সরকার কিংবা তালেবান কেউই আফগানিস্তানে যুদ্ধ জেতার মতো অবস্থায় নেই৷ কিন্তু দুই পক্ষের মধ্যে শান্তি চুক্তি হলে দেশটিতে ইতিমধ্যে বিদ্যমান নাজুক পরিস্থিতির আরও অবনতি হবে, বলে মনে করছেন ডয়চে ভেলের ফ্লোরিয়ান ভাইগান্ড৷
ছবি: DW/S. Tanha
বিজ্ঞাপন
পালিয়ে যেতে চাওয়ায় এক তরুণ দম্পতিকে চাবুক মারা হয়েছে, ব্যাভিচারের অভিযোগে আরেক তরুণকে পাথর ছুঁড়ে মারা হয়েছে, কাবুলসহ দেশের অন্যান্য স্থানে তিনটি হামলায় ৩৫ জন নিহত হয়েছেন, একটি বাস থামিয়ে কয়েক ডজন যাত্রীকে অপহরণ করা হয়েছে – আফগানিস্তানে গত এক সপ্তাহের খবর এগুলো৷
তবে সেই সপ্তাহটি যে অস্বাভাবিক ছিল, তা নয়৷ বরং এই সহিংসতা যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশটির অতীতকে মনে করিয়ে দিচ্ছে৷ ২০১৮ সালে এখন পর্যন্ত ১৮ হাজারের বেশি আফগান ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়েছেন৷ রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ থেকে বাঁচতে প্রতিদিন প্রায় ৩৮০ জন সাধারণ মানুষ পালাচ্ছেন৷
এরকম নিষ্ঠুর পরিস্থিতিতে কেউ আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনির মতের সঙ্গে এতদিন দ্বিমত পোষণ করতে চাইতেন না৷ কারণ তিনি তালেবানকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ভাবতেন৷ বুধবারের আগ পর্যন্ত তিনি শুধু সেইসব তালেবানের সঙ্গে আলোচনা করতে চাইতেন, যারা অস্ত্র ত্যাগ করতে রাজি ছিলেন৷ কিন্তু বুধবার কাবুলে আয়োজিত শান্তি সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট গনি জানান, তিনি ‘কোনো শর্ত ছাড়াই' তালেবানের সঙ্গে শান্তি চুক্তি বিষয়ক আলোচনা করতে চান৷ এমনকি এই জঙ্গি সংগঠনকে তিনি ‘রাজনৈতিক দল' হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার অঙ্গীকার করছেন৷ আটক তালেবান যোদ্ধাদের মুক্তি দেয়ার বিষয়টিও তিনি ভেবে দেখছেন৷ দেশের সংবিধান ‘সংস্কার' এর বিষয়টিও প্রেসিডেন্ট উড়িয়ে দিচ্ছেন না৷
শুরুতে প্রেসিডেন্ট গনির এই ‘ইউ-টার্ন' বিস্ময়কর মনে হতে পারে৷
তালেবান: যাদের কারণে চাপের মুখে পাকিস্তান
ট্রাম্পের টুইটের পর হোয়াইট হাউস স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে যে, পাকিস্তানকে সামরিক সহায়তা বন্ধ করার অন্যতম কারণ, পাকিস্তান তালেবান জঙ্গিদের সাহায্য করছে৷ কিন্তু কেন? পাকিস্তানের রাজনীতির সঙ্গে তালেবানের সম্পর্কই বা কী?
ছবি: Majid Saeedi
গোড়ার কথা
১৯৭৮ থেকে ’৯২ সালের মধ্যবর্তী সময়ে আফগানিস্তানে ব্যাপক অভিযান চালিয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন৷ পাশতুন জনজাতির যোদ্ধারা সে সময় রাশিযার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল৷ পরবর্তীকালে তারাই তালেবান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে৷ রাশিয়াকে ঠেকাতে সেই সময় পাকিস্তান এবং অ্যামেরিকা তালেবানকে সাহায্য করে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/AP/A. Khan
গৃহযুদ্ধ এবং তালেবান
১৯৯২ থেকে ’৯৬ সালের মধ্যবর্তী সময়ে আফগানিস্তানে গৃহযুদ্ধ সংঘটিত হয়৷ সেই সময় তালেবান ত্রমতার কাছাকাছি পৌঁছে যায়৷ অভিযোগ, তালেবানদের সেই উত্থানেও পাকিস্তান সাহায্য করেছিল৷ বস্তুত, বিস্তীর্ণ আফগানিস্তান জুড়ে তালেবান যে সরকার গঠন করেছিল, কেবল পাকিস্তান, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত তাদের স্বীকৃতি দিয়েছিল৷ বিশ্বের অন্য কোনও দেশ তালেবান সরকারকে সমর্থন দেয়নি৷
ছবি: Majid Saeedi
৯/১১ এবং মার্কিন সৈন্য
নিউ ইয়র্কের টুইন টাওয়ারে আল কায়দা হামলা চালানোর পর অ্যামেরিকা আল কায়দা এবং তালেবানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে৷ আফগানিস্তানে পৌঁছায় মার্কিন সৈন্য৷ আফগানিস্তানের হামিদ কারজাই সরকারকে সমর্থন জানায় অ্যামেরিকা এবং ন্যাটো বাহিনী৷ বিশ্বের অন্যান্য দেশের সৈন্যরাও ন্যাটোর ছত্রছায়ায় তালেবানবিরোধী লড়াইয়ে শামিল হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
পাকিস্তানের লাভ
বিশেষজ্ঞদের মতে, পাকিস্তানের প্রথম এবং প্রধান শত্রু আফগান তালেবান নয়, ভারত৷ এ কারণে ভারতের বিরুদ্ধে ‘প্রক্সি’ যুদ্ধ চালানোর জন্য তালেবান জঙ্গিদের পাকিস্তানের প্রয়োজন৷ ভারত বহুবার অভিযোগ করেছে যে, সীমান্তে আটক করা জঙ্গিদের সঙ্গে তালিবান যোগ আছে৷ তালিবান পাকিস্তানেই প্রশিক্ষণ নেয় বলেও অভিযোগ করে আসছে ভারত৷
ছবি: Getty Images/AFP/N. Shirzad
অন্য কূটনীতি
কোনো কোনো বিশেষজ্ঞের মতে, মার্কিন সৈন্য আফগানিস্তান ছাড়লে আফগানিস্তানের মৌলবাদী সংগঠনগুলির সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হলে পাকিস্তানকে পশ্চিমের সীমান্ত নিয়ে ভুগতে হতে পারে৷ তাই তালেবান প্রশ্নে ‘কৌশলগত’ অবস্থান নিতে হয় পাকিস্তানকে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/A. Naveed
পাকিস্তানেও তালেবান হামলা
গত এক দশকে পাকিস্তানের রাজনৈতিক স্থিতাবস্থা নষ্ট করতে একের পর এক আক্রমণ চালিয়েছে জঙ্গিরা৷ পাঁচ তারা হোটেল থেকে ভলিবল স্টেডিয়াম, বাজার থেকে সামরিক ঘাঁটি সর্বত্রই হামলা হয়েছে৷ বারবারই আঙুল উঠেছে তালেবানের দিকে৷ অভিযোগ, এতৎসত্ত্বেও পাকিস্তান তালিবানের প্রতি নরম থেকেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/A. Ali
মার্কিন হুমকি
ভারতসহ বেশ কিছু দেশ বার বার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দ্বিচারিতার অভিযোগ তুলেছে৷ এতদিনে অ্যামেরিকা সে অভিযোগে শিলমোহর দিল৷ ডোনাল্ড ট্রাম্পের টুইটের পর হোয়াইট হাউস জানিয়ে দিলো যে, পাকিস্তানকে তারা আর কোনও সামরিক সহায়তা দেবে না, কারণ, সন্ত্রাস প্রশ্নে পাকিস্তানের ভূমিকা স্পষ্ট নয়৷
ছবি: Reuters/K. Lamarque
7 ছবি1 | 7
সাম্প্রতিক সময়ে আফগান সরকার ও তালেবান খুব চাপের মধ্যে ছিল৷ যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে সামরিক সহায়তা পাওয়ার পরও আফগান নিরাপত্তা বাহিনী তালেবানের কাছে বিভিন্ন এলাকার নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছিল৷
অন্যদিকে, তালেবান পাকিস্তানের সমর্থন হারানোর আশংকায় ছিল৷ কারণ যুক্তরাষ্ট্র ক্রমাগত তালেবানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পাকিস্তানকে চাপ দিচ্ছিল৷
ফলে এখন পর্যন্ত মনে হচ্ছে, কোনো পক্ষেরই যুদ্ধে জেতার সম্ভাবনা নেই৷ এটি শান্তি খোঁজার পক্ষে একটি সুযোগ৷
তালেবান বুঝতে পেরেছে, সমস্যার সমাধানের চাবি আছে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে৷ তাই তারা কাবুলের সঙ্গে আলোচনায় না বসে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কথা বলতে চায়৷
এদিকে, আফগানিস্তান বিষয়ক জার্মানির বিশেষ প্রতিনিধি ও কাবুলে জার্মানির সাবেক রাষ্ট্রদূত মার্কুস পোটৎসেল বন শহরে আফগানিস্তান বিষয়ক তৃতীয় সম্মেলন আয়োজনের প্রস্তাব দিয়েছেন৷ এর আগে ২০০১ ও ২০১১ সালে বন শহরে এরকম সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছিল৷
ফ্লোরিয়ান ভাইগান্ড, ডয়চে ভেলে
এ সব বিবেচনায় মনে হচ্ছে, একটি শান্তি চুক্তি হয়ত আসন্ন৷ কিন্তু বিশ্ব সম্প্রদায় কি তার মূল্য চোকাতে প্রস্তুত?
যুদ্ধপরবর্তী সময়ে তালেবানকে যদি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হয় তাহলে দেশটির রাজনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে পশ্চিমা বিশ্ব যেসব লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল তার বেশিরভাগ থেকে সরে আসতে হবে৷
গত এক সপ্তাহে আফগানিস্তানে সহিংসতার যে উদাহরণগুলো উপরে দেয়া হয়েছে তাতে তালেবানের কাছে সমাজের সংজ্ঞা কী, তা সবার কাছে স্পষ্ট হওয়ার কথা৷
এটা মনে করার কারণ নেই যে, এখনকার তালেবান ওয়ান ইলেভেনের আগের তালেবানের চেয়ে আলাদা৷ আর এই তথ্য লিবারেল বিশ্বের কাজকে অসম্ভব করে তুলবে৷
তালেবান যদি আফগান সরকারের বৈধ অংশীদার হয় তাহলে ইউরোপের সরকারগুলো, জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো কীভাবে করদাতাদের বোঝাবে যে, আফগানিস্তানের উন্নয়নে সহায়তা করা চালিয়ে যাওয়া উচিত?
সুতরাং তালেবানের সঙ্গে সম্ভাব্য শান্তি চুক্তি উত্তরের চেয়ে বেশি প্রশ্নই সামনে নিয়ে আসছে৷
ফ্লোরিয়ান ভাইগান্ড/জেডএইচ
সংবাদভাষ্যটি কেমন লাগলো লিখুন নীচের ঘরে৷
পাকিস্তানে তালেবান
ছবি: picture-alliance/ dpa
তালেবান নিয়ন্ত্রণে সোয়াত
নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে শান্তি চুক্তির প্রেক্ষিতে সোয়াত উপত্যকার নিয়ন্ত্রণ অনেকটাই চলে যায় তালেবান এর হাতে৷ ছবিতে একটি দালানের ছাদে সেনা চৌকি দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: picture alliance / landov
সোয়াত উপত্যকায় শরীয়া আইন
সোয়াতে শরীয়া আইন চালুর পর এক ধর্মীয় নেতা জনগণের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখছেন৷ ছবিটি ১৯ এপ্রিল তোলা৷
ছবি: dpa/picture-alliance
মিংগোরা থেকে সড়ে যাচ্ছে সাধারণ মানুষ
তালেবান এবং নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষের প্রেক্ষিতে সোয়াত উপত্যকার রাজধানী মিংগোরা ছেড়ে চলে যাচ্ছে সাধারণ মানুষ৷ ছবিটি ৫ মে তোলা৷
ছবি: AP
মানচিত্রে সোয়াত
মানচিত্রে হলুদ রংএ সোয়াত উপত্যকাকে চিহ্নিত করা হয়েছে৷
ছবি: GFDL / Pahari Sahib
সোয়াতে নিরাপত্তা চৌকি
সোয়াত উপত্যকায় একটি নিরাপত্তা চৌকির কাছে দাঁড়িয়ে আছে পাকিস্তানি সেনা৷ ছবিটি ২৭ এপ্রিল তোলা৷