আবু সায়েমের বিয়ের কথা চলছিল ৷ তিনি কাজ করতেন একটি বায়িং হাউজে৷ কিন্তু শনিবার বাসায় ফেরার পথে বাস থেকে তাকে ফেলে দিয়ে হত্যা করা হয়৷
বিজ্ঞাপন
তার স্বপ্ন মুছে গেছে৷ তার পরিবারে নেমে এসেছে শোকের ছায়া৷
তবে এবারই প্রথম নয়৷ গত তিন বছরে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বাসের চালক ও হেল্পাররা এরকম ১৪ জন যাত্রীকে বাস থেকে ফেলে দিয়ে হত্যা করেছে বলে অভিযোগ করেন বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির সহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী৷ তার কথা, ‘‘কোন ঘটনায় বিচার না হওয়ায় চালক ও হেলপাররা বেপরোয়া হয়ে উঠছে৷” তিনি জানান ১৪ জন নিহত গেছেন, কিন্তু এই সময়ে বাস থেকে ফেলে দেয়া বা নামিয়ে দেয়ার অনেক ঘটনা ঘটেছে৷ আর প্রায় ক্ষেত্রেই দেখা গেছে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের প্রতিবাদ করায় এই ঘটনাগুলো ঘটছে৷”
সায়েমের বাসা যাত্রাবাড়ি এলাকায়৷ তিনি পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে সেখানে থাকতেন৷ শনিবার বিকালের পর তার কর্মস্থল মতিঝিলের নিট প্লাস লি.-এর অফিস ছুটি হলে তিনি মতিঝিল থেকে আট নম্বর বাসে করে যাত্রবাড়ির বাসায় রওনা হন৷ পথে ভাড়া বেশি চাওয়ায় প্রতিবাদ করেন তিনি৷ সন্ধ্যা পৌনে ছয়টার দিকে বাসটি যাত্রাবাড়ীর শহীদ ফারুক সরণি দিয়ে যাওয়ার সময় হেলপার আবু সায়েমকে চলন্ত বাস থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়৷ এসময় পিছন থেকে আসা তুরাগ পরিবহণের একটি বাসের চাকা আবু সায়েমের মাথা থেঁতলে দেয়৷
ঘটনাস্থলেই আবু সায়েম নিহত হন৷ এই ঘটনায় অন্য যাত্রীরা ক্ষুব্ধ হন৷ তারা বাসটি থামাতে বাধ্য করেন৷ একপর্যায়ে বাসের চালক শাহ আলম ও হেলপার মোহনকে আটক করে গণপিটুনি দেয় বিক্ষুব্ধ জনতা৷ পুলিশ গিয়ে ওই দুইজনকে উদ্ধার করে৷ বিক্ষুব্ধ লোকজন আট নম্বর বাসটি ভাঙচুরের পর পুড়িয়ে দেয়৷
‘বেশি ভাড়া নেয়ার প্রতিবাদ করায় হত্যা করা হয়’
নিহত আবু সায়েমের বড় ভাই আবু সাদাত বলেন, ‘‘আমি সন্ধ্যার পর খবর পেয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে দেখি আমার ভাই মারা গেছেন৷ যারা তাকে হাসপাতালে নিয়ে যান তারা জানান, আমার ভাই বেশি ভাড়া নেয়ার প্রতিবাদ করলে তাকে বাস থেকে ফেলে দিয়ে হত্যা করা হয়৷ আমি এই হত্যার বিচার চাই৷”
রোববার বিকালে ডয়চে ভেলের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলার সময় তিনি লাশ নেয়ার জন্য হাসপাতালের মর্গে ছিলেন৷ কথা বলতে গিয়ে বার বার তার গলা ধরে আসছিল৷ এরমধ্যেই তিনি বলেন, ‘‘আমরা আমার ভাইয়ের বিয়ের জন্য পাত্রী খুঁজছিলাম৷ এই সপ্তাহেই পাত্রী দেখার কথা ছিল৷ কিন্তু আমাদের সে আশা পূরণ হলো না৷” তার কথা , ‘‘এভাবে যদি বাস থেকে ফেলে দিয়ে মানুষ হত্যা করা হয় তাহলে আমরা কোন দেশে আছি!”
তিনি জানান, চার ভাই-বোনের মধ্যে সায়েম ছিলেন তৃতীয়৷ তাদের বাবা মারা গেছেন৷ সংসারে সায়েমের উপার্জনও অনেক সহায়তা করত৷ এখন সবই শেষ হয়ে গেল৷
যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘‘চালক-হেলপারদের এই অপরাধের বিচার হয় না৷ ফলে তারা দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে৷ আমরা এর প্রতিবাদ করলে মালিকরা মামলার হুমকি দেয়৷ আর মালিক পক্ষের অতি মুনাফার লোভের কারণে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে৷ তারা বাড়তি ভাড়া আদায় করতে মরিয়া হয়ে ওঠে৷ এ নিয়ে প্রতিদিনই যাত্রীদের সঙ্গে ঝামেলা হয়৷ আর চালক-হেলপাররা সংঘবদ্ধ হয়ে যাত্রীদের ওপর চড়াও হয়৷ গত তিন বছরে ঢাকা, গাজীপুর ও চট্টগ্রামে এভাবে ফেলে দিয়ে ১৪ জন যাত্রীকে হত্যা করা হয়েছে৷”
তিনি অভিযোগ করেন, ‘‘এই চালক-হেলপারদের কোনো প্রশিক্ষণও দেয়া হয় না৷ তাদের বড় একটি অংশ আবার মাদকাসক্ত৷’’
‘বেপরোয়া হয়ে উঠেছে চালক-হেলপাররা’
এর জবাবেসড়ক পরিবহণমালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েতুল্ল্যাহ বলেন, ‘‘এই হত্যাকাণ্ডের আমরা প্রতিবাদ জানাই৷ বিচার দাবি করি৷ এরইমধ্যে চালক ও হেলপারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷ তাদের আইনে যা আছে তাই শাস্তি হবে৷”
তবে তিনি দাবি করেন, ‘‘চালকদের সঠিক প্রশিক্ষণের দায়িত্ব শুধু মালিকদের নয়, বিআরটিএ'রও দায় আছে৷ আর আমরা তো বাসে থাকি না৷ পথে তাদের নিয়ন্ত্রণের জন্য ট্রাফিক পুলিশ আছে৷ আমরা তাদের মাদকমুক্ত রাখার জন্য ডোপ টেস্টের নিয়ম করেছি৷ এখন বিআরটিএ সেটা কীভাবে করছে তা তো বলতে পারব না৷”
যাত্রাবাড়ি থানার ইন্সপেক্টর (তদন্ত) ইয়ামিন কবির জানান, ‘‘এই ঘটনায় হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে৷ মামলায় আটক চালক ও হেলপারকে আসামি করা হয়েছে৷ তাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডে নেয়া হয়েছে৷ তদন্তে এই অপরাধে আরো কারো সম্পৃক্ততা পাওয়া গেলে তাদেরও আইনের আওতায় নেয়া হবে৷”
তিনি বলেন, ‘‘প্রাথমিক তদন্তে এটা নিশ্চিত যে ভাড়া নিয়ে কথা কাটাকাটির কারণেই আবু সায়েমকে বাস থেকে ফেলে দেয়ার পর আরেকটি বাসের চাপায় সে মারা যায়৷ তবে এটা পরিকল্পিত না উত্তেজনার কারণে হঠাৎ ঘটেছে তা আমরা তদন্ত করে দেখছি৷”
গণপরিবহণে যাত্রীদের গণভোগান্তি
বাংলাদেশ রেলওয়ের টিকিট কালোবাজারি নিয়ে মহিউদ্দিন রনি নামের এক ছাত্রের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে এই খাতে অব্যবস্থাপনার চিত্র সামনে এসেছে৷ বাকি গণপরিবহণগুলোর অব্যবস্থাপনা ও ভোগান্তিতেও ক্ষুব্ধ যাত্রীরা৷ বিস্তারিত ছবিঘরে৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
রেলের কোনো নিয়ম নেই
পারিবারিক কাজে ছোট ভাইসহ ঢাকা থেকে ঈশ্বরদী যাচ্ছেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত মোঃ মকবুল হোসেন৷ তিনি জানান, নির্ধারিত সময় পার হয়ে গেলেও তাদের ট্রেন স্টেশনেই আসেনি৷ টিকিটপ্রাপ্তি, সময়সীমা মেনে না চলা, যাত্রীসেবার মান খারাপ এসব অভিযোগ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘‘ভাড় কম, তাই নিতান্ত বাধ্য হয়েই ট্রেনে যাতায়াত করতে হয়৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
চার ঘণ্টার পরিশ্রমে টিকিট
ঈদ ছাড়া স্বাভাবিক সময়েও রেলের টিকিট পেতে ভোগান্তি পোহান যাত্রীরা৷ ঢাকা থেকে যশোর যাওয়ার জন্য কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে ২৩ জুলাই টিকিট কেটেছেন জাবেদ রহমান৷ তিনি জানান, সকাল ১০টা থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে দুপুর ২টায় টিকিট পেয়েছেন তিনি৷ অনলাইনে টিকিট না পাওয়ায় কাউন্টারে সময় নষ্ট করে টিকিট কাটতে হয়েছে তাকে৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
তবু আগের চেয়ে উন্নতি
ঢাকার জুরাইনে একটি বেসরকারি প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষকতা করেন রোকেয়া আক্তার৷ তিনি পরিবারসহ রাজশাহী যাচ্ছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘গত বছর দুয়েক ধরে ট্রেনে নিয়মিত যাতায়াত করি৷ বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে ট্রেনে ভ্রমণ আরামদায়ক৷ ট্রেনের শিডিউল এবং টিকিট প্রাপ্তিতে আগের চেয়ে কিছুটা নিয়মশৃঙ্খলা ফিরেছে, বিশেষ উপলক্ষ্য ছাড়া মোটামুটি ট্রেনের টিকিট পাওয়া যায় এখন৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
লঞ্চের প্রতিযোগিতা
সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে ঢাকা থেকে হাতিয়া যাচ্ছেন বৈদ্যুতিক মিস্ত্রী মোঃ সামিউল হাসান৷ নৌপথের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে তিনি জানান, নদীপথে প্রায়ই বড় লঞ্চগুলো ভয়ংকর প্রতিযোগিতা করে৷ তিন বছর আগে এমন এক প্রতিযোগিতায় বড় দুর্ঘটনার মুখোমুখি হয়ে অনেকদিন আর ভয়ে লঞ্চে যাতায়াত করেননি বলে জানান তিনি৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
ঈদে সীমাহীন ভোগান্তি
ঢাকা থেকে প্রায় প্রতি রোজার ঈদেই গ্রামের বাড়ি দিনাজপুরে যান পেশায় ব্যাংকার আলী আহমদ মুন্সী৷ তিনি জানান, প্রতিবারই টিকিটের সংকটে পড়তে হয়৷ আর রাস্তায় কারণে-অকারণে ঈদের সময় যানজট তো লেগেই থাকে৷ স্বাভাবিক সময়ে যেখানে ১০ মিনিট লাগে, ঈদ বা লম্বা ছুটি থাকলে সেই রাস্তা পাড়ি দিতেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা লেগে যায়৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
নারীর প্রতি সহিংসতা
ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘‘ঢাকায় গণপরিবহণে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তির শিকার হন নারীরা। ২০২২ সালের এসেও আমরা নারীদের প্রতি সহিংস আচরণ করি৷ পুরুষশাসিত এই সমাজে আমরা অন্যায়ের প্রতিবাদও করতে পারি না, মানুষ খারাপ বলে৷ যথাযথ আইনের শাসন এবং প্রয়োগের অভাবে এইসব পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে মনে করি আমি৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
প্রতিবাদ করলে দুর্ব্যবহার
পেশায় কাপড় ব্যবসায়ী ইসমাইল হোসেন জানান, সড়ক, রেল বা নৌ; যে পথেই আপনি চলাচল করেন না কেন, পরিবহণ সংশ্লিষ্ট শ্রমিকদের দৌরাত্ব্য অথবা দুর্ব্যবহার আপনাকে সহ্য করতেই হবে৷ তারা যত অন্যায়ই করুক, আপনি প্রতিবাদ করলেই বিপদ। তারা একজোট হয়ে আপনার বিরুদ্ধে তেড়ে আসবে৷’’ এক্ষেত্রে মালিক এবং সরকারপক্ষের তদারকির অভাব আছে বলে মনে করেন তিনি৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
টিকিটের উপর বাড়তি ভাড়া
ঈদের ছুটি কাটিয়ে স্বামী-সন্তানসহ ঢাকায় ফিরেছেন গুলনাহার বেগম৷ গাবতলী বাস টার্মিনালে তিনি বলে বলেন, ‘‘ঈদে বাড়ি যাওয়ার সময় টিকিটে লেখা ১৮০ টাকা, কিন্তু আমাদের কাছ থেকে নিয়েছে ২৩০ টাকা৷ কারণ জানতে চাইলে বাসের স্টাফ বলেন, ‘কোনো কারণ নাই, গেলে যান, না গেলে নাইমা যান’৷’’ পরে তিনি অন্যান্য যাত্রীদের থেকে জানতে পারেন, ভ্রাম্যমাণ আদালতের ভয়ে এই বুদ্ধি করেছে পরিবহণ সংশ্লিষ্টরা৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
পরিবারসহ যাত্রায় দুশ্চিন্তা
ঢাকার ওয়ারির বাসিন্দা ওমর ফারুক বলেন, আমার গ্রামের বাড়ি গাইবান্ধা৷ অধিকাংশ সময়ে পরিবারসহ ট্রেনেই যাতায়াত করি৷ কিন্তু ছুটি-ছাটা অথবা ঈদে ভোগান্তি এড়াতে পরিবারকে আগেই বাড়িতে পাঠিয়ে দেই৷’’ এতে কিছুটা সমস্যা হলেও সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এই ত্যাগ তাকে স্বীকার করতে হয় বলে জানান তিনি৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
সবাই সবার কাছে জিম্মি
সায়েদাবাদের বাসিন্দা পেশায় সিএনজি চালক মোঃ জাকির হোসেন বলেন, ‘‘চাল-ডাল-তেল থেকে শুরু করে পরিবহণ খাতে সবকিছু এখন সিন্ডিকেট চালায়৷ আমি নিজেও পরিবহণের চালক, কিন্তু আমিও বিভিন্ন সময় ভোগান্তি থেকে রেহাই পাই না৷ বাংলাদেশের সবাই সবার কাছে জিম্মি, আমরা যে যার জায়গা থেকে অন্যায় করে যাচ্ছি বলেই আজকে সমাজের সর্বস্তরে এই অরাজকতা ও নৈরাজ্য চলছে৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
প্রতিবাদ
রেলওয়ের অব্যবস্থাপনা, টিকিট কালোবাজারি এবং রেলখাতে দুর্নীতির প্রতিবাদে গত জুলাইয়ে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মহিউদ্দিন রনি৷ তিনি নিজে ভুক্তভোগী হবার পর থেকে এ প্রতিবাদ শুরু করেন এবং ছয়দফা দাবি উপস্থাপন করেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে৷