আফগানিস্তানে তালেবান ফেরায় বাংলাদেশ এবং দক্ষিণ এশিয়ার দেশ গুলোতে কী প্রভাব পড়বে? রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক প্রভাবের কি বিশেষ কোনো দিক আছে?
বিজ্ঞাপন
আফগানিস্তানে এই পরিবর্তন বাংলাদেশ সতর্কভাবে লক্ষ্য করছে৷ বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন এরইমধ্যে সতর্ক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন৷ তিনি বলেছেন, ‘‘নতুন যে সরকারই আসুক, সেটা যদি জনগণের সরকার হয়, তাহলে আমরা তাকে গ্রহণ করবো৷'' তবে বাংলাদেশ আফগানিস্তান থেকে কোনো শরণার্থী গ্রহণের মার্কিন প্রস্তাব সরাসরি নাকচ করে দিয়েছে৷''
বাংলাদেশের সব শ্রেণির মানুষের মধ্যেই এই পরিবর্তন নিয়ে আছে ব্যাপক আগ্রহ৷ বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করা হচ্ছে নানামুখী মতামত৷ কেউ কেউ উল্লাসও প্রকাশ করছেন৷ সংবাদমাধ্যম গুরুত্বের সাথে খবর পরিবেশনের পাশাপাশি নানা ধরনের মতামত ও বিশ্লেষণ প্রকাশ করছে৷
বাংলাদেশের পুলিশ এরইমধ্যে সতর্ক অবস্থানে আছে, যাতে এখানে জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিতে না পারে, কেউ যেন আফগাস্তিানে গিয়ে তালেবানে যোগ দিতে না পারে তার ওপর নজর রাখছে৷ যদিও পুলিশ কমিশনার সফিকুল ইসলাম কয়েকজনের আফগানিস্তান যাওয়ার কথা বলেছেন৷ বাংলাদেশের কিছু তরুণের অতীতে আফগান ‘জিহাদে' অংশ নেয়ার রেকর্ড আছে৷ তারা বাংলাদেশে ফিরে জঙ্গি দলও গঠন করেছিল৷
মেজর জেনারেল (অব.) এ এন এম মুনিরুজ্জামান
বাংলাদেশের নিরাপত্তা বিশ্লেষক এবং ইনস্টিটিউট অব পিস অ্য্যান্ড সিকিউরিটি স্ট্যাডিজ-এর প্রধান মেজর জেনারেল (অব.) এ এন এম মুনিরুজ্জামান মনে করেন, ‘‘যদি আফগানিস্তানে কোনো গৃহযুদ্ধ হয়, তাহলে সেখানে যে ধরনের নিরাপত্তা পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে তার প্রভাব বাংলাদেশসহ পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় পড়বে৷ বিশেষ করে তাদের প্রতিবেশী দেশগুলোর ওপর মানবিক বিপর্যয়ের প্রভাব পড়বে৷ এর সম্ভাবনা আছে৷ বাংলাদেশের বড় উদ্বেগের বিষয় হলো সোভিয়েত সমর্থিত সরকারবিরোধী বিপ্লবে বাংলাদেশিরা সেখানে গিয়ে তালেবানের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে জিহাদ করেছে৷ সেই পুরনো অভিজ্ঞতা থেকে আশঙ্কা করি তারা হয়ত এখানে যদি তাদের সঙ্গে তালেবানের আবার যোগাযোগ হয় তাহলে নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি হতে পারে৷ আর সেটা যদি না-ও হয় তাহলেও দেখতে পাচ্ছি যে, এখন জঙ্গি গোষ্ঠিগুলো আবার উজ্জীবিত হতে পারে৷''
তার মতে, এই প্রভাব ভারত ও পাকিস্তানেও পড়বে৷ তবে শ্রীংলঙ্কা আর নেপালের সাথে তালেবানের আগে কোনো যোগাযোগ না থাকায় প্রভাব পড়ার আশঙ্কা নাই৷
বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ, বিশেষ করে আফগান ফেরত ‘জিহাদীদের' নিয়ে গভীরভাবে কাজ করেছেন সিনিয়র সাংবাদিক জায়েদুল আহসান পিন্টু৷ তিনি মনে করেন, ‘‘বাংলাদেশের আতঙ্কের বিষয় হলো এখন আফগানিস্তানে জঙ্গিবাদের ব্রিডিং সেন্টার হয় কিনা৷ কারণ, বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ আফগানিস্তান ও পকিস্তানের সীমান্ত হয়েই এসেছে৷ কিন্তু হোলি আর্টিজান হামলার পর বাংলদেশে জঙ্গিদের কঠোর হাতে দমন করা হয়েছে৷ এখানে তাদের এখন আর তেমন কোনো শক্তি নাই৷''
তিনি বলেন, ‘‘তালেবান এখন আন্তর্জাতিক সমর্থন চাইছে৷ তারা এখন নারী অধিকার, সংবাদমাধ্যমের কথা বলছে৷ তবে তা ইসলামি শরিয়ার অধীনে৷ সেটা কেমন হয় তা দেখার আছে৷ তারা আদৌ তাদের চরিত্র বদলায় কিনা তা-ও দেখতে হবে৷ তাই শুধু বাংলাদেশ নয় পুরো দক্ষিণ এশিয়ার জন্যই একটি নতুন পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে৷''
জায়েদুল আহসান পিন্টু
কিন্তু সাবেক কূটনীতি মেজর জেনারেল (অব.) শহীদুল হক মনে করেন, ‘‘তালেবান আলকায়েদা বা আইএস নয়৷ তারা ওই দুইটি সংগঠনের মতো আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠী নয়৷ তালেবান আসলে সমঝোতার ভিত্তিতেই ক্ষমতায় যাচ্ছে৷ তারা চাইছে সবাইকে নিয়ে একটি সরকার গঠন করতে৷ তারা আন্তর্জাতিক সমর্থন চাইছে৷ এই কারণে তাদের চরিত্রেরও পরিবর্তন হবে৷ পাকিস্তান ও চীনের সাথে তাদের সমঝোতা আছে৷ এখন এই অঞ্চলে যাদের সাথে তাদের সরাসরি সীমানা আছে তাদের সাথে তারা সুসম্পর্ক রাখবে বলেই মনে হচ্ছে৷ ভারতের সাথে তাদের সম্পর্ক কেমন হবে তা নিশ্চিত নয়৷ পাকিস্তান ও চীন চাইবে তাদের মাধ্যমে যোগাযোগ নিরাপত্তা ও ব্যবসা বাড়াতে৷ বাংলাদেশেরও বড় একটি সুযোগ তৈরি হতে পারে ব্যবসা বাণিজ্যের৷''
এই অঞ্চলে এখন ভারতেরই সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ ও ব্যবসা আছে আফগানিস্তানের সঙ্গে৷ বাংলাদেশেরও ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়তে শুরু করেছিল৷ ২০২০-২১ অর্থ বছরে আফগানিস্তানে ৮৬ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ৷ এর আগের বছর রপ্তানি করে ৫৭ লাখ ডলারের৷ বাংলাদেশ আফগান দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমান বছরে দুই কোটি ৮৬ লাখ ডলারের৷ গবেষক আলতাফ পারভেজ মনে করেন, ‘‘যদি তালেবানের চরিত্রের পরিবর্তন হয় তাহলে বাংলাদেশের ব্যবসা ও কর্মসংস্থানের একটি সুযোগ হতে পারে আফগানিস্তানে৷ কারণ, সেখানকার অর্থনীতি কৃষিনির্ভর৷ সেখানে এখনো আধুনিক কৃষি শুরু হয়নি৷ সেটা হলে বাংলাদেশিরা সেখানে কাজ পাবেন৷''
‘‘আর তালেবানের যদি সত্যিই বদলাতে হয় তাহলে তাদের অর্থনীতি এবং আন্তর্জাতিক যোগাযোগকে গুরুত্ব দিতে হবে৷ তা করতে হলে প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটাতে হবে৷''
তালেবানের ১০ প্রতিশ্রুতি
কাবুল নিয়ন্ত্রণে নেয়ার পর ১৭ আগস্ট তালেবানে প্রথম সংবাদ সম্মেলন করে৷ তাদের মুখপাত্র জাবিহউল্লাহ মুজাহিদ দিয়েছেন নতুন অনেক প্রতিশ্রুতি৷ তার কয়েকটি থাকছে ছবিঘরে৷
ছবি: Rahmat Gul/dpa/AP/picture alliance
কারো সঙ্গে শত্রুতা নয়
কাবুল দখলে নেয়ার পর প্রথম সংবাদ সম্মেলনে তালেবান মুখপাত্র জাবিহউল্লাহ মুজাহিদ আন্তর্জাতিক পক্ষের সঙ্গে সঙ্গে যেকোন সংঘাত এড়ানোর কথা বলেন৷ তিনি বলেন, ‘‘ কারো প্রতি ইসলামিক এমিরেটের শত্রুতা বা বৈরিতা নেই৷ বৈরিতার অবসান হয়েছে এবং আমরা শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করতে চাই৷ আমরা কোন অভ্যন্তরীন বা বহিরাগত শত্রু চাই না৷’’
ছবি: Rahmat Gul/AP/picture alliance
প্রতিশোধ নেয়া হবে না
তালেবান ক্ষমতায় আসার পর ভীত সন্ত্রস্ত আফগানরা দেশ ছাড়তে উন্মুখ হয়ে ওঠেন৷ তালেবান মুখপাত্র তাদের আশ্বস্ত করে বলেন, ‘‘আমি আমার স্বদেশিদের আশ্বস্ত করতে চাই, অনুবাদক, সামরিক কার্যক্রমের সঙ্গে বা সাধারণ নাগরিক যারাই আছেন না কেন সবাইকে ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে৷ কারো প্রতি প্রতিশোধমূলক আচরণ করা হবে না৷’’
ছবি: Stringer/REUTERS
বিদেশিদের নিরাপত্তা থাকবে
কাবুলে অবস্থিত বিদেশি দূতাবাসগুলোর নিরাপত্তা নিয়ে তালেবান মুখপাত্র বলেন, ‘‘দূতাবাসগুলোর নিরাপত্তা আমাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ৷ প্রথমত, আমরা নিশ্চিত করতে চাই যেসব এলাকায় দূতাবাস আছে সেখানে পুরোপুরি নিরাপত্তা থাকবে৷ সব বিদেশি রাষ্ট্র, প্রতিনিধি, দূতাবাস, মিশন, আন্তর্জাতিক সংস্থা দাতা সংস্থাগুলোকে আমি আশ্বস্ত করতে চাই তাদের বিপক্ষে আমরা কিছু করতে দিব না৷ আপনাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে৷’’
ছবি: Marc Tessensohn/Bundeswehr/dpa/picture alliance
প্রতিবেশীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক
‘‘আমি আমাদের প্রতিবেশী দেশি, আঞ্চলিক দেশগুলোকে আশ্বস্ত করতে চাই যে তাদের বিরুদ্ধে বা কোন দেশের ক্ষতিসাধনে আমাদের ভূমি ব্যবহার করতে দেয়া হবে না৷ ... আমরা আন্তর্জাতিক সীমানা ও যোগাযোগকে স্বীকৃতি দেই৷ আমাদের সেভাবেই বিবেচনা করা উচিত যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে আমাদের কোন সমস্যা নেই,’’ বলেন জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ৷
ছবি: Jafar Khan/AP Photo/picture alliance
নারীদের ‘অধিকার’ দেয়া হবে
সংবাদ সম্মেলন মুজাহিদ বলেন, ‘‘ইসলামিক এমিরেট শরীয়া কাঠামোর আলোকে নারীদের অধিকার দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ৷ আমাদের বোন, আমাদের পুরুষরা একই অধিকার ভোগ করবেন৷ শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তারা আমাদের নিয়ম ও নীতির আলোকে কাজ কাজ করতে পারবেন৷ ...আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আমরা আশ্বস্ত করতে চাই নারীদের প্রতি কোন বৈষম্য করা হবে না, তবে অবশ্যই সেটি আমাদের কাঠামোর মধ্যে হবে৷’’
ছবি: Kyodo/picture alliance
গণমাধ্যমে নারীরা কাজ করতে পারবে
সংবাদ সম্মলনে প্রশ্নের জবাবে মুজাহিদ জানান, নতুন সরকারের গঠন হলে তাদের ইসলামিক শরীয়া আইন অনুযায়ী নারীরা গণমাধ্যম থেকে শুরু করে অন্য গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলোতেও কাজ করতে পারবে৷ তবে দ্রুতই বিষয়টি পরিস্কার করা হবে৷
ছবি: Getty Images/AFP/W. Kohsar
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা
‘‘আমরা গণমাধ্যমকে আশ্বস্ত করতে চাই যে আমরা আমাদের সাংস্কৃতিক কাঠামোর মধ্যে গণমাধ্যমের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ৷ বেসরকারি গণমাধ্যমের স্বাধীনতা অব্যহত থাকবে৷ তারা তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারবে৷’’ এমন আশ্বাস দিলেও মুজাহিদ বলেন গণমাধ্যমের কার্যক্রমে ইসলামি মূল্যবোধের প্রতিফলন থাকতে হবে৷ ‘‘গণমাধ্যমকে নিরপেক্ষ হতে হবে৷...তারা আমাদের কাজের সমালোচনা করতে পারবে যাতে আমরা উন্নতি করতে পারি,’’ বলেন তিনি৷
ছবি: Wakil Kohsar/AFP/Getty Images
চোরাচালান, মাদক রোধ
মুজাহিদ সংবাদ সম্মেলনে প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেন, ‘‘আমরা দেশের পুরুষ, নারী ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বলতে চাই কোন ধরনের মাদক আমরা উৎপাদন করব না৷ কেউ মাদক চোরাচালানে জড়িত থাকবে না৷’’ তবে মাদকমুক্ত আফগানিস্তান গড়তে ও বিকল্প শস্যের জন্য তিনি আন্তর্জাতিক বিশ্বের কাছেও সহায়তা চান৷
ছবি: Imago Images/ZUMA Press/
অর্থনীতি পুনর্গঠন
দেশের অর্থনীতি পুনর্গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তালেবান মুখপাত্র বলেন, ‘‘আমরা দেশের অর্থনৈতিক অবকাঠামো গড়ে তুলব৷ এজন্য অর্থনৈতিক কার্যক্রম চালুর ব্যবস্থা করা হবে৷ ...অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করা, বিনির্মাণ ও সমৃদ্ধির জন্য আমরা প্রাকৃতিক সম্পদ ও অন্য যে সম্পদ আছে তা নিয়ে কাজ করব৷ এজন্য আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অনুরোধ করছি যে খুব দ্রুতই পুরো পরিস্থিতি, আমাদের অর্থনীতি আমরা বদলে ফেলতে পারব৷’’
ছবি: AP
সরকারে সব পক্ষ থাকবে
সরকারে সবার অংশগ্রহণমূলক সরকার নিশ্চিত করা হবে উল্লেখ করে মুজাহিদ জানান, ‘‘আফগানিস্তানে একটি শক্তিশালী ইসলামিক সরকার থাকবে৷ নাম কী হবে কিংবা আর কী করা হবে সেটি রাজনৈতিক নেতাদের উপর ছেড়ে দিচ্ছি আমরা৷ তারা এ নিয়ে জরুরিভিত্তিতে আলোচনা করছেন৷ কিন্তু একটা বিষয় নিশ্চিত যে আমাদের মূল্যবোধের উপর ভিত্তি করে একটি ইসলামিক ও শক্তিশালী সরকার গঠন করা হবে এবং আমাদের নাগরিকদের মূল্যবোধ বা স্বার্থবিরোধী হবে না৷’’