একের পর এক ব্লগার হত্যার ঘটনায় মুক্ত চিন্তা ও স্বাধীনভাবে মত প্রকাশে ইচ্ছুকদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে৷ ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা বিভাগ অন্তত আরো তিনজন ব্লগারের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত৷
বিজ্ঞাপন
এদিকে, বিশ্লেষক ও ব্লগাররা মনে করেন, অপরাধীদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনা না গেলে পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যেতে পারে৷
সোমবার ব্লগার ওয়াশিকুর রহমানকে হত্যার পর এটা এখন নিশ্চিত যে তাঁকেও ধর্মীয় উগ্রবাদীরা হত্যা করেছে৷ আর ব্লগে ইসলাম ধর্ম নিয়ে ‘আপত্তিকর' লেখালেখির অভিযোগেই তাঁকে হত্যা করা হয় বলে আটক মাদ্রাসার দুজন ছাত্র স্বীকার করেছে৷ এই ঘটনায় তারা মোট চারজন জড়িত বলে জানিয়েছে৷ তাদের মধ্যে দুজন আবু তাহের এবং মাসুম পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়৷ তারা পালিয়ে গেলেও সোমবার ঘটনাস্থল থেকে মাদ্রাসা ছাত্র জিকরুল্লাহ এবং আরিফুল ইসলামকে আটক করা হয়৷
তাদের আট দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে৷ নিহত ওয়াশিকুরের ভগ্নিপতি মনির হোসেন বাদি হয়ে ওই চারজনের বিরুদ্ধে থানায় মামলা করেছেন৷
পরবর্তী টার্গেট?
বাংলাদেশে ব্লগাররা যে ধর্মীয় উগ্রবাদীদের টার্গেটে পরিণত হয়েছেন তা এখন স্পষ্ট৷ ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি) এরকম আরো তিনজন ব্লগারকে চিহ্নিত করেছে যাদের নতুন করে টার্গেট করা হয়েছে৷ উগ্রবাদীরা এই তিনজনের ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লাল ক্রস চিহ্ন দিয়ে তাদের খোঁজ দেয়ার আহ্বান জানিয়েছে৷ ডিবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সূত্র ধরে তিন ব্লগার এবং তাদের যারা টার্গেট করেছে সেই উগ্রবাদীদের চিহ্নিত করার চেষ্টা করছে৷
অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ, বিচারের দাবি
বইমেলা থেকে ২৬শে ফেব্রুয়ারি রাতে ফেরার পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সন্ত্রাসীদের হামলায় নিহত হন ব্লগার অভিজিৎ রায়৷ মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা অভিজিতকে হত্যার প্রতিবাদে উত্তাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়৷
ছবি: DW
যেখানে হামলার শিকার অভিজিৎ, বন্যা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকার ফুটপাথ৷ লেখক, ব্লগার অভিজিৎ রায়ের নিহত হবার এই জায়গাটা নিরাপত্তা বেষ্টনী দিয়ে ঘিরে রেখেছে বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী৷ হামলায় তাঁর স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যাও গুরুতর আহত হন৷
ছবি: DW
বেঁচে গেছেন বন্যা
হামলার পর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অভিজিৎ রায়ের স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা৷ দুষ্কৃতিকারীরা তাঁকে কুপিয়ে জখম করলেও প্রাণে বেঁচে যান অ্যামেরিকায় বসবাসকারী এই ব্লগার৷ বর্তমানে স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন তিনি৷
ছবি: DW
নির্বাক অজয় রায়
ছেলের মৃত্যুর খবরে নির্বাক নিহত অভিজিৎ রায়ের বাবা অজয় রায়৷ আজয় রায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের শিক্ষক ছিলেন৷
ডিবির যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এধরণের ঘটনা যাতে আর না ঘটে তার আগাম ব্যবস্থা নিতে আমরা চেষ্টা করছি৷ এজন্য যারা টার্গেটে পরিণত হয়েছেন তাদের নিরাপত্তা ও আগাম সতর্কতার পাশাপাশি উগ্রবাদীদের আইনের আওতায় আনার জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সতর্ক নজর রাখা হচ্ছে৷''
ব্লগাররা আতঙ্কে
লেখক ও ব্লগার মাহমুদুল হক মুন্সী বাধন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আসলে এখন আমাদের মধ্যে সার্বক্ষণিকভাবে এক ধরণের নিরাপত্তাহীনতা কাজ করে৷ আমরা যখন অফিসে যাই বা কাজে বাইরে যাই তখন আমরা ধরেই নিই যে আমাদের ওপর হামলা হতে পারে৷ কারণ সরকার বা পুলিশ প্রশাসন আমাদের নিরাপত্তা বা উগ্রবাদীদের নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হচ্ছে৷'' তিনি বলেন, ‘‘একমাস আগে অভিজিৎ রায়কে হত্যা করা হয়েছে৷ ২০১৩ সালে হত্যা করা হয় ব্লগার আহমেদ রাজীব হয়দারকে৷ আসিফ মহিউদ্দীনের ওপর হামলার পর সে প্রাণে বেঁচে যায়৷ আরো অনেক ব্লগারের ওপর হামলা হয়েছে৷ এসব ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার হলে হয়তো নতুন কোনো দুঃখজনক ঘটনা ঘটতোনা৷''
তিনি বলেন, ‘‘যারা এসব হত্যাকাণ্ডে জড়িত তারা মাদ্রাসা ছাত্র অথবা উগ্রবাদী৷ তাই আমাদের শিক্ষা ও সমাজ ব্যবস্থায়ও পরিবর্তন প্রয়োজন৷ কাউকে হত্যা করা, আঘাত করা যে ধর্মরক্ষা নয়, তা তাদের বোঝাতে হবে৷ সমাজের অন্ধকার দিকগুলো দূর করা না গেলে উগ্রবাদও দূর করা যাবে না৷ আর স্বাধীন চিন্তা যে প্রগতির জন্যই প্রয়োজন তা বোঝাতে হবে৷''
মাহমুদুল হক মুন্সী বলেন, ‘‘একটি মহল ব্লগারদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়াচ্ছে, উস্কানি দিচ্ছে৷ এটা বন্ধ হওয়া প্রয়োজন৷ এর আগে হামলার শিকার ব্লগারদের উল্টো গ্রেপ্তারেরও একাধিক ঘটনা আছে৷ সরকারের অবস্থানও পরিষ্কার হওয়া দরকার৷''
‘নাস্তিক ব্লগার’ ইস্যুতে ইসলামি দলের তাণ্ডব
কয়েকজন ব্লগারের বিরুদ্ধে কথিত ‘ধর্মনিন্দার’ অভিযোগে তাদের মৃত্যুদণ্ডের দাবিতে ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকাসহ বাংলাদেশের কয়েক এলাকায় তাণ্ডব চালিয়েছে বিভিন্ন ইসলামি দল৷ এতে প্রাণহানিসহ বেশ কয়েকজন আহত হয়েছে৷
ছবি: Reuters
বায়তুল মোকাররম এলাকা রণক্ষেত্র
শুক্রবার (২২.০২.১৩) দুপুর বারোটার দিকে বায়তুল মোকাররম এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়৷ ১২টি ইসলামি ও সমমনা দল আগেই ঘোষণা দিয়েছিল, তাদের ভাষায় যেসব ব্লগার ইন্টারনেটে ‘ধর্মনিন্দা’ করে বিভিন্ন নিবন্ধ লিখছে, তাদের ফাঁসির দাবিতে শুক্রবার জুম্মার নামাজের পর আন্দোলন করা হবে৷ কিন্তু সেই আন্দোলন অল্প সময়ের মধ্যেই তাণ্ডবে রূপ নেয়৷ এতে বেশ কয়েকজন সাংবাদিকও আহত হন৷
ছবি: AFP/Getty Images
‘পরিকল্পিত অ্যাকশন’
ঢাকা থেকে আমাদের প্রতিনিধি হারুন উর রশীদ স্বপন জানিয়েছেন, ‘শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের বিরুদ্ধে পরিকল্পিতভাবেই সহিংস অ্যাকশনে গেল জামায়াত-শিবির ও তাদের সহযোগীরা৷ ব্লগে ইসলামের বিরুদ্ধে কথিত কটূক্তির কথা বলে তাদের ভাষায় ‘মুরতাদ-নাস্তিকদের’ ফাঁসির দাবিতে আগেই শুক্রবার জুম্মার নামাজের পর কর্মসূচি দেয়৷ আর আজ (২২.০২.১৩) জুম্মার নামাজের আগেই তারা তাণ্ডব শুরু করে৷’
ছবি: Reuters
শাহবাগে হামলার চেষ্টা
শুক্রবার (২২.০২.১৩) পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে ইসলামি দলের সদস্যরা শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চের দিকে এগোতে চাইলে সংঘর্ষ পল্টন হয়ে প্রেসক্লাব পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে৷ ককটেল, গুলি আর টিয়ার গ্যাসের সেলে পুরো এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়৷ প্রায় একই সময়ে ঢাকার কাঁটাবনে শাহবাগ বিরোধীরা রাস্তায় নামে৷ তারাও শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের দিকে এগোনোর চেষ্টা করে৷ সেখানেও পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ হয়৷
ছবি: AFP/Getty Images
ঢাকার বাইরে তাণ্ডব, প্রাণহানি
ঢাকার বাইরে চট্টগামের প্রেসক্লাবে হামলা হয়েছে৷ তাদের হামলায় পুলিশ এবং সাংবদিকসহ ২০ জন আহত হয়েছেন৷ বগুড়া, রাজশাহী, সিলেট, চাঁদপুরে গণজাগরণ মঞ্চে হামলা চালায় তারা৷ হামলা চালায় সিলেট শহীদ মিনারে৷ সেখানে একজন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে৷ শুক্রবার বিকেল অবধি পাওয়া খবর অনুযায়ী, গাইবন্ধায় ২ জন এবং ঝিনাইদহে জাগরণ মঞ্চ বিরোধীদের সঙ্গে জনতার সংঘর্ষে একজন নিহত হয়েছেন৷
ছবি: Reuters
শাহবাগে জনতা
দেশব্যাপী ইসলামি দলগুলোর এই তাণ্ডবের পর শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরে আবারো ভিড় বাড়তে শুরু করেছে৷ ব্লগারদের ডাকে গত পাঁচ ফেব্রুয়ারি থেকে এই চত্বরে অবস্থান করছেন অগুনতি মানুষ৷ তাদের মূল দাবি হচ্ছে, ‘‘মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার, জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ, তাদের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বয়কট৷’’
ছবি: Reuters
তাণ্ডবের পর নতুন কর্মসূচি
শাহবাগের তরুণ প্রজন্মের এই আন্দোলনের অন্যতম উদ্যোক্তা ইমরান এইচ সরকার শুক্রবার সন্ধ্যায় জাগরণ মঞ্চ থেকে দাবি করেন, ‘‘আজকের (২২.০২.১৩) হামলায় উস্কানি দিয়েছে জামায়াত শিবিরের পত্রিকা আমার দেশ৷ আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এর সম্পাদক মাহামুদুর রহমানকে গ্রেপ্তার করতে হবে৷ তা না হলে বৃহত্তর কর্মসূচি দেয়া হবে৷’’ বাংলাদেশে ডয়চে ভেলের কন্টেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম জানিয়েছে এই তথ্য৷
ছবি: Reuters
ইন্টারনেটে সতর্ক দৃষ্টি
‘ধর্মীয় ভাবমূর্তিতে আঘাত হানছে’ এরকম ইন্টারনেট ওয়েবসাইট খুঁজে খুঁজে বন্ধ করে দিচ্ছে বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ৷ ইতোমধ্যে কমপক্ষে দুটি ওয়েবসাইট বন্ধ এবং দশটি ব্লগ পোস্ট মুছে দেওয়া হয়েছে৷ বার্তাসংস্থা এএফপিকে এই তথ্য জানিয়েছেন টেলিকমিউনিকেশন নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি'র ভাইস-চেয়ারম্যান গিয়াসউদ্দিন আহমেদ৷
ছবি: picture-alliance/ dpa
রোববার হরতাল
শুক্রবার ঢাকাসহ সারা দেশে ব্যাপক তাণ্ডব চালানোর পর রোববার সারাদেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছে ‘জামায়াত নিয়ন্ত্রিত’ ১২টি ইসলামি দল৷
ছবি: Reuters
8 ছবি1 | 8
হত্যার বিচার না হওয়া একটি কারণ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. সফিউল আলম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এটা নিশ্চিত যে ধর্মান্ধ মৌলবাদী গোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে একের পর এক ব্লগারকে হত্যা করছে৷ তাদের আইনের আওতায় আনা না গেলে পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যেতে পারে৷ আরো অনেক ব্লগারের জীবন আশঙ্কার মুখে পড়তে পারে৷ তাই সরকার ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর এখনই এই ধর্মান্ধ উগ্রবাদীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া উচিত৷''
তিনি বলেন, ‘‘ভিন্ন চিন্তা বা ভিন্ন মতের জবাব কখনো হত্যা নয়৷ মুক্ত ও স্বাধীন চিন্তা মানুষের অধিকার৷ আর হত্যা একটি জঘন্যতম অপরাধ৷ ভিন্ন মতের প্রতি যে সমাজ সহনশীল নয়, সেটাকে আমরা সভ্য সমাজ বলি না৷''
সফিউল আলম বলেন, ‘‘অতীতে ব্লগারদের ওপর আক্রমণ এবং হত্যার বিচার না হওয়ায় এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে৷''
প্রসঙ্গত, গত ২৬শে ফেব্রুয়ারি বইমেলা থেকে বের হওয়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা ও লেখক অভিজিৎ রায়কে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা৷
২০১৩ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি বাসায় ফেরার পথে পল্লবীর কালশীর পলাশনগরে একইভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয় গণজাগরণ মঞ্চের অন্যতম সংগঠক ও ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার শোভনকে৷
এর আগে ২০০৪ সালের ২৭শে ফেব্রুয়ারি বইমেলা থেকে বের হওয়ার সময় প্রথাবিরোধী লেখক হুমায়ুন আজাদকে কুপিয়ে গুরুতর আহত করে দুর্বৃত্তরা৷ পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় জার্মানিতে তার মৃত্যু হয়৷