1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

তিনি এক জঙ্গির মা

২৯ অক্টোবর ২০১৮

২০১৫ সালের কোনো এক শনিবার৷ ভোর পৌঁনে ছয়টার দিকে সাবিনে লাপ্পে'র টেলিফোন বেজে উঠল৷ বিরক্তি নিয়ে ফোন ধরতেই শুনলেন, ‘‘মা, আমি এখন তুরস্কে৷ গাড়ি এলেই সিরিয়া রওনা হবো৷''

Sabine Lappe
ছবি: DW/E. Felden

২৭ বছরের ছেলে ক্রিস্টিয়ান মায়ের শেষ বারণটুকুও শুনলেন না৷ জার্মানি থেকে স্ত্রী ইয়াসমিনাসহ ইসলামিক স্টেট-এ যোগ দিতে পাড়ি জমালেন সিরিয়া৷

বেদনাদায়ক সাক্ষাৎ

ঘরেই থাকেন সাবিনে৷ খুব একটা বের হন না৷ তিনি একজন জঙ্গির মা৷ কেউ তাঁর ছেলের জন্য কাঁদে না৷ তবে তিনি কাঁদেন৷

‘‘আমি তাঁকে ভালোবাসি,'' বলেন সাবিনে৷ ‘‘তবে আমার ক্রিস্টিয়ান তো আর আগের মতো নেই৷''

খুব দ্রুত কথা বলেন এই হতভাগ্য মা৷ মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলতে কিছুটা অস্বস্তিও বোধ করেন৷ কয়েক ঘন্টায় অনেক কথা হলো তাঁর সঙ্গে৷

ভাগ্যের আঘাত ছোটবেলাতেই

সাবিনে জানালেন, তাঁর ছেলে ক্রিস্টিয়ান ছোটবেলা থেকেই মেধাবী ছিলেন৷ কিন্তু একা একা মানুষ করতে গিয়ে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে তাঁকে৷ ছেলে যখন মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছিল, তখন পাশে দাঁড়িয়েছেন৷

মৌলবাদী মুসলমানরা ২০১৪সালে বন শহরে মানুষকে কুরআন পড়তে উৎসাহিত করতে কোরআন বিতরণ করে ছবি: DW/I.Azzam

টিনএজ বয়সেই খুব অসুখে পড়েন ক্রিস্টিয়ান৷ ওজন কমতে থাকে৷ এক রাতে পেটের পীড়ায় এতটাই কাতর হয়ে পড়েন যে, মা সাবিনে অ্যাম্বুলেন্স ডেকে হাসপাতালে নিয়ে যান৷ সে রাতেই অপারেশন করা হয়৷

আল্লাহ'র কাছে ফিরে আসা

সাবিনে'র মনে পড়ে, ক্রিস্টিয়ানের যেদিন অ্যানেস্থেশিয়া'র ঘুম ভাঙ্গে, সেদিন তিনি মাকে বলেন যে, তাকে দ্বিতীয় জীবন দেয়ায় ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাতে চান৷ তাঁরা ক্যাথলিক ধর্মের অনুসারী ছিলেন৷ সালাফিজম তো দূরে থাক, ইসলামের সঙ্গেই কোনো সম্পর্ক ছিল না৷

সুস্থ হয়ে স্কুলে ফেরত যায় ক্রিস্টিয়ান৷ সেখান থেকে পাশ করে মনোবিজ্ঞান নিয়ে পড়তে ভর্তি হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে৷ স্কুলেই মরক্কো ও তুর্কি বংশোদ্ভুত কয়েকজনের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় ক্রিস্টিয়ানের৷ ইসলামের প্রতি তাদের নিষ্ঠা মুগ্ধ করে ক্রিস্টিয়ানকে৷

২০১২ সালে একদিন ঘরে ফিরে এসে মা-কে কিছু কথা বলতে চান৷ সাবিনে'র ভাষায়, ‘‘ও হঠাৎ করে বাড়ি ফিরল এবং আমাকে বলল যে, সে ধর্মান্তরিত হতে চায়৷''

সাবিনে'র জীবনসঙ্গী তখন মারা গেছেন৷ তিনিও জীবন নিয়ে নতুন কিছু ভাবতে চাইছিলেন৷ ছয় মাস পর দু'জনই ফিরলেন ‘আল্লাহর কাছে'৷

মতবিরোধ শুরু

সাবিনে যখন ঘর থেকে বেরুতেন, হিজাব পরতেন৷ তবে নিকাব দিয়ে মুখ ঢাকতেন না৷

অনেক যুবক অনলাইন সালাফিস্ট আন্দোলনের সম্মুখীন হনছবি: picture-alliance/chromorange/R. Peters

‘‘আমরা জার্মানিতে থাকি৷ এখানে এই বিষয়টা ঠিক যায় না,'' এমনটাই ভাবতেন সাবিনে৷ এমনকি বাজারে লোকজনের সঙ্গে আগের মতোই হ্যান্ডশেকও করতেন৷

কিন্তু ক্রিস্টিয়ানের এগুলো ভালো লাগত না৷ তিনি দিন দিন আরো রক্ষণশীল হতে লাগলেন৷ মা-কে বকা দিয়ে বলতেন, ‘‘মা, এমন কোরো না, এগুলো হারাম৷''

এভাবে তাদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিতে লাগল৷

‘অন্যের শেখানো বুলি'

সে সময় আরো অনেক কিছু সাবিনে'র ভালো লাগত না৷

‘‘আমি দেখলাম, মেয়েরা সেসব কথাই বলে, যেসব তাদের স্বামীরা শিখিয়ে দিচ্ছে,'' বলেন তিনি৷ ‘‘আমি তাদের অনেক কথাতেই প্রশ্ন করতাম এবং বলতাম, নিজে কোরআন পড়ুন, শুধু অন্যের শেখানো বুলি আওড়াবেন না৷''

এ কথাগুলো পুরুষদের ভালো লাগত না৷ তারা ক্রিস্টিয়ানকে বলতেন, ‘‘তোমার মা'কে পথে আনো৷ সে আমাকে চুপ থাকতে বলত৷''

ইয়াসমিনা'র সঙ্গে পরিচয়

২০১৪ সালে এক জার্মান মরোক্কান নারীর সঙ্গে পরিচয় হয় ক্রিস্টিয়ানের৷ ‘‘আসলে আমিই পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম,'' বলেন সাবিনে৷ কোনো একদিন জুম্মার নামাজের পর ১৭ বছরের ইয়াসমিনা সাবিনের কাছে এসে ক্রিস্টিয়ানের খোঁজ করেন৷ কারণ হিসেবে বলেন যে, একজন প্রকৃত ইসলামের অনুসারীকে বিয়ে করতে চান৷

তখন সাবিনে বুঝতে পারেননি যে, ইয়াসমিনা এমন কাউকে বিয়ে করতে চান, যাকে নিয়ে সিরিয়া যেতে পারবেন৷ সাবিনে'র দৃঢ় বিশ্বাস যে, ক্রিস্টিয়ানের উগ্রপন্থার পথ বেছে নেয়ার কারণ ইয়াসমিনা৷

জার্মানিতে সালাফিস্ট নারীরা ছবি: picture alliance/dpa/B. Roessler

ছয় মাস পর ফ্রাঙ্কফুর্টের এক মসজিদে বিয়ে করেন ক্রিস্টিয়ান ও ইয়াসমিনা৷ ২০১৫ সালের শুরুতেই ইয়াসমিনা সাবিনেকে জানান যে, তিনি ও ক্রিস্টিয়ান ইসলামিক স্টেট-এ যোগ দেবেন৷

‘‘দুর্ভাগ্যবশত, আমি তখন অত গুরত্ব দেইনি৷ ভেবেছি, এইটুকু মেয়ে!'' বলেন সাবিনে৷

পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে

ততদিনে আসলে ইয়াসমিনা ও ক্রিস্টিয়ান তাদের সিদ্ধান্ত নেয়া পথে অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছেন৷ তারা ডর্টমুন্ড ও তার বাইরে ইন্টারনেট ক্যাফেতে বসে যোগাযোগ করতেন৷

জার্মানির সালাফিস্ট নেতাদের অনেকের সঙ্গেই যোগাযোগ গড়ে ওঠে ক্রিস্টিয়ানের৷ ২০১৫ সালের জুলাইতে ক্রিস্টিয়ান সিরিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হন৷ তবে যাওয়ার আগেই ডর্টমুন্ড পুলিশের নজরদারিতে পড়েন তিনি৷ এমনকি আজ পর্যন্ত সাবিনেও পুলিশের নজরদারিতে আছেন৷

কয়েকবার তাঁর ফোন পুলিশ জব্দ করেছে৷ সাবিনে জানান যে, তিনি ফেসবুকের মাধ্যমে অনেক সালাফিস্ট মতাদর্শের লোকের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন, যদি একটু ছেলের সম্পর্কে কিছু জানা যায়, এমনকি তার মৃত্যুর পরও৷

ইসলামিক স্টেটের উদ্দেশ্যে যাত্রা

ক্রিস্টিয়ান ও ইয়াসমিনা চলে যাবার পর ক্রিস্টিয়ান প্রায়ই হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ পাঠাতেন বা কল করতেন৷ ‘‘ও রাক্কা, ইডলিব, আবু কামাল এবং এমনকি একবার ইরাকেও ছিল,'' বলেন সাবিনে৷

ঠিক এক বছর পর একটি ভিডিও দেখে ধাক্কা খান সাবিনে৷ আইএসের সঙ্গে জড়িত অনলাইন প্লাটফর্ম ফুরাত মিডিয়াতে প্রকাশিত ভিডিওটিতে দেখা যায় যে, ক্রিস্টিয়ান, যার নাম তখন পরিবর্তন হয়ে আবু ইসা আল-আলামনি হয়ে গেছে, ইউরোপে হামলার আহ্বান জানাচ্ছেন৷

ভিডিওতে এরপর কুঠার দিয়ে এক ব্যক্তির হাত কেটে ফেলা হয়৷ পরিষ্কার ছিল না যে, তা ক্রিস্টিয়ানই করেছেন কি না৷ তবে তিনি আঘাতপ্রাপ্ত'র কপালে চুমু খান৷ এমন দৃশ্য দেখে ক্রিস্টিয়ানকে পুরোপুরি অচেনা ঠেকে সাবিনে'র কাছে৷

পরে টেলিফোনে কথা বলার সময়, বিষয়টি নিয়ে চিৎকার করলে মা'কে উল্টো ‘অবিশ্বাসী' বলে গাল দেন ক্রিস্টিয়ান৷

ঐ কথোপকথনের পর সাবিনের শেষ আশাটুকুও মরে যায় যে, একদিন হয়তো পুত্র ভুল বুঝে ফিরে আসবে৷ তখন হয়তো ওর ১০ থেকে ১৫ বছরের সাজা হবে৷ তাতে কী? অন্তত দেখা তো হবে৷

সালাফিস্টরা তাদের জনসভায় রক স্টারের মতো উদযাপন করতেন, যেমন ২০১১ সালে ফ্রাঙ্কফুর্টেছবি: picture-alliance/dpa/B. Roessler

একদিন হোয়াটসঅ্যাপে দু'টি ছবি আসে সাবিনের মোবাইলে৷ সেখানে একটি কালাশনিকভ রাইফেলের সঙ্গে প্রেগনেন্সি টেস্ট পজিটিভ হওয়ার ছবি এবং অন্য ছবিতে ছেলে ও বুরকা পরা ছেলের বৌ৷

মরুভূমিতে মৃত্যু

২০১৭ সালের ১ আগষ্ট ছেলের সঙ্গে সবশেষ কথা বলেন মা৷ তখন ছেলে জানান যে, তিনি যুদ্ধে যাচ্ছেন৷ যদি মারা যান, তাহলে ইরাকি যোদ্ধাকে বিয়ে করবেন ইয়াসমিনা৷ সব ব্যবস্থা করা আছে বলে জানিয়েছেন৷

১৯ সেপ্টেম্বর ছেলের স্ত্রী ইয়াসমিনা কল করেন৷ সগর্বে বলেন, আল্লাহর জন্য যুদ্ধ করতে গিয়ে তার স্বামী ‘শহিদ' হয়েছেন৷

‘‘না, ক্রিস্টিয়ান আল্লাহর জন্য যুদ্ধ করতে যায়নি৷ সে আল বাগদাদি (আইএস নেতা) ও তার অপরাধী সঙ্গীগুলোর জন্য যুদ্ধ করতে গিয়েছিল,'' বলেন সাবিনে৷ 

নাতি'র জন্য

এখন একজন একাকী মানুষ সাবিনে৷ তাঁর পরিচয় জানার পর মানুষও তাঁর সঙ্গে কথা বলতে খুব একটা চায় না৷ কেউ হয়তো জিজ্ঞেস করেন, ‘‘আপনি কি ক্রিস্টিয়ান লাপ্পের মা?''

সাধারণত তিনি উত্তর দেন, ‘‘হ্যা, আমি ওর মা৷ কিন্তু আমি ভয়ঙ্কর নই৷ আমার হিজাবের নীচে কালাশনিকম রাখা নেই এবং আমি কারো হাত কাটি না৷''

তাঁর জীবনের এখন একটাই খায়েশ৷ নাতি'কে একবার কোলে নেবেন৷ কয়েকটি ছবি দেখালেন নাতির৷ বললেন যে, দেখতে একেবারে ক্রিস্টিয়ানের মতোই হয়েছে৷

‘‘আমার খালি মনে হতো, ক্রিস্টিয়ানকে হারিয়ে ফেলব৷ সত্যি হারিয়েছি৷ এখন আমার মনে হয়, এই ছোট্টটাকেও হারিয়ে ফেলব,'' দুঃখে বুক ভাসান সাবিনে লাপ্পে৷

এস্থার ফেলডেন/জেডএ

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ