এর আগে একাধিকবার হামলা হলেও প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন কান্দাহার পুলিশের প্রধান৷ আফগানিস্তানে তালিবানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের লড়াইয়ে অন্যতম ব্যক্তি ছিলেন তিনি৷ তাঁর বিরুদ্ধে রয়েছে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগও৷
বিজ্ঞাপন
কান্দাহারের গভর্নরের এক দেহরক্ষীর গুলিতে বৃহস্পতিবার নিহত হয়েছেন আফগানিস্তানের অন্যতম ক্ষমতাশালী নিরাপত্তা কর্মকর্তা জেনারেল আবদুল রাজিক৷
শীর্ষ পর্যায়ের এক নিরাপত্তা বৈঠক শেষে এ ঘটনা ঘটে৷ বৈঠকে আফগানিস্তান মিশনে মার্কিন বাহিনী ও ন্যাটোর যৌথ কমান্ডার জেনারেল স্কট মিলার, কান্দাহারের গভর্নর জালমায় ওয়েসা এবং কান্দাহারের প্রাদেশিক গোয়েন্দা বাহিনীর প্রধান আবদুল মোহমিনও উপস্থিত ছিলেন৷
হামলায় রাজিক ছাড়াও মোহমিন এবং এক আফগান সাংবাদিক মারা গেছেন বলেও জানা গেছে৷
মিলারের শরীরে কোনো আঘাত না লাগলেও আহত ১৩ জনের মধ্যে দুই অ্যামেরিকান ও গভর্নর রয়েছেন৷
ঘটনার পরপরই দায় স্বীকার করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিবৃতি দিয়েছে তালিবান৷ তাদের দাবি, মিলার এবং রাজিকই ছিলেন হামলার মূল লক্ষ্য৷ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘‘অন্য কয়েকজন কর্মকর্তার সাথে কান্দাহারের নৃশংস পুলিশ প্রধানও নিহত হয়েছেন৷’’
আফগানিস্তানে কয়েক মাস ধরে চলা খরায় মানবিক সংকটের সৃষ্টি হয়েছে৷ জাতিসংঘের তথ্য মতে, দেশটিতে এ বছর সরকারি বাহিনীর সঙ্গে তালেবানের যুদ্ধের কারণে যত মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন, তার চেয়ে অনেক বেশি মানুষ ঘর ছেড়েছেন খরার কারণে৷
ছবি: Getty Images/AFP/H. Hashimi
খাবার সংকটে ৩০ লাখ
আফগানিস্তানে খরার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় ৩০ লাখ মানুষ চরম খাবার সংকটে রয়েছে জানিয়ে জাতিসংঘ বলছে, এই মানুষগুলো সহায়তা না পেলে দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে৷
ছবি: Imago/Xinhua/S. Mominzadah
আক্রান্ত উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল
তীব্র খরায় আফগানিস্তানের উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলের আড়াই লাখের বেশি মানুষ নিজেদের ঘর-বাড়ি ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন৷ হেরাতসহ বিভিন্ন শহরের উপকণ্ঠে তাঁবু গেড়ে ঠাঁই নিয়েছেন তাঁরা৷
ছবি: Getty Images/AFP/H. Hashimi
বৃষ্টি নেই বছরের বেশি
হেরাতের একটি আশ্রয় শিবিরে চার সন্তান নিয়ে আসা উত্তরের ফারইয়াব প্রদেশের এক নারী বলেন, এক বছরের বেশি সময় ধরে তাঁদের এলাকায় বৃষ্টি হয় না৷ সবকিছু শুকিয়ে গেছে৷ ‘‘ছেলে-মেয়েদের খাওয়ানোর মতো পানিও আমাদের নেই৷ এর উপর আবার আর্মির সঙ্গে তালেবানের লড়াই চলছে৷ ভয়াবহ অবস্থা৷’’
ছবি: AFP/Getty Images/F. Usyan
৮০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে তীব্র খরা
বাদগিস প্রদেশের ঘোরমাচ জেলা থেকে পরিবার নিয়ে আশ্রয় শিবিরে আসা ৮০ বছরের মুরাদ খান ইশাকজাই এএফপিকে জানান, জীবনে দ্বিতীয়বার ঘর ছেড়েছেন তিনি৷ ১৫ বছর আগে একবার খরার কারণে স্বল্প সময়ের জন্য বাড়ি ছেড়েছিলেন তিনি৷ তবে এবারই ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে সবচেয়ে বেশি৷ খেত, ফসল সব নষ্ট হয়ে গেছে৷ ‘‘এটা আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে খারাপ অবস্থা,’’ বলেন তিনি৷ এই পরিস্থিতিতে অন্য জায়গা থেকে কনটেইনারে পানি নিয়ে চলছে জীবন৷
ছবি: Imago/Xinhua/S. Mominzadah
যুদ্ধকেও ‘হার মানিয়েছে’
হেরাতের শিবিরে ছয় সন্তান নিয়ে আশ্রয় নেওয়া নব খান জামানজাই বলেন, ‘‘কয়েক বছর ধরে চলা যুদ্ধকে আমরা এত বড় করে দেখিনি৷ আমরা ভালোই ছিলাম, চাষাবাদ নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম৷ কিন্তু খরার কারণে আমাদের ছেলে-মেয়েরা না খেয়ে আছে৷’’
ছবি: Getty Images/AFP/F. Usyan
খাবার জুটছে একবেলা
আফগানিস্তানে জাতিসংঘের মানবিক ত্রাণ সহায়তা সমন্বয়ক টোবি লানজের বলেন, বাস্তুচ্যুত এসব মানুষ দিনে মাত্র একবেলা খেয়ে কোনো রকমে বেঁচে আছেন৷ পরিস্থিতি তাঁদের ধারণার চেয়ে অনেক খারাপ৷ সামনের শীত মৌসুমে অবস্থা আরো খারাপের দিকে যেতে পারে৷
ছবি: Getty Images/AFP/H. Hashimi
শুধু রুটি আর চা
শিবিরে আশ্রয় নেওয়া অনেকে এএফপিকে বলেছেন, সঙ্গে যতটুকু আনা সম্ভব তাই নিয়ে রওনা দিলেও পথে তা-ও খোয়া গেছে৷ এখন টাকা-পয়সা হাতে নেই৷ মাসের পর মাস রুটি আর চা খেয়ে টিকে থাকতে হচ্ছে তাঁদের৷
ছবি: Getty Images/AFP/H. Hashimi
বিপদে লক্ষাধিক শিশু
জাতিসংঘের মানবিক ত্রাণ সহায়তা সমন্বয় দপ্তর-ওসিএইচএ’র ভাষ্যমতে, শিবিরগুলোতে আশ্রয় নেওয়া প্রায় এক লাখ ৪০ হাজার শিশুর জরুরি খাদ্য সহায়তা দরকার৷ এদের অধিকাংশই দেশটির পশ্চিমাঞ্চলের এবং তাঁদের মধ্যে পাঁচ বছরের কম বয়সি ৩৩ হাজার ২০০ শিশুর ‘জীবনরক্ষাকারী’ চিকিৎসা দরকার৷
ছবি: Getty Images/AFP/H. Hashimi
8 ছবি1 | 8
দেহরক্ষীই হত্যাকারী
কান্দাহার থেকে নির্বাচিত আফগান পার্লামেন্টারিয়ান খালিদ পশতুন ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, হামলাকারী সবার আগে রাজিককেই গুলি করে৷ তিনি বলেন, ‘‘বৈঠক শেষ হওয়ার পর কর্মকর্তারা যখন একজন আরেকজনের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছিলেন, তখন গভর্নরের এক দেহরক্ষী গুলি চালায়৷’’
তিনি বলেন, ‘‘জেনারেল রাজিককে সবার আগে গুলি করা হয়৷ প্রাদেশিক গভর্নর, গোয়েন্দা প্রধান এবং এই অঞ্চলের সামরিক কমান্ডারও ছিলেন হামলার লক্ষ্য৷’’
২০১১ সাল থেকে কান্দাহার পুলিশের প্রধানের দায়িত্ব পালন করছেন রাজিক৷ একটি গোপন নির্যাতন কেন্দ্র পরিচালনাসহ নানা ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে৷ ২০১৭ সালে জাতিসংঘের নির্যাতনবিরোধী কমিটি নির্যাতন ও গুমের অভিযোগে জেনারেল রাজিকের বিচারের আহ্বান জানায়৷ তবে রাজিক বরাবরই এসব অভিযোগ অস্বীকার করে এসেছেন৷
গত বছর এক হামলায় কান্দাহারে সংযুক্ত আরব আমিরাতের পাঁচ কূটনীতিক প্রাণ হারান৷ রাজিক সে হামলায় অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান৷
আফগানিস্তানে অফুরন্ত ক্ষমতার লড়াই
২০০১ সালে আফগানিস্তানকে তালেবানমুক্ত করতে অভিযান শুরু করেছিল যুক্তরাষ্ট্র৷ কিন্তু এখনও শান্ত হয়নি দেশটি৷ বরং গত কয়েকমাসে জঙ্গি হামলা আরও বেড়েছে৷
ছবি: picture alliance/Photoshot
ঠুনকো নিরাপত্তা
গত কয়েকমাসে বিভিন্ন হামলায় শত শত লোক হতাহত হয়েছেন৷ ফলে দেশের নিরাপত্তা নিয়ে সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়েছে৷ এছাড়া জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সরকারের সীমাবদ্ধতার বিষয়টিও উঠে এসেছে৷
ছবি: Reuters/M. Ismail
চাপে সরকার
তথাকথিত ইসলামিক স্টেট বা আইএস এবং তালেবানসহ বিভিন্ন জঙ্গি গোষ্ঠী হামলার দায় স্বীকার করছে৷ এসব গোষ্ঠীর হাতে থাকা বিভিন্ন অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেতে সরকারের উপর চাপ বাড়ছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/M. Hossaini
ঘোষণা দিয়ে হামলা শুরু
গতসপ্তাহে ঘোষণা দিয়ে তালেবান বসন্তকালীন হামলা শুরু করেছে৷ দেশটিতে কঠোর ইসলামি শাসন চালু করতে চায় তারা৷ আফগানিস্তান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র গতবছর আরও আক্রমণাত্মক পরিকল্পনা ঘোষণা করার প্রতিক্রিয়ায় এমন হামলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানিয়েছে তালেবান৷
ছবি: Reuters
মার্কিন নীতি
নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আফগানিস্তানে আরও মার্কিন সেনা মোতায়েনের চিন্তা করছেন৷ এই সেনারা আফগান সেনাদের প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ দেয়ার কাজ করবে৷ এছাড়া যতদিন প্রয়োজন হবে ততদিন সেখানে মার্কিন উপস্থিতি থাকবে বলেও জানান ট্রাম্প৷
ছবি: Getty Images/AFP/B. Smialowski
শান্তি প্রক্রিয়া
ফেব্রুয়ারি মাসে ‘কোনো শর্ত ছাড়াই’ আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি তালেবানের সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছিলেন৷ কিন্তু জঙ্গি গোষ্ঠীটি সে ব্যাপারে কোনো আগ্রহ দেখায়নি৷ তাদের অভিযোগ, আলোচনার প্রস্তাব একটি ‘ষড়যন্ত্র’৷ বিশ্লেষকরা বলছেন, ময়দানে তালেবান এখন সুবিধাজনক অবস্থায় আছে বলে তারা আলোচনায় বসতে রাজি হচ্ছে না৷ বর্তমানে তালেবানের হাতে ২০০১ সালের পর সবচেয়ে বেশি আফগান জেলার নিয়ন্ত্রণ রয়েছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/N. Shirzad
পাকিস্তানের সমর্থন
আফগানিস্তানে হামলার জন্য দায়ী জঙ্গিরা পাকিস্তানে নিরাপদে আস্তানা গড়তে পারে বলে কাবুল ও ওয়াশিংটনের অভিযোগ৷ তবে পাকিস্তান সবসময় তা অস্বীকার করে এসেছে৷ কাবুল ও ইসলামাবাদ সবসময় একে অপরের বিরুদ্ধে তাদের দেশের জঙ্গিদের আশ্রয় দেয়ার অভিযোগ করে থাকে৷
ছবি: DW/H. Hamraz
অকার্যকর সরকার
ক্ষমতার অফুরন্ত লড়াইয়ের মাঝে জনমত সমীক্ষায় প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনির জনপ্রিয়তা ক্রমেই কমছে৷ আফগান সরকারের দুর্নীতি ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় গড়ে ওঠা জাতীয় ঐকমত্যের সরকারের কারণে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের চেষ্টা ব্যাহত হচ্ছে৷
ছবি: Reuters/K. Pempel
7 ছবি1 | 7
হুমকির মুখে নির্বাচন
এই হামলায় শনিবার অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া নির্বাচনে ব্যাপক প্রভাব পড়বে বলে আশংকা বিশ্লেষকদের৷ তালিবান অনেক আগে থেকেই নির্বাচন প্রতিহতের ঘোষণা দিয়ে এসেছে৷ দেশটির পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষের ২৪৯ আসনের জন্য নির্বাচনে লড়ছেন প্রায় আড়াই হাজার প্রার্থী৷ নির্বাচনের প্রচারণা চালানোর সময় এঁদের ১০ জন বিভিন্ন হামলায় নিহত হয়েছেন৷
কান্দাহারের হামলার পর এক জ্যেষ্ঠ নিরাপত্তা কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ‘‘জেনারেল রাজিকের মৃত্যু দক্ষিণের নির্বাচনে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে৷ ভোটাররা হয়তো আর নিরাপদ বোধ করবেন না৷’’
মার্কিন সেনাবাহিনী অবশ্য বলছে, এই হামলায় তালিবানকে আলোচনার টেবিলে নিয়ে আসার চেষ্টা এবং দেশটিতে তাঁদের সেনা উপস্থিতিতে কোনো প্রভাব ফেলবে না৷ মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র লেফট্যানেন্ট কর্নেল ফকনার বলছেন, ‘‘এই হামলায় আমাদের দক্ষিণ এশিয়া নীতি পরিবর্তন হবে না৷ বরং এর ফলে আমরা এখন আরো দৃঢ়প্রতিজ্ঞ৷’’
মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী জিম ম্যাটিস রাজিকের মৃত্যুকে ‘দেশপ্রেমিকের মৃত্যু’ বলে আখ্যা দিয়েছেন৷ তবে এই হামলায় কান্দাহারের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় প্রভাব পড়ার আশংকাও ব্যক্ত করেছেন তিনি৷
পাশাপাশি তিনি বলেন, ‘‘আমরা খুঁজে বের করবো কারা এই হত্যার জন্য দায়ী৷ তবে এই মুহূর্তে আমরা নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে আছি৷ আফগান জনগণকে রক্ষায় আমরা কাজ চালিয়ে যাবো৷’’