সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরে পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর সঙ্গে চাকরিহারা শিক্ষকদের প্রতিনিধিরা বৈঠক করেছিলেন। তার ভিত্তিতে সোমবার তালিকা প্রকাশিত হবে বলে দাবি করেন প্রতিনিধিরা। গোটা দিন পেরিয়ে গেলেও প্রকাশিত হয়নি তালিকা।
তালিকা নিয়ে টানাপড়েন
সোমবার দিনভর অবস্থান চলার পরে রাত বারোটার কিছু আগে প্রেস বিবৃতি জারি করে স্কুল সার্ভিস কমিশন। এই বিবৃতিতে বলা হয়, "সুপ্রিম কোর্টের গাইডলাইন অনুযায়ী চলবে এসএসসি। যোগ্য শিক্ষকরা বেতন পাবেন।" তাহলে কেন যোগ্য ও অযোগ্যের তালিকা প্রকাশ করছে না কমিশন, এ নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। কমিশনের দপ্তর আচার্য সদনের বাইরে জমায়েতে ক্ষোভ আরও বাড়ে।
এসএসসির এই বক্তব্যের ব্যাখ্যা স্পষ্ট হয় শিক্ষামন্ত্রীর মন্তব্যে। তিনি বলেছেন, "সুপ্রিম কোর্ট যে গাইডলাইন দিয়েছে, সেখানে কোথাও তালিকা প্রকাশের কথা নেই। চাকরিহারাদের বৈঠকে তালিকা প্রকাশের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়নি। বলা হয়েছিল, আইনি পরামর্শ অনুযায়ী এসএসসি এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে। সেরকম কোনো ইতিবাচক পরামর্শ তালিকা প্রকাশের ক্ষেত্রে পাওয়া যায়নি।"
শিক্ষামন্ত্রীর এই ব্যাখ্যা মানতে চাইছেন না চাকরিহারারা। মালদহের একটি স্কুলের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক পঙ্কজ রায়ের বক্তব্য, "কলকাতা হাইকোর্ট তাদের রায়ে তালিকা প্রকাশের কথা বলেছিল। সেই রায় বহাল রেখেছে সুপ্রিম কোর্ট। তা সত্ত্বেও কেন তালিকা প্রকাশিত হয়নি?"
কসবার ডিআই অফিস বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন চাকরিহারা শিক্ষকরা। তাদের বেধড়ক লাঠিপেটা পুলিশের। মারা হলো লাথিও।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
লজ্জাজনক
বুধবার চাকরিহারা শিক্ষকদের প্রতিবাদে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুলিশ বেঝড়ক লাঠি চালালো। শিক্ষকদের লাথি মারা হলো। রাস্তায় লুটিয়ে পড়লেন শিক্ষকরা। কসবার ডিআই অফিসে প্রতীকী তালাবন্ধ করে প্রতিবাদ দেখাতে গিয়ে এই হেনস্থার মুখে পড়তে হলো তাদের।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
পুলিশের কীর্তি
বিক্ষোভরত নিরস্ত্র শিক্ষকদের কাউকে গলাধাক্কা দেয়া হলো, কাউকে লাঠি মেরে মাটিতে ফেলে দেয়া হলো, কাউকে দুই পাশ থেকে ধরে লাঠি মারা হলো, কারো হাত মুচড়ে দেয়া হলো। যোগ্য শিক্ষক মঞ্চ ২০১৬-র তরফে রাজ্যজুড়ে বিক্ষোভ ছিল। কলকাতার কসবার বিক্ষোভে এই ঘটনা ঘটলো।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
হালকা বলপ্রয়োগ!
কলকাতা পুলিশ জানিয়েছে, কসবায় একদল বিক্ষুব্ধ জনতা পুলিশকে আক্রমণ করে। সহিংসতা করে। দুই নারী পুলিশ কর্মী-সহ ছয়জন আহত হন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ হালকা বলপ্রয়োগ করে। পরে পুলিশ কমিশনার মনোজ বর্মা দাবি করেছেন, বাধ্য হয়ে পুলিশ ব্যবস্থা নিয়েছে। তবে লাথি মারা কাম্য ছিল না।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
মারের চোটে লাঠি ভাঙলো
বিক্ষোভরত শিক্ষকদের বক্তব্য, তারা ডেপুটেশন দিতে গিয়েছিলেন। পুলিশ প্রথম থেকে মারমুখি ছিল। এমনভাবে মেরেছে যে তাদের লাঠি পর্যন্ত ভেঙে যায়। চাকরিহারা নারী শিক্ষকরাও পুলিশের মারের হাত থেকে বাঁচতে পারেননি।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
মুখ্যসচিবের বক্তব্য
মুখ্যসচিব মনোজ পন্থ বলেন, এই ঘটনা কাম্য ছিল না। চাকরিহারাদের প্রতি সমবেদনা আছে। তারা যেন শান্ত থাকেন। তবে বিরোধীদের অভিযোগ, কোনোরকম সমবেদনা থাকলে পুলিশ তাদের প্রতি এই ধরনের ব্যবহার করে না। পুলিশের এই আচরণ থেকে সরকার ও প্রশাসনের আসল মনোভাব প্রকাশ পাচ্ছে।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
জেলায় জেলায় বিক্ষোভ
শুধু কলকাতার কসবায় নয় জেলায় জেলায় শিক্ষকরা বিক্ষোভ দেখাতে রাস্তায় নামেন। তারা দাবি করতে থাকেন, কসবায় আটক চাকরিহারা শিক্ষকদের মুক্তি দিতে হবে। মেদিনীপুর, বহরমপুর, আসানসোল-সহ বিভিন্ন জায়গায় ডিআই অফিসে তালা ঝুলিয়ে দেয়া হয়।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ
কসবার ডিআই অফিসের সামনে প্রচুর পুলিশ মোতায়েন করা হয়। কিন্তু চাকরিহারা শিক্ষকরা এসে বিক্ষোভ দেখানো শুরু করতেই তারা মারমুখি হয়ে ওঠে বলে বিক্ষোভকারীদের অভিযোগ।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
কেন এই বিক্ষোভ?
ক্যানিং ইটখোলা রাজনারায়ণ হাইস্কুলের অঙ্কের শিক্ষক অনিমেষ সামন্ত বলেন, ''আমাদের দাবি, যোগ্যদের তালিকা অবিলম্বে এসএসসির ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে হবে। যে মিরর ইমেজ যা সিবিআই উদ্ধার করেছে, তা প্রকাশ করতে হবে, যাতে গোটা দেশ ও রাজ্য জানতে পারে আমরা যোগ্য। আমরা যে ওএমআর শিটে পরীক্ষা দিয়েছিলাম, সেটা প্রকাশ করুক। আমরা নতুন করে পরীক্ষায় বসব না। মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণামতো ভলেন্টিয়ারি সার্ভিসও দিতে রাজি নই।''
ছবি: Satyajit Shaw/DW
'গুলি করে মারুক'
বাটানগড় জবতলা সূর্যকুমার বালিকা বিদ্যালয়ের ইংরেজির শিক্ষিকা সাথী লাহা বলেন, 'আমরা যোগ্য শিক্ষক শিক্ষিকা। কোনোভাবেই কোথাও কখনো আমাদের দুর্নীতির নাম নেই। আমরা গোটা দেশকে জানাতে চাই আমরা যোগ্য। আমরা কেন ভলেন্টিয়ারি সার্ভিস দেব। আমাদের পূর্ণ সম্মান দিয়ে পদে ফেরানো হোক। আমাদের পরিবার, বাচ্চাদের স্কুলের ফিস বন্ধ হয়ে যেতে বসেছে। হয় আমাদের আত্মহত্যা করতে বলুক, নয়তো গুলি করে মেরে দিক।'
ছবি: Satyajit Shaw/DW
'অসম্মানজনক প্রস্তাব'
রতনপুর গার্লস হাইস্কুলের শিক্ষিকা স্বর্ণালি বসু বলেন, 'মিরর ইমেজ না পাওয়ার জন্য সুপ্রিম কোর্ট যোগ্য অযোগ্যদের একসঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছিল যাতে আমাদের চাকরি চলে যায়। এসএসসি অযোগ্যদের লিস্ট দিয়েছে যোগ্যদের তালিকা দেয়নি। যোগ্যদের লিস্ট প্রকাশ করা হোক। ভলেন্টিয়ারি সার্ভিস আমাদের জন্য অসম্মানজনক। আমরা যতদিন না যোগ্য সম্মান পাবো ততদিন এই সার্ভিস দিতে রাজি নই।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
'আমরা পথে বসে গেছি'
রায়দিঘি নরেন্দ্রপুর মিলন বিদ্যাপীঠের শিক্ষক কর্ণকুমার নস্কর বলেন, 'সরকার দুর্নীতি করেছে অযোগ্যদের লিস্টেই তা প্রমাণিত। আমরা সকলেই জানি কারা অযোগ্য। যোগ্যদের লিষ্ট সামনে আসা দরকার। সরকার আমাদের সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিচ্ছে। ২০১১ সাল থেকে ২০২৫ সাল বর্তমান সরকার ক্ষমতায় রয়েছে তাতে একটাই মাত্র এই নিয়োগ হয়েছে। অথচ সরকারের মনে হচ্ছে না যে এদেরকে বাঁচানো দরকার। আমরা তো পথে বসে পড়েছি।'
ছবি: Satyajit Shaw/DW
শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্য
শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু বলেছেন, চাকরিহারা শিক্ষকরা আমাদের সঙ্গে বসতে চাইছেন, আবার ধ্বংসাত্মক আন্দোলন করছেন, দুটো একসঙ্গে হতে পারে না। শনিবার তিনি চাকরিহারা শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনায় বসবেন বলে জানিয়েছেন।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
বিরোধীদের প্রতিক্রিয়া
বিরোধী নেতা শুভেন্দু অধিকারী বলেছেন, লাথি, লাঠি মারা স রকার, আর নেই দরকার। বিজেপি এর বিরুদ্ধে রাস্তাতেও নামে। সিপিএমও বৃহস্পতিবার প্রতিবাদ মিছিল করছে। সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তী বলেছেন, রাস্তায় নামা দরকার। শিক্ষাকে বাঁচানোর জন্য। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি শুভঙ্কর সরকার জানিয়েছেন, কংগ্রেস কর্মীরা কলেজ স্ট্রিটে মিছিল করবেন।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
13 ছবি1 | 13
বিজেপি নেতা তাপস রায়ের বক্তব্য, "তালিকা কীভাবে প্রকাশ করবে কমিশন? যদি প্রকাশ করে তাহলে অযোগ্যদের নাম সামনে চলে আসবে, যারা শাসকদলকে টাকা দিয়েছিল। তখন এই অযোগ্যরা তৃণমূলের কাছ থেকে টাকা ফেরত চাইবে।"
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মেদিনীপুরের প্রশাসনিক সভা থেকে বলেন, "কে দাগি আর কে দাগি নয়, সেটা দেখার জন্য সরকার আছে, আদালত আছে। আপনাদের সেটা নিয়ে ভাবতে হবে না। আপনারা চাকরি ও বেতন নিয়ে ভাবুন। আপনারা ফিরে যান, নিশ্চিন্তে ক্লাস করান।"
বিরোধীদের নিশানা করে তিনি বলেন, "উত্তরপ্রদেশে ৬৯ হাজার চাকরি গিয়েছে। ত্রিপুরায় ১০ হাজার চাকরি গিয়েছে। আমরা চাকরি দিই, ওরা চাকরি খায়। যারা চাকরি খেয়েছে, তাদের ভরসা করবেন না। গ্রুপ সি, গ্রুপ ডি নিয়ে আমরা রিভিউ পিটিশন করব। আইনজীবীদের সঙ্গে পরামর্শ করতে দিন। যারা উস্কানি দিচ্ছে, তারা বেতন দেয় না, সরকার বেতন দেয়। প্রাথমিকে নিয়োগ নিয়েও হাইকোর্টে মামলা হয়েছে। এরা কারা চাকরি খেতে চায়!"
যদিও মুখ্যমন্ত্রীর প্রস্তাবে সাড়া দিচ্ছেন না বিক্ষোভকারীরা। এই আন্দোলনের অন্যতম নেতা সুমন বিশ্বাস ডিডাব্লিউকে বলেন, "দুর্নীতি হয়েছে বলেই আজ আমাদের জীবন সংকটে পড়েছে। তাই অযোগ্যদের তালিকা সামনে আসা দরকার। এটা শুধু বেতন নয়, আমাদের মান-মর্যাদার প্রশ্ন। কারা যোগ্য আর কারা নয়, সেটা স্পষ্ট হওয়া দরকার।"
হাইকোর্টে মামলা
২৬ হাজার শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী চাকরি বাতিলের রায় হয়েছিল হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চে। সেই সময়ে আদালত যোগ্য-অযোগ্য পৃথকীকরণ ও অযোগ্যদের বেতন সুদ-সহ ফেরানোর কথা বলেছিল। সেই নির্দেশ কিছুটা পরিমার্জন করে মোটের উপর বহাল রেখেছে সুপ্রিম কোর্ট। কিন্তু কেন হাইকোর্টের সেই নির্দেশ এখনো পালন করা হয়নি, তা নিয়ে আদালত অবমাননার মামলা দায়ের হয়েছে।
এই মামলায় সোমবার ডিভিশন বেঞ্চ রাজ্যের উদ্দেশে প্রশ্ন করেছে, অযোগ্য শিক্ষক ও শিক্ষা কর্মীদের বেতন ফেরাতে কী পদক্ষেপ নিয়েছে রাজ্য? একইসঙ্গে উঠেছে ওএমআর শিট প্রকাশের প্রশ্নটি।
আইনের বিষয়টি ব্যাখ্যা করে এই মামলায় বঞ্চিত চাকরি প্রার্থীদের আইনজীবী ফিরদৌস শামীম ডিডাব্লিউকে বলেন, "বিচারপতি দেবাংশু বসাক রাজ্য সরকার এবং এসএসসিকে প্রশ্ন করেছেন ওএমআর শিট প্রকাশের যে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল তা কেন মানা হয়নি? বুধবার আবার এই মামলার শুনানি হবে। কেন প্রকাশ করা হয়নি সেটা আদালতকে জানাতে হবে। নইলে আদালত অবমাননার দায়ে ব্যবস্থা নেয়া হতে পারে। সুপ্রিম কোর্ট ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত যোগ্যদের স্কুলে পড়াতে বলেছে। তালিকাই যদি না দেবে, তাহলে কী করে ঠিক হবে, কারা স্কুলে যাবে। এক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অমান্য করা হবে।"
চাকরি দুর্নীতি : যোগ্যদের পাশাপাশি অযোগ্যদেরও পাশে থাকতে চেয়ে তোপের মুখে মমতা
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, যোগ্যদের চাকরির বিষয়টির ফয়সালা করে অযোগ্যদের বিষয়টিও দেখবেন। কিন্তু ‘স্বেচ্ছাশ্রম’ মানতে নারাজ যোগ্যরা৷ অযোগ্যদের পাশে থাকার বার্তা দিয়েও তোপের মুখে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী...
ছবি: Satyajit Shaw/DW
সময় চাইলো এসএসসি
সুপ্রিম কোর্ট রায়ে বলেছিল, যেহেতু যোগ্য ও অযোগ্যর মধ্যে পার্থক্য করা যাচ্ছে না, তাই প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষকের চাকরি বাতিল হবে। এসএসসি সুপ্রিম কোর্টে করা আবেদনে বলেছে, চলতি শিক্ষাবর্ষের শেষপর্যন্ত যোগ্যদের চাকরি করতে দেয়া হোক। এর জন্য সুপ্রিম কোর্ট প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিক।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
মমতা যা বললেন
নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে চাকরিহারাদের একাংশকে মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, ''কারো চাকরি যাবে না। আগে রাজ্য সরকার সুপ্রিম কোর্টের ব্যাখ্য়া চাইবে। সুপ্রিম কোর্টের নেতিবাচক উত্তর হলে সরকার যোগ্যদের নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বিকল্প ব্যবস্থা করে দেবে। দুই মাসের মধ্যে বিকল্প ব্যবস্থা করে দেবো।''
ছবি: Satyajit Shaw/DW
স্বেচ্ছাশ্রমের প্রস্তাব
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, ‘‘আপনারা কি এখনো বরখাস্তের নোটিস পেয়েছেন? (না পেয়ে থাকলে) চাকরি করুন না! স্বেচ্ছায় তো সকলেই কাজ করতে পারেন।’’ তিনি আরো বলেন, ''আপনাদের সরকার বরখাস্ত করেনি। আপনারা স্কুলে যান। কাজ করুন।'' কিন্তু স্বেচ্ছায় কাজ করলে বেতন পাওয়া যাবে কিনা, স্বেচ্ছায় কাজ করলে চুক্তিবদ্ধ শিক্ষকদের মতো অল্প বেতন দেয়া হবে কিনা, সে বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রী কিছু বলেননি।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
প্রতিবাদ
মুখ্যমন্ত্রীর স্বেচ্ছাশ্রমের বিষয়টি উপস্থিত চাকরিহারা শিক্ষকরা মেনে নিতে পারেননি। তাদের অনেকেই বলতে থাকেন, এভাবে হয় না, স্বেচ্ছাশ্রম বিষয়টির ব্যাখ্যা চাই। তবে তারা স্কুলে ফিরতে চান। তারা বলেন, বেতনসহ চাকরি রাখা হলে তারা স্কুলে ফিরবেন। তবে তারা চুক্তিভিত্তিক চাকরি করতে চান না।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
অযোগ্যদের চাকরির প্রসঙ্গে মমতা
এ বিষয়ে মমতা বলেন, ''অযোগ্যদের বিরুদ্ধে তথ্য-প্রমাণ পরীক্ষা করবো। অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হলে আমার কিছু বলার থাকবে না। কিন্তু অযোগ্য কাকে বলেছে, কেন বলেছে, কোন এজেন্সি বলেছে- সে সব দেখবো। নিশ্চিন্তে থাকুন। যোগ্য এবং অযোগ্যদের মধ্যে গন্ডগোল বাঁধাবেন না। মানুষকে শিক্ষা দিন। শিক্ষিত করুন। কারা যোগ্য, কারা অযোগ্য তা আদালত বলেনি। ২০২২ থেকে খেলা শুরু করেছে। আমি জেনে-শুনে কারো চাকরি খাইনি।''
ছবি: Satyajit Shaw/DW
অযোগ্যদের নিয়ে বক্তব্যের প্রতিবাদ
অযোগ্যদের নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর এই কথার প্রতিবাদ করেন সভায় উপস্থিত চাকরি হারানো শিক্ষকরা। তারা বলেন, অযোগ্যদের চাকরি দেয়া যাবে না। তাদের প্রশ্ন- যোগ্যদের তালিকা তিনি কি সুপ্রিম কোর্টে দেবেন? সুপ্রিম কোর্ট তো তালিকা দেবে না। দেবে এসএসসি। সিবিআই রিপোর্ট মানলে যোগ্য ও অযোগ্যদের তো আগেই আলাদা করা যেতো।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
চাকরিহারাদের দাবি
চাকরিহারা শিক্ষকদের অনেকেই বলেছেন, রাজ্য সরকার ও এসএসসির জন্য এখন তাদের এই অবস্থা। তারা যোগ্য ও অযোগ্য আলাদা করেনি। চাকরি হারানো যোগ্য শিক্ষকরা মনে করেন, মুখ্যমন্ত্রী সব গোলমাল পাকিয়েছেন।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
বিকাশ ভট্টাচার্য বনাম মমতা
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ''সিপিএমের কাছে প্রশ্ন করছি, কেন বিকাশ ভট্টাচার্য সব চাকরি বাতিল করালেন? তাকে আইসোলেট করুন।'' এর জবাবে বিকাশ ভট্টাচার্য বলেছেন, ''তিনি দুর্নীতি করেছেন। সকলে পেটাবে। মারের হাত থেকে বাঁচতে এসব বলছেন। তিনি বারবার যোগ্য অযোগ্য বলছেন। হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্টে তো বললেন না। রায়ের পর লম্ফঝম্প করছেন।''
ছবি: Srijit Roy
বিরোধী নেতার বক্তব্য
রাজ্যের বিরোধী দলীয় নেতা শুভেন্দু অধিকারী বলেছেন, ''সরকারের কাছে সুযোগ আছে চাকরি দেয়ার। সরকার রিভিশন পিটিশন করেছে। সরকার যোগ্যদের তালিকাটা ফেলে দিন। তাহলে দুধ ও জল আলাদা হবে। কোনো বিতর্ক থাকবে না। সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, সরকার ও এসএসসির অসহযোগিতার জন্য যোগ্য ও অযোগ্য বাছতে পারলাম না। তিনি (মমতা) যদি বলেন, সবাইকে চাকরি দিলাম ১০ হাজার টাকা করে দেবো. সেটা মানবো না।''
ছবি: Satyajit Shaw/DW
নবান্নর কাছে বিক্ষোভ
চাকরি না পাওয়া শিক্ষকদের একাংশ নবান্নর কাছে গিয়ে বিক্ষোভ দেখান। তাদের দাবি, যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও তারা কেন চাকরি পাবেন না তাদের বিক্ষোভ ছত্রভঙ্গ করে দেয় পুলিশ৷
ছবি: Satyajit Shaw/DW
সারা রাত চাকরিহারা শিক্ষকদের অপেক্ষা
নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে মুখ্যমন্ত্রীর সভায় যাবেন বলে কলকাতার বাইরে থেকে আসা শিক্ষকরা সারা রাত শহিদ মিনারের পাশে মাঠে ছিলেন। ‘যোগ্য’ লেখা কার্ড সংগ্রহ করে সকালে নেতাজি ইন্ডোরে যান তারা।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
ঢোকার সময় ঝামেলা
‘যোগ্য’ কার্ড না পাওয়ায় অনেক শিক্ষকই ইন্ডোর স্টেডিয়ামে ঢুকতে পারেননি। জোর করে ঢুকতে চাওয়ায় পুলিশের সঙ্গে ধস্তাধস্তিও হয় তাদের।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
12 ছবি1 | 12
শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু বলেন, "কোনো তালিকা প্রকাশ করা হবে না। এ বিষয়ে আইনি পরামর্শ নেয়া হচ্ছে। যারা যোগ্য শিক্ষক, তাদের কেউ স্কুলে যেতে বাধা দিচ্ছে না। বরং আবেদন করা হচ্ছে সকলে নিজের কাজ করুন। এভাবে আন্দোলন চালিয়ে গেলে আমরা যে রিভিউ পিটিশন করতে চলেছি, সেটাই দুর্বল হয়ে পড়বে।"
খাবার, জল বিতর্ক
রাতভর অবস্থান চালানোর পরেও মঙ্গলবার সকালে প্রচণ্ড গরমের মধ্যে আচার্য সদনের সামনে ভিড় পাতলা হয়নি। বেলা গড়ালেও ছবিটা একই ছিল। দপ্তরের দুটি গেট আঁকড়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন বিক্ষোভকারীরা। সোমবার থেকেই দপ্তরে আটকে স্কুল সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান সিদ্ধার্থ মজুমদার। তার সঙ্গে আটকে পড়েছেন কমিশনের কয়েকজন কর্মী। এর মধ্যে চারজন মহিলা কর্মী আছেন বলে সূত্রের খবর।
সিদ্ধার্থ ও অন্যান্য কর্মীদের জন্য সোমবার রাতে যে খাবার বাইরে থেকে আনানো হয়, তা ভিতরে নিয়ে যেতে দেয়া হয়নি। সেগুলি কেড়ে বিক্ষোভকারীরা নষ্ট করে ফেলেন বলে অভিযোগ ওঠে। একইভাবে সকালের চা থেকে খাবার ও জল সদনের ভিতরে নিতে বাধা দেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ।
বিধান নগর পুলিশ কমিশনারেটের ডিসি অনীশ সরকার বলেন, "ভিতরে খাবার জল নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বাধা তৈরি করা হচ্ছে। পুলিশ কর্মীদের আসা-যাওয়ার পথে ধাক্কাধাক্কি করা হয়েছে। ভিতরে যারা আছেন, তারা সরকারি কর্মী। যারা বাইরে বিক্ষোভ করছেন, তারা শান্তিপূর্ণভাবে অবস্থান করতে পারেন। কিন্তু বেআইনি কাজ করা ঠিক নয়।"
যোগ্য শিক্ষক-শিক্ষিকা অধিকার মঞ্চের পক্ষ থেকে চিন্ময় মণ্ডল বলেন, "এদিন খাবার, জল সবই দপ্তরের ভিতরে গিয়েছে। কেউ অসুস্থ হয়ে পড়ুন, এটা আমরা চাই না। কিন্তু আমাদের যে ন্যূনতম প্রয়োজন, তার ব্যবস্থা এখানে করা হয়নি। খাবার, জল দেয়া দূরের কথা।"
গ্রুপ সি ও গ্রুপ ডি শিক্ষাকর্মীদের চাকরি বাতিল হয়ে গিয়েছে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে। শিক্ষকদের একাংশ সাময়িক স্বস্তি পেলেও শিক্ষাকর্মীদের সামনে কোনো আশার আলো নেই। এই শিক্ষাকর্মীরা মধ্যশিক্ষা পর্ষদের সামনে ধরনায় বসেছেন। ভিতরে আটকে পড়েছেন পর্ষদ সভাপতি থেকে কর্মীরা। এই শিক্ষাকর্মীদের বক্তব্য, শিক্ষকদের মতো তাদেরও যোগ্য-অযোগ্য ভেদাভেদ করতে হবে।
রায়ের পরে অপেক্ষা
গত ১১ এপ্রিলের নির্দেশে এসএসসির ২০১৬ সালের নিয়োগ প্যানেল অনুসারে ‘দাগি' নন এমন শিক্ষকদের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত স্কুলে যাওয়ার অনুমতি দেয় সর্বোচ্চ আদালত। তবে গ্রুপ সি ও গ্রুপ ডি শিক্ষাকর্মীদের জন্য আগের রায়ই বহাল থেকে যায়, তাই তারা স্কুলে যেতে পারছেন না। শিক্ষকরা স্কুলে যাওয়ার ক্ষেত্রে ছাড়পত্র পেলেও চিহ্নিত দাগিদের নাম প্রকাশ্যে না আসায় কারা স্কুলে যাবেন, তা নিয়ে ধোঁয়াশা ছিল। দাগি অর্থাৎ যে প্রার্থীরা নিয়োগের ক্ষেত্রে কারচুপি করেছিলেন বলে সিবিআই তদন্তে উঠে এসেছে। এই প্রার্থীদের সংখ্যা ছয় হাজারের কিছু বেশি। এরা স্কুলে যাওয়া দূরের কথা, নতুন নিয়োগের পরীক্ষাও দিতে পারবেন না।
শীর্ষ আদালতের নির্দেশে ২৬ হাজার শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীর চাকরি চলে যাওয়ায় রাজ্যের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের স্কুলগুলি গভীর সঙ্কটে পড়ে। তাই আদালতে মডিফিকেশন অ্যাপ্লিকেশন দাখিল করে রাজ্য সরকার। পড়ুয়াদের পঠনপাঠন যাতে ব্যাহত না হয়, সেটা মাথায় রেখে যোগ্য চাকরি হরাদের সাময়িক স্বস্তি দেয় আদালত। সুপ্রিম কোর্ট চলতি বছর পর্যন্ত তাদের কাজে বহাল রেখে বলে, মে মাসের মধ্যে বিজ্ঞাপন দিয়ে নয়া নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। নতুন বছর থেকে পরীক্ষার ভিত্তিতে শিক্ষকরা নিয়োগ পাবেন।
প্রশ্নের মুখে প্রাথমিক
প্রাথমিক স্তরে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকদের ভবিষ্যতের উপরে প্রশ্নচিহ্ন ঝুলে রয়েছে। এনিয়ে মামলা চলছে কলকাতা হাইকোর্টে।
আদালত সূত্রে খবর, আগামী ২৮ এপ্রিল প্রাথমিকের ৩২ হাজার শিক্ষকের চাকরি বাতিলের মামলায় শুনানি হতে পারে। সোমবার এ ব্যাপারে বিচারপতি তপোব্রত চক্রবর্তীর ডিভিশন বেঞ্চের দৃষ্টি আকর্ষণ করে মামলাকারীরা।
গত ৭ এপ্রিল চাকরি বাতিলের মামলার শুনানি হওয়ার কথা ছিল হাইকোর্টের বিচারপতি সৌমেন সেনের ডিভিশন বেঞ্চে। কিন্তু ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে মামলা থেকে অব্যাহতি নেন বিচারপতি। মামলা চলে যায় হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি টিএস শিবজ্ঞানমের কাছে। এবার অন্য বিচারপতির বেঞ্চে শুনানি হতে চলেছে।