রোল বোমা ছুড়ে মারে দুর্বৃত্তরা৷ শরীরের ৩০ শতাংশ পুড়ে যাওয়ায় আবু তালহা সেই থেকে ১ নম্বর বার্ন ইউনিটে৷
ছবি: Mustafiz Mamun
রাজমিস্ত্রী
রাজমিস্ত্রী ও ঠিকাদার আবুল কালাম আজাদের শরীর পুড়েছে গত ১২ নভেম্বর৷ সেদিন ঢাকার রায়েরবাগেও একটি চলন্ত বাসে ছোড়া হয় পেট্রোল বোমা৷ সেই থেকে তাঁরও ঠিকানা ঢাকা মেডিকেল কলেজের ১ নম্বর বার্ন ইউনিট৷
ছবি: Mustafiz Mamun
বাসচালক
২৮ নভেম্বর সন্ধ্যায় শাহবাগে পেট্রোল বোমা ছুড়ে পোড়ানো সেই বাসটি চালাচ্ছিলেন মাহবুব৷ যাত্রীদের মতো তাঁর শরীরও পুড়েছে৷ তাঁর দেয়া তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের স্বাধীনতা যু্দ্ধের সময়, অর্থাৎ ১৯৭১ সালেই জন্ম মাহবুবের৷ স্বাধীনতার ৪২ বছর পর দেশ পুড়ছে, তিনিও পুড়েছেন৷
ছবি: Mustafiz Mamun
ঘুমের মাঝেই আগুন...
৭ ডিসেম্বর মুন্সীগঞ্জ জেলার মাওয়া ফেরিঘাটে বাসে ঘুমাচ্ছিলেন হেলপার আলমগীর৷ থামানো বাসেই দেয়া হয় আগুন৷ পোড়া দেহ নিয়ে এখন তিনি হাসপাতালে৷
ছবি: Mustafiz Mamun
লেগুনার যাত্রী
১০ নভেম্বর ঢাকার লক্ষীবাজারে পেট্রোল বোমা ছুড়ে পোড়ানো হয় একটি লেগুনা৷ লেগুনা পুড়ে শেষ, লেগুনার যাত্রী কামাল হোসেন ভাগ্যগুণে বেঁচে গেছেন৷ তবে শরীরের ৩৫ ভাগেরও বেশি অংশ পুড়ে গেছে৷ ৩৬ বছরের এ তরুণ লড়ছেন মৃত্যুর সঙ্গে৷ চিকিৎসকদের চেষ্টা এবং সুস্থ মানসিকতার প্রতিটি মানুষের শুভকামনায় তিনি শিগগিরই হয়তো ফিরবেন স্বাভাবিক জীবনে৷ কিন্তু এই দুর্ভোগ, এই দুঃস্বপ্নের দিনগুলো কি কোনোদিন ভুলতে পারবেন?
ছবি: Mustafiz Mamun
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শুভও ছিলেন রায়েরবাগের সেই বাসে৷ তাই ১২ নভেম্বর থেকে তিনিও পোড়া শরীর নিয়ে পড়ে আছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের বিছানায়৷
ছবি: Mustafiz Mamun
10 ছবি1 | 10
গাড়ি চলবে
বিএনপির লাগাতার অবরোধের মধ্যেই গাড়ি চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে পরিবহণ মালিক শ্রমিকরা৷ ঢাকা পরিবহণ মালিক সমিতির সভাপতির খন্দকার এনায়েত উল্লাহ ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, এভাবে গাড়ি বসিয়ে রেখে মালিক, শ্রমিকদের পথে বসার উপক্রম হয়েছে৷ তাই তাঁরা গাড়ি চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন৷ বুধবার রাত থেকেই গাড়ি চলবে৷
এদিকে বরিশাল জেলা সড়ক পরিবহণ শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি জাহাঙ্গীর হোসেন টেলিফোনে ডয়চে ভেলেকে বলেন, গত ২৭ নভেম্বর থেকে সরকারি ছুটির দিন ব্যতিত লাগাতার হরতাল ও অবরোধ চলছে৷ এতে প্রায় দেড়মাস যাবত দূরপাল্লার ও অভ্যন্তরীণ রুটে বাস চলাচল বন্ধ থাকায় পরিবহণ মালিক ও শ্রমিকেরা এখন দুর্বিসহ জীবনযাপন করছেন৷ এ অবস্থায় জেলা সড়ক পরিবহণ শ্রমিক ইউনিয়নের এক সভায় হরতাল ও অবরোধ উপেক্ষা করে বরিশালের অভ্যন্তরীণ রুটে বাস চলাচলের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়৷ বরিশাল জেলা বাস মালিক সমিতিও পৃথক সভা করে একই সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷