রাশিয়ায় শুরু হয়েছে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। ১৫ থেকে ১৭ মার্চের মধ্যে নির্বাচন হবে। সকলেই জানেন পঞ্চমবার ক্ষমতায় আসবেন পুটিন।
রাশিয়ায় ভোট দিচ্ছেন জনগনছবি: Alexander Ermochenko/REUTERS
বিজ্ঞাপন
গত ২৫ বছর ধরে রাশিয়ায় ক্ষমতা ধরে রেখেছেন ভ্লাদিমির পুটিন। এবছর পঞ্চমবার প্রেসিডেন্টের আসনে বসবেন তিনি। অর্থাৎ, ২০৩০ সাল পর্যন্ত তিনি ক্ষমতায় থাকবেন। যারা তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন, তারাও কার্যত পুটিনের তেমন কোনো সমালোচনা করছেন না। অনেকেই বলছেন, এই নির্বাচন আসলে লোক দেখানো।
কিছুদিন আগেই রাশিয়ার জেলে মৃত্যু হয়েছে নাভালনির। অভিযোগ, তাকে হত্যা করা হয়েছে। এর আগে তাকে বিষ দিয়ে মারার চেষ্টা হয়েছিল বলেও অভিযোগ ছিল। জার্মানিতে তার চিকিৎসা হয়েছিল। পুটিনের আরেক সমালোচক বরিস নাদেঝদিন। কিন্তু রাশিয়ার আদালত তাকে ভোটে দাঁড়াতে দেয়নি। সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেছিলেন বরিস। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টও তাকে ভোটে দাঁড়ানোর অনুমতি দেয়নি। বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, বরিস দাঁড়ালে পুটিনকে লড়াইয়ের মুখে ফেলতে পারতেন।
নাভালনির মৃত্যু ও ‘মুক্ত রাশিয়া’ আন্দোলনের নেতৃত্বে স্ত্রী ইউলিয়া
রাশিয়ায় আলেক্সেই নাভালনির মৃত্যুর পর ‘মুক্ত রাশিয়া’ গড়তে তিনি যে সংগ্রাম করছিলেন, তা চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করেছেন তার স্ত্রী ইউলিয়া নাভালনায়া৷
ছবি: Kai Pfaffenbach/AP Photo/picture alliance
জন্ম
১৯৭৬ সালের ২৪ জুন মস্কোয় জন্মগ্রহণ করেন ইউলিয়া নাভালনায়া৷ বাবা বরিস আব্রোসিমভ ছিলেন বিজ্ঞানী ও মা সরকারি চাকরি করতেন৷ প্লেখানভ রাশিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে পড়াশোনা করে কিছুদিন মস্কোর এক ব্যাংকে চাকরি করেন ইউলিয়া৷
ছবি: THOMAS KIENZLE/AFP/Getty Images
নাভালনির সঙ্গে পরিচয়
১৯৯৮ সালে তুরস্কে ছুটি কাটানোর সময় নাভালনির সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল ইউলিয়ার৷ রাশিয়ার তৎকালীন মন্ত্রিসভার সব সদস্যের নাম বলতে পারায় ইউলিয়ার দক্ষতায় মুগ্ধ হয়েছিলেন তরুণ আইনজীবী নাভালনি৷ দুই বছর পর তারা বিয়ে করেন৷ তাদের দুই সন্তান আছে৷ নাভালনি ও ইউলিয়া দুজনই একসময় উদারপন্থি ইয়াবলোকো দলের সদস্য ছিলেন৷
মিছিল, প্রচারণা, আদালত- প্রায় সবখানে স্বামীর পাশে ইউলিয়াকে দেখা যেতো৷ ২০১৩ সালে চুরির অভিযোগে নাভালনির বিরুদ্ধে বিচার চলার সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন ইউলিয়া৷ নাভালনিকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়ার পর ইউলিয়া বলেছিলেন, ‘‘এই জারজেরা কখনও আমাদের চোখের পানি দেখতে পাবে না৷’’ ছবিতে রাশিয়ার এক আদালতে নাভালনি ও নাভালনায়াকে দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: Ilya Pitalev/dpa/Sputnik/picture alliance
নাভালনিকে জার্মানিতে নিয়ে আসা
২০২০ সালে নাভালনিকে উন্নত চিকিৎসার জন্য রাশিয়া থেকে জার্মানি নিয়ে আসা হয়েছিল৷ এতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন ইউলিয়া নাভালনায়া৷ তিনি সরাসরি ক্রেমলিনের কাছে চিঠি পাঠিয়েছিলেন৷ জার্মানিতে করা পরীক্ষায় নাভালনির শরীরে নার্ভ এজেন্ট পাওয়া গিয়েছিল৷
ছবি: Yves Herman/AP/picture alliance
গ্রেপ্তার
জার্মানি থেকে চিকিৎসা শেষে রাশিয়া ফিরে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন নাভালনি৷ তার মুক্তির দাবিতে মিছিলে অংশ নিয়ে ২০২১ সালের জানুয়ারিতে দুবার আটক হয়েছিলেন ইউলিয়া নাভালনায়া৷ তাকে ২৬৫ ডলার জরিমানা করেছিল আদালত৷
ছবি: Evgenia Novozhenina/REUTERS
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
নাভালনির মৃত্যুর পর সোমবার একটি ভিডিও বার্তা প্রকাশ করেন ইউলিয়া নাভালনায়া৷ সেখানে তিনি ‘মুক্ত রাশিয়া’ গড়তে নাভালনি যে সংগ্রাম করছিলেন, তা চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করেন৷
ছবি: Kai Pfaffenbach/AP Photo/picture alliance
6 ছবি1 | 6
পুটিনের বিরোধী হিসেবে ভোটে দাঁড়িয়েছেন ৭৫ বছরের কমিউনিস্ট প্রার্থী নিকোলাই খারিতোনভ। সাধারণত, দ্বিতীয় স্থানে থাকেন তিনি। তবে পুটিনের সঙ্গে তার ভোটের ব্যবধান থাকে বিরাট। স্থানীয় কিছু বিষয়ে পুটিনের বিরোধিতা করলেও ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে পুটিনের পাশে দাঁড়িয়েছেন তিনি। অন্যদিকে ৪০ বছরের ভ্লাদিস্লাভ দাভানকোভ পুটিনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন। তিনিও জানিয়ে দিয়েছেন, প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তার বিশেষ কোনো মতপার্থক্য নেই। শুধুমাত্র ব্যক্তিস্বাধীনতা নিয়ে তিনি ভোটের প্রচারে কথা বলেছেন।
সমীক্ষা বলছে, নিকোলাই এবং ভ্লাদিস্লাভ যৌথভাবে চার থেকে পাঁচ শতাংশ ভোট পেতে পারেন। বাকি পুরো ভোটই পাবেন পুটিন। রাজনৈতিক মহলে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, এই লোক দেখানো নির্বাচনের আদৌ কি কোনো প্রয়োজন ছিল?
কার্টুনিস্টদের দৃষ্টিতে ইউক্রেন যুদ্ধ ও পুটিন
ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব সারা বিশ্বেই পড়েছে৷ বিভিন্ন দেশের কার্টুনিস্টরা এই যুদ্ধ নিয়েই বেশ কিছু কার্টুন এঁকেছেন এবং তা নিয়ে প্রদর্শনীও হয়েছে জার্মানির ডর্টমুন্ড শহরে৷ দেখুন ছবিঘরে...
মাদার ওয়ার
ইটালির কার্টুনিস্ট পাওলো লাম্বার্ডি ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে তার কার্টুনটির নাম দিয়েছেন ‘মাদার ওয়ার’৷ সেখানে ইউক্রেনে হামলা শুরু করা রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুটিনকে দেখানো হয়েছে যমদূত গ্রিম রিপারের কোলে৷ পুটিনকে ফিডারে দুধ খাওয়াচ্ছেন মৃত্যুদূত৷ চার পাশে মাছি এমনভাবে উড়ছে যেন পুটিন হয় মরে গেছেন, নয়তো অচিরেই মরবেন!
দ্য নেভিগেটর
ডাচ কার্টুনিস্ট জিয়ার্ড রয়ার্ডসের কার্টুনেও পুটিন ভিলেন৷ এখানে রুশ প্রেসিডেন্টকে দেখানো হয়েছে অদ্ভুত এক বাহন রূপে৷ একমাত্র যাত্রী শয়তানকে পাশে নিয়ে বাহনটি চালাচ্ছেন যমদূত গ্রিম রিপার৷ চলন্ত যানে বসে পত্রিকা পড়ছেন শয়তান৷ পত্রিকার নাম ‘রোড টু থার্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ার’৷ ইঙ্গিতটা খুব স্পষ্ট – বিশ্বকে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন যুদ্ধবাজ পুটিন৷
অস্ত্রের রূপান্তর
উজবেকিস্তানের মাখমুদ এশনকুলভের ইউক্রেন যুদ্ধ দেখে মনে হয়েছে মানুষ সৃষ্টির আদিকাল থেকে অনেক এগিয়েছে ঠিকই, তবে সেই অগ্রগতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মানবজাতির বড় একটা অংশের মধ্যে যুদ্ধপ্রীতিও বেড়েছে৷ তাই তার কার্টুনে বানর নিরস্ত্র, নিয়ান্দারথালের হাতে মুগুর, তারপর মানুষের হাতে আধুনিক অস্ত্র৷ মানুষের অগ্রগতি আর অস্ত্রের ক্ষমতা বৃদ্ধি যেন সমার্থক!
অস্ত্রের নাম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, পাসওয়ার্ড ফেক.নিউজ
কিউবার মিগুয়েল মোরালেস এ যুগের যুদ্ধে প্রপাগান্ডার গুরুত্ব কতটা তা ফুটিয়ে তুলেছেন৷ তার মতে, যুদ্ধের সবচেয়ে বড় অস্ত্রাগারের নাম প্রপাগান্ডা আর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অস্ত্র এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, অর্থাৎ টুইটার, ফেসবুক আর ইন্সটাগ্রাম৷ ঘরে বসে শুধু এই তিন অস্ত্রের বোতামে টিপুন, ব্যস যুদ্ধে অনেক এগিয়ে যাবেন৷ চলমান যুদ্ধেও যে প্রপাগান্ডার লড়াই চলছে কার্টুনের মাধ্যমে তা-ই জানাতে চেয়েছেন কিউবান শিল্পী৷
চির ক্ষুধার্ত রাশিয়া
ইউক্রেনের মতো লিথুয়ানিয়াও এক সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিল৷ এখন ইউক্রেনে হামলা চালিয়েছে রাশিয়া৷ লিথুয়ানিয়ার কার্টুনিস্ট কাজিস কেস্তুতিস সিয়াউলিতিসের তাই ভয়- ভবিষ্যতে না তার দেশের দিকেও হাত বাড়ায় রাশিয়া৷ সিয়াউলিতিসের চোখে তাই রাশিয়া এমন এক মাছ যার ক্ষুধা মরে কঙ্কাল হয়ে যাওয়ার পরও মিটবে না, কঙ্কালও হাঁ করে গিলতে থাকবে একের পর এক দেশ৷
যুদ্ধকে ‘না’
যুদ্ধ একটা দেশকে কী ভয়ানক খারাপ অবস্থায় ফেলতে পারে তা আফগানিস্তারের কার্টুনিস্ট শহিদ আতিকুল্লার চেয়ে বেশি ক’জন বুঝবেন!তিনি তাই নরওয়েজিয়ান শিল্পী এডওয়ার্ড মুঞ্চ- এর ১৯৮৩ সালে আঁকা আইকনিক ছবি ‘দ্য স্ক্রিম’ ধার করে সৃষ্টি করেছেন যুদ্ধবিরোধী বার্তা দেয়া এক ক্যারিকেচার৷ ক্যারিকেচারে ব্যবহার করেছেন বোমায় বিধ্বস্ত ইউক্রেনের কোনো এক শহরের ছবি৷
যুদ্ধ করো না, ভালোবাসো
রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা চালানোর পর থেকেই বিশ্ব জুড়ে চলছে যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভ৷ কিন্তু পুটিন যুদ্ধ থামাননি৷ তুরস্কের মেনেকসে চাম তার কার্টুনে তুলে ধরেছেন শান্তির বাণী৷ ‘নো ওয়ার’ শীর্ষক কার্টুনে তাই গ্রিম রিপার কাঁটা দিয়ে গল্ফ খেলছেন আর চার পাশ থেকে শান্তিকামী মানুষরা তুলছেন ‘যুদ্ধ করো না, ভালোবাসো’ স্লোগান৷
ন্যাটোর প্রেমে
ইউক্রেন যুদ্ধের বড় কারণ ইউক্রেনের ন্যাটোর সদস্য হওয়ার সম্ভাবনা৷ পুটিন সে কথাই বলছেন বারবার৷ সংযুক্ত আরব আমিরাতের আমেরের কার্টুনেও তাই ইউক্রেন ন্যাটোর প্রেমে পড়া এক কিশোরী, সেই কিশোরী প্রেমভরা দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে ন্যাটোর দিকে, কিন্তু তাকে উল্টো দিকে টানছে রাশিয়া৷
পুটিন যেমন
আলোচনার মাধ্যমে যুদ্ধ শেষ করার কোনো উদ্যোগই কাজে আসছে না৷ নিজের অবস্থানে ভ্লাদিমির পুটিন অনড়৷ তাই পুটিনের বহুল আলোচিত টেবিলে শুধু পুটিনকে বসিয়েই তার একরোখা মানসিকতা ফুটিয়ে তুলেছেন জার্মানির আগোস্টিনো টালে৷ দীর্ঘ টেবিলের এক প্রান্তে পুটিন অন্য প্রান্তে আয়নায় তারই প্রতিচ্ছবি৷ আগোস্টিনো আসলে মনে করেন, পুটিন শুধু নিজের দিকটাই দেখেন, অন্য কারো কথা তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়৷
ড. অক্টোপুটিন
রাশিয়ার বিরুদ্ধে যত নিষেধাজ্ঞাই আরোপ করা হোক না কেন, মাকাওয়ের কার্টুনিস্ট রডরিগো মনে করেন চলমান যুদ্ধে পুটিনই এখনো সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছেন৷ তার সুবিধাজনক অবস্থায় থাকার প্রধান কারণ ইউরোপের বেশ কিছু দেশের রাশিয়ার তেল ও গ্যাসের ওপর নির্ভরশীলতা৷
10 ছবি1 | 10
ভোটের কারণ
বিশেষজ্ঞদের একাংশের বক্তব্য, এই ভোট থেকে দেশের ভিতরে এবং দেশের বাইরে দুইটি বিষয় প্রমাণ করতে চাইছেন পুটিন। দেশের ভিতর তিনি দেখাতে চাইছেন রাশিয়ার অধিকাংশ মানুষ তার সঙ্গে আছেন। অর্থাৎ, প্রেসিডেন্টকে নিয়ে দেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধ।
দেশের বাইরে পুটিন এই ভোটের মাধ্যমে বোঝাতে চাইছেন, তার নেওয়া সমস্ত সিদ্ধান্ত দেশের মানুষ সমর্থন করছেন। অর্থাৎ, ইউক্রেন অভিযান নিয়ে দেশের ভিতর কোনো বিরোধিতা নেই। বহির্বিশ্বে এই বার্তাটি দেওয়া অত্যন্ত জরুরি ছিল বলেই মনে করেন পুটিন বিশেষজ্ঞেরা।
ভোটের সময় কি বিক্ষোভ হবে?
আপাতভাবে ভোটে বিশেষ বিক্ষোভের আশঙ্কা দেখছে না ক্রেমলিন। কারণ অধিকাংশ পুটিন-বিরোধী নেতা এখন দেশছাড়া। তবে দেশের বাইরে থেকেই তারা সমর্থকদের পুটিনের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ার আবেদন করেছেন। নাভালনির স্ত্রী রাস্তায় নেমে পুটিনের বিরোধিতা করার আহ্বান জানিয়েছেন। তবে শেষ পর্যন্ত কতটা বিরোধ হবে, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে বিতর্ক আছে।