তালেবান শাসনে কতটা নিরাপদ আফগানিস্তান?
১৩ জুন ২০২৫
দেশ ছেড়ে যাওয়া সব আফগানকে ফিরে আসতে বলছে তালেবান৷ জঙ্গি গোষ্ঠিটির দাবি, আফগানিস্তান তাদের পরিচালনায় নিরাপদ রয়েছে৷ আর তাই দেশ ছেড়ে যাওয়া আফগানদের ফিরে আসার আহ্বান জানাচ্ছে তারা৷
দেশে ফেরত গেলে সবাইকে সাধারণ ক্ষমা করা হবে বলে জানান তালেবান সরকারের কাউন্সিল অব মিনিস্টারের প্রধান মোহাম্মাদ হাসান আকুন্দ৷ গত শনিবার ঈদ উল আযহার অনুষ্ঠানে এমন ঘোষণা দেন তিনি৷
তবে আফগানিস্তানের সাবেক সরকারের এক সাংসদ নিলুফার ইব্রাহিমি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সহিংসতার সাথে যুক্ত অপরাধীরা এখন ক্ষমতায়৷ যেমন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রাণালয়ের প্রধান৷ অবশ্যই তারা দাবি করবে যে, আফগানিস্তান নিরাপদ৷''
দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণারয়ের দায়িত্ব পালন করছেন সিরাজউদ্দিন হাক্কানি৷ ২০২১ সালে তালেবান ক্ষমতায় ফেরার আগ পর্যন্ত আফগানিস্তানে বেশ কিছু ভয়াভহ হামলার ঘটনায় হাক্কানি দায়ী বলে ধারণা করা হয়৷ এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের এফবিআইয়ের মোস্ট ওয়ান্টেডের তালিকায় রয়েছেন হাক্কানি৷ সেই সময় আফগানিস্তানে নিয়োজিত যুক্তরাষ্ট্র এবং যৌথ বাহিনীর উপর সীমান্তের ওপার থেকে হামলা চালানোর অভিযোগ তার বিরুদ্ধে৷ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা হাক্কানি দেশটির ক্ষমতা কাঠামোতে বিশেষ করে পুলিশ এবং নিরাপত্তা দপ্তরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন৷
তালেবান ক্ষমতায় আসার পর দেশত্যাগ করেছিলেন রাজনীতিবিদ ইব্রাহিমি৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘বিরোধীদেরকে দমন এবং সাধারণ মানুষকে ভয়-ভীতি প্রদর্শন করছে তালেবান৷''
উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, আফগানিস্তানের উত্তরাঞ্চলীয় বাদাখসান রাজ্যের কৃষকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে তালেবান৷ ওই কৃষকেরা পপি উৎপাদন করতেন৷ ক্ষমতায় আসার পর পপি উৎপাদনে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে তালেবান৷ এদিকে পপি ছাড়া অন্য ফসল উৎপাদনের জ্ঞান ওই কৃষকদের নেই৷
বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র দেশ আফগানিস্তানের ৮০ ভাগ মানুষ কৃষিকাজের উপর নির্ভরশীল৷ দেশটিতে আফিম চাষ অন্য ফসলের তুলনায় লাভজনক৷ এমনকি তীব্র খরার সময়েও আফিম উৎপাদন করা যায় বলে কৃষকদের অনেকেই এটি উৎপাদন করতেন৷
তালেবানের সময়ে দারিদ্র্য
চার কোটি মানুষের দেশ আফগানিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৪৩ ভাগ শিশু, যাদের বয়স শুন্য থেকে ১৪ বছর৷ তালেবান ক্ষমতায় আসার পর এই জনসংখ্যার অর্ধেকের অবস্থা দারিদ্র্য সীমার নিচে নেমে গেছে৷
গত মার্চ মাসে জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের প্রকাশিত এক প্রতিবেদন বলছে, আফগানিস্তানের প্রতি দুইজনের একজন শিশুর জরুরি সহায়তা প্রয়োজন৷ মারাত্মকভাবে অপুষ্টির শিকার শিশুর সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে৷ ভরণপোষণের দায়িত্ব পালন করতে না পেরে অনেক বাবা-মা মেয়েদের শিশু বয়সেই বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন বলে প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়৷
আফগানিস্তানে নারীদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন পার্পল স্যাটারডে'র একজন অ্যাক্টিভিস্ট নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তারা হচ্ছে ওই শিশুরা যাদেরকে শিক্ষার অধিকার, ব্যক্তিগত উন্নয়নের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে৷ তাছাড়া এই শিশুরা বেদনাদায়ক পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছে৷ যেমন, চরম দারিদ্র্য, পরিবারিক সহিংসতা এবং সামাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া, ইত্যাদি৷ আর এমন পরিস্থিতিতে আগের যে-কোনো সময়ের চেয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি৷
নিজেদের সংগঠেনর নেটওয়ার্কের মাধ্যমে নারী ওবং তরুণীদেরকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে শিক্ষাদানের এবং নানা বিষয়ে সচেতন করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন এই অ্যাক্টিভিস্ট৷ উল্লেখ্য, নারীদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা নিষিদ্ধ করেছে তালেবান৷ পঞ্চম শ্রেণি পাশের পর কার্যত দেশটিতে তাদের আর পড়াশোনার কোনো সুযোগ নেই৷
দেশে ফেরার ভয়
তালেবান ক্ষমতায় আসার পর দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন অনেক আফগান৷ তাদের অনেকে আবার পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে আশ্রয় নিয়েছিলেন৷ তাদেরই একজন তিন সন্তানের জননী দিবা৷
তালেবান ক্ষমতায় আসার আগে আফগান সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে চাকরি করতেন তিনি৷ নারীদের উন্নয়নে কাজ করা একটি ইনস্টিটিউটের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তিনি৷ তালেবান দায়িত্বে আসার পর বন্ধ হয়ে যায় প্রতিষ্ঠানটি৷ এমন পরিস্থিতিতে পার্শ্ববর্তী দেশ পাকিস্তানে পাড়ি জমাতে বাধ্য হন দিবা৷
ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘সবকিছু বিক্রি করে আমি পালিয়ে গিয়েছি৷’’ বর্তমানে নতুন আরেক আতঙ্কে আছেন দিবা৷ ভিসার মেয়াদ শেষ হলে তাকে আফগানিস্তানে ফেরত পাঠানো হতে পারে, এমন আশঙ্কা তার৷
পাকিস্তান থেকে আফগানদের জোরপূর্বক দেশে ফেরত পাঠানো ক্রমাগত ঘটেই চলেছে৷ গত এপিল এবং মে - এই দুই মাসে দুই লাখ আফগানকে দেশে ফেরত পাঠিয়েছে পাকিস্তান সরকার৷
দিবা বলছেন, ‘‘প্রয়োজনে আমি পালিয়ে থাকবো, তবুও আফগানিস্তানে ফেরত যাবো না৷’’ এমন অবস্থায় তৃতীয় কোনো দেশে যেতে পারবেন- এমন প্রত্যাশা এই মায়ের৷
তবে শুধু পাকিস্তানই নয়, আরো অনেক দেশই ফেরত পাঠাচ্ছে আফগানদের৷ যেমন, ইরান জানিয়েছে, চলতি বছর ৪০ লাখ আফগানকে দেশে ফেরত পাঠানো হবে৷ গত মে মাসে ১৫ হাজার আফগানকে ফেরত পাঠানো হয়েছে৷
আর তালেবান বলছে, ‘‘আমরা তাদেরকে (দেশে ফেরত যাওয়া আফগান) স্বাগত জানাবো৷’’
শবনম ভান হাইন/আরআর