নরেন্দ্র মোদীর ঢাকা সফরের আগে তিস্তা জলবন্টন চুক্তি নিয়ে নতুন বিতর্ক তৈরি করে দিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রোববার উত্তরবঙ্গের শিলিগুড়িতে এক নির্বাচনী সমাবেশে তিনি বলেছেন, ''বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ভালো। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আমার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। কিন্তু তিস্তা চুক্তির বিষয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে কোনো আলোচনাই করেনি। আমরা স্পষ্ট জানিয়ে দিচ্ছি, পশ্চিমবঙ্গে তিস্তার জল যথেষ্ট পরিমাণে থাকলে তবেই আমরা জলবন্টনে রাজি হব।'' মমতা বলেছেন, তিস্তার জলে উত্তরবঙ্গেরও 'হিস্সা' অর্থাৎ, ভাগ আছে। সেই ভাগ পশ্চিমবঙ্গ কোনোভাবেই ছাড়বে না। অর্থাৎ, ভোটের মুখে তার আগের অবস্থানের কথাই আবার জানিয়েছেন মমতা।
মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার আগে মনমোহন সিং প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীনই তিস্তা জলবন্টন চুক্তি অনেকটা এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু তখনো মমতা সেই চুক্তিতে রাজি হননি। ফলে শেষপর্যন্ত বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করা যায়নি। বাংলাদেশ বরাবরই ভারতের সঙ্গে যে কোনো আলোচনায় তিস্তার প্রসঙ্গ উত্থাপন করে। ভারত-বাংলাদেশ শেষ ভার্চুয়াল বৈঠকেও শেখ হাসিনা নরেন্দ্র মোদীর কাছে তিস্তা চুক্তির বিষয়ে জানতে চেয়েছিলেন। ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সূত্র ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছে, আগামী ২৬ মার্চ মোদী ঢাকায় গেলে ফের এ বিষয়ে আলোচনা হতে পারে। তার আগে মমতার এই মন্তব্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
তিস্তা চুক্তি নিয়ে ভারতীয়রা যা ভাবছেন
শেখ হাসিনা ভারতে এলেও তিস্তা চুক্তি আপাতত হচ্ছে না৷ তারপরেও তিস্তার দিকে চাতক পাখির মতো তাকিয়ে আছে বাংলাদেশ৷ আশা-আকাঙ্খায় দিন গুনছে বহু মানুষ৷ চলুন জেনে নেওয়া যাক ভারতের কয়েকজন সাধারণ মানুষ এ সম্পর্কে কী ভাবছেন৷
ছবি: DW/A. Chatterjee
সুস্মিতা সর্বাধিকারী, কবি ও সমাজসেবী
তিস্তা নদী ভারতের যে যে রাজ্যের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে, বাংলাদেশের সঙ্গে জলবণ্টন চুক্তিতে সেই রাজ্যগুলির স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রেখে আন্তর্জাতিক স্তরে চুক্তিবদ্ধ হওয়া আবশ্যক৷ তা না হলে অন্যান্য জলচুক্তির ক্ষেত্রে ভারত যে শিক্ষা পেয়েছে, এক্ষেত্রেও তা-ই হবে৷ মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির অবস্থান সাধুবাদের যোগ্য৷
ছবি: DW/R. Chakraborty
মলয় হালদার, পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন প্রশাসনিক কর্তা
নদীর গতিপথ যখন প্রাকৃতিকভাবে নিয়ন্ত্রিত হতো, তখন কোনো দেশের একক সিদ্ধান্ত কার্যকর করা সহজ হতো না৷ এখন ভাটির দেশকে নির্ভর করতে হয় উজান দেশের মনোভাবের ওপর৷ তিস্তার জল যেমন ভারতের, তেমনি বাংলাদেশেরও৷ শুধু উত্তরবঙ্গের কথা বলে আন্তর্জাতিক বন্ধুত্বকে বলি দেওয়া সমীচীন নয়৷
ছবি: DW/R. Chakraborty
পাপন মালাকার, বেসরকারি সংস্থার কর্মী
বাংলাদেশের সঙ্গে কোথায় যেন আত্মার টান অনুভব করি৷ আমরা জল অপচয় করব আর প্রতিবেশী দেশের ভাই-বোনেরা জলের অভাবে কষ্ট পাবে এটা মন থেকে মেনে নিতে পারি না৷ তবে, মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি যে যুক্তি দেখিয়েছেন তা নিয়েও আলোচনা প্রয়োজন৷
ছবি: DW/R. Chakraborty
কমলিকা ভট্টাচার্য, চাকুরিজীবী
তিস্তা একটি আন্তর্জাতিক নদী৷ এই ধরনের নদীতে কোনো একটি দেশ বা রাজ্যের একছত্র অধিকার থাকে না৷ সিকিম থেকে গজলডোবা পর্যন্ত তিস্তার ওপর বেশ কয়েকটি বাঁধ নির্মাণের কারণে বাংলাদেশের রংপুর-রাজশাহী অঞ্চল মরুর চেহারা নিচ্ছে৷ সেক্ষেত্রে নদী বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে প্রতি বছর এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত শুখা মরশুমে দুই দেশের মধ্যে সমবন্টনের নীতি গ্রহন করা উটিত৷
ছবি: DW/R. Chakraborty
অসীম দাস, সমাজসেবী
নদীর জল আটকে রাখার চেষ্টা, নিজের অধিকারের এক্তিয়ার বলে মনে করা নেহাৎ মুর্খামি৷ ভারত বা বাংলাদেশ উভয়েই কৃষিপ্রধান দেশ৷ কৃষিকাজ না হলে দুর্ভিক্ষ নেমে আসবে৷ বাংলাদেশকে তিস্তার জল না দিয়ে ভারত যদি শুধুমাত্র নিজের স্বার্থ দেখে, তাহলে ভবিষ্যতে নেপাল যদি ভারতকে ব্রহ্মপুত্র নদীর জল দিতে অস্বীকার করে, কী হবে তখন?
ছবি: DW/R. Chakraborty
বনশ্রী কোনার, হোম মেকার
দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যখন বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইছেন, তখন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি ‘ইগো’ নিয়ে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন৷ এমনটা কখনওই কাম্য নয়৷ দেশ তথা সার্বিক স্বার্থকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া উচিত৷
ছবি: DW/R. Chakraborty
অভিজিৎ চ্যাটার্জি, প্রকাশনী সংস্থার কর্মী
তিস্তা জলবণ্টন চুক্তি হোক বা না হোক, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকে নিজের রাজ্যে রাজনীতি করতেই হবে৷ তাই তাঁকে রাজ্যবাসীর স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রেখে কাজ করতে হয়৷ নদীর জলে কোনোরকম নিয়ন্ত্রণ না রেখে উত্তরবঙ্গকে বঞ্চিত করে বাংলাদেশকে জল দেওয়ার মধ্যে কোনও মহত্ব নেই৷ বরং সবার আগে রাজ্যবাসীর দিকে তাকানো উচিত৷
ছবি: DW/R. Chakraborty
মানবেন্দু সরকার, কলেজ শিক্ষক
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে আসছেন৷ তিস্তা জলবণ্টন চুক্তি নিয়ে চূড়ান্ত আলোচনা করে প্রাথমিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর এটাই উপযুক্ত সময়৷ হাসিনা চাইছেন, নরেন্দ্র মোদী চাইছেন৷ সিকিমের মুখ্যমন্ত্রীও চাইছেন৷ বেঁকে বসেছেন মমতা ব্যানার্জি৷ এটা সৌহার্দ্যের ছবি নয়৷ ভুল বার্তা যাচ্ছে৷
ছবি: DW/R. Chakraborty
রাখী বিশ্বাস, কলেজ ছাত্রী
দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে তিস্তাচুক্তি নিয়ে আলোচনা চললেও তা ফলপ্রসূ হয়নি৷ ফলে তিস্তার জলের দিকে তাকিয়ে আছে বাংলাদেশ৷ মমতা ব্যানার্জিকেই ঠিক করতে হবে, উনি রাজনীতি করবেন, নাকি দেশের স্বার্থে প্রধানমন্ত্রীর পাশে দাঁড়াবেন৷
ছবি: DW/R. Chakraborty
9 ছবি1 | 9
বিশেষজ্ঞদের একাংশের বক্তব্য, পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনের আগে মমতা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই এই মন্তব্য করেছেন। গত লোকসভা নির্বাচনে উত্তরবঙ্গে বিজেপি অত্যন্ত ভালো ফল করেছিল। মমতা বিজেপির সেই ভোট নিজের দিকে ফিরিয়ে আনার জন্য উত্তরবঙ্গে দাঁড়িয়েই তিস্তা বিতর্ক নতুন করে তুলে দিলেন। এর ফলে উত্তরবঙ্গের একাংশের মানুষ মমতাকে পছন্দ করবেন বলে তাদের অভিমত। অন্যদিকে, তিস্তার জলবন্টন নিয়ে মোদী কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার আগে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনের কথা ভাববেন। তিস্তা চুক্তি হলে উত্তরবঙ্গের মানুষ যে তা ভালো ভাবে নেবেন না, মোদী তা ভালোই জানেন। মমতা সেই সুযোগটা রাজনীতির দিকে থেকে কাজে লাগাচ্ছেন।
বিশেষজ্ঞদের একাংশের বক্তব্য, তিস্তার জলবন্টনের বিষয়টি আন্তর্জাতিক আইন মেনেই করতে হবে। এবং সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের দাবি সঙ্গত। ভারত যে ভাবে চুক্তিটি ঝুলিয়ে রেখেছে, তা ঠিক নয়। আবার এও ঠিক, জলবন্টন হলে, উত্তরবঙ্গের একাংশের মানুষ সমস্যায় পড়বেন। তারা তিস্তার জলের উপরেই নির্ভরশীল। এবং সে কারণে প্রথম থেকেই মমতা এর বিরোধিতা করছেন। গরমের সময় তিস্তায় জলের পরিমাণ অনেকটাই কমে যায়।
ভারতের আইন অনুযায়ী, নদীর জলবন্টনের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারই শেষ কথা বলে। ফলে কেন্দ্রীয় সরকার বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করে ফেললে পশ্চিমবঙ্গের কিছু বলার থাকবে না। কিন্তু রাজনৈতিক ভাবে কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে বিপুল দ্বন্দ্ব তৈরি হবে। সেই দ্বন্দ্ব এড়াতেই মনমোহন সিং শেষ পর্যন্ত চুক্তি করতে পারেননি। মোদীও এতদিন পশ্চিমবঙ্গের আপত্তি উপেক্ষা করে চুক্তি করেননি। পশ্চিমবঙ্গের গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনের মুখে নরেন্দ্র মোদী কী করেন, সেটাই এখন দেখার। বিষয়টি জটিল কারণ, বাংলাদেশও তিস্তার জলবন্টন নিয়ে ভারতের উপর চাপ বাড়াচ্ছে। বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হলে ভারতও খুব বেশিদিন বিষয়টিকে ঝুলিয়ে রাখতে পারবে না। মমতা এই সময় তিস্তা প্রসঙ্গ তুলে বার্তা দিতে চেয়েছেন যে, রাজ্যে বিজেপি ক্ষমতায় এলে তিস্তা চুক্তি সম্ভবত হয়ে যাবে। তাতে উত্তরবঙ্গের অসুবিধা হবে। তিনি ক্ষমতায় থাকলে উত্তরবঙ্গের স্বার্থ রক্ষা করতে পারবেন। সেজন্যই ভোটের মুখে তিস্তা চুক্তির প্রসঙ্গ তুলেছেন তিনি।