1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

আত্রেয়ীর পানি নিয়ে নয়া বিতর্ক

১২ মে ২০১৭

তিস্তা চুক্তি নিয়ে বাংলাদেশ-পশ্চিমবঙ্গের বিরোধের মধ্যেই নয়া বিতর্কের সূত্রপাত৷ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তিস্তা চুক্তিতে নারাজ৷ ভারত সরকার এ চুক্তিতে তাদের তরফে মৌখিক সম্মতি জানিয়ে বল ঠেলে দিয়েছে নবান্নের কোর্টে৷

Staudamm Fluß Teesta Indien
ছবি: DW/A. Chatterjee

তিস্তা নদীর জল বা পানিবণ্টন নিয়ে এখন যুযুধান দুই বাংলা৷ এই পরিস্থিতিতে কিছুটা কোণঠাসা মমতার হাতে পাল্টা অস্ত্র আত্রেয়ী৷ রাজনৈতিক কারণেই জেলার মানুষ ডাক দিয়েছে, বাঁধ ভেঙে দাও বাংলাদেশ৷ তবে তোমাদের পানির দাবি মানা হবে৷

পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার প্রাণরেখা আত্রেয়ী নদী৷ স্বাধীনতার সময় দুই বাংলার অনেক কিছুর মতোই আত্রেয়ীর হৃদয় দিয়ে কাঁচি চলেছে৷ তাতে স্থানীয় মানুষজনের আদরের আত্রাই বা আত্রেই এখন দু'দেশের মধ্যে একাধিক খণ্ডে বহমান৷ এই নদীর মোট দৈর্ঘ্য ৩৯০ কিলোমিটার৷ শিলিগুড়ির বৈকুণ্ঠপুর জঙ্গল থেকে আত্রেয়ী ঢুকে পড়েছে বাংলাদেশে৷ সেখানে দিনাজপুর জেলা ঘুরে ফের এপারে দক্ষিণ দিনাজপুরে তার প্রবেশ৷ বালুরঘাট ও কুমারগঞ্জ ব্লককে শস্যশ্যামলা করে আবার তা বাংলাদেশের হাতছানিতে সে দেশে ঢুকে পড়েছে৷

Subodh Sarkar - MP3-Stereo

This browser does not support the audio element.

এতদিন কার্যত সংবাদের বাইরে থাকা আত্রেয়ী কীভাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতিয়ার হয়ে উঠল? সেটা বুঝতে গেলে, একটু পিছনে তাকাতে হবে৷ ভারতের অংশে একসময়ের বেগবতী এই নদী এখন শীর্ণকায়৷ বছরের অধিকাংশ সময়ই তাতে পানি থাকে না৷ নদীর বুকে চরের পরিধি ক্রমশ বাড়ছে৷ এই নদীর জলেই পুষ্ট পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার কৃষি৷ কুমারগঞ্জ, বালুরঘাট, চকভৃগুর কৃষিজীবীর কাছে আত্রেয়ীর জলই প্রধান রসদ৷ কিন্তু, নদীর আর সেই বেগ নেই, এপারের ক্ষীণস্রোতা আত্রেয়ী নিঃস্ব, সে আর কৃষক সমাজকে কী দেবে! বাংলাদেশ ও ভারত সরকারের চাপের মুখে এই নিঃস্বতাকেই হাতিয়ার করেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী৷ 

এ মাসের প্রথম সপ্তাহে উত্তরবঙ্গে জনসভা করেন মমতা৷ সেখানেই তাঁর মুখে আত্রেয়ী নিয়ে জোরদার জেহাদের সুর শোনা যায়৷ জেহাদের নেপথ্যে এই নদীর উপর তৈরি করা বাংলাদেশের বাঁধ৷ তাঁর অভিযোগ, ঢাকা ওপারে আত্রেয়ীতে বাঁধ দিয়েছে৷ এর ফলে এদিকে জল প্রায় আসছেই না৷ তাই নদী একেবারে শুকিয়ে গিয়েছে৷ কৃষকদের চাষবাসে সমস্যা হচ্ছে৷ আবার বর্ষার সময় লকগেট খুলে দেওয়া হচ্ছে৷ তাতে এপারে অনেক জায়গা ভেসে যাচ্ছে৷ এই অভিযোগ করেই মমতা তিস্তার পাল্টা অস্ত্র ব্যবহার করেন৷ বলেন, ‘‘বাংলাদেশ যদি জল চায়, আমরা সাধ্য মতো দেওয়ার চেষ্টা করব৷ কিন্তু ওপারে আত্রেয়ীর উপর বাঁধ ভেঙে দিতে হবে৷ আমাদেরও জল দরকার৷'' বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে মমতার মধুর সম্পর্কে কিছুটা সমস্যা তৈরি করেছে তিস্তা বিতর্ক৷ এর পিছনে পশ্চিমবঙ্গের শাসকদল দিল্লির ইন্ধনও দেখছে৷ সে ব্যাপারে সচেতন মমতা বলেন, ‘‘বাংলাদেশ আমাদের মিত্র৷ বন্ধু দেশকে বলব, বাঁধ সরিয়ে নিন৷ এপারের কৃষকরা বাঁচুক৷''

যে বাঁধ নিয়ে বিতর্ক, তা ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের একেবারে কাছেই৷ বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমবঙ্গের কুমারগঞ্জের সমজিয়া সীমান্ত দিয়ে ভারতে ঢুকেছে আত্রেয়ী৷ সমজিয়া থেকে মাত্র ১৪০০ মিটার দূরে মোহনপুরে চিনের সহযোগিতায় নদীর উপর বাঁধ তৈরি করেছে বাংলাদেশ৷ এর ফলেই গত দু'বছর ধরে দক্ষিণ দিনাজপুরে জলসংকট দেখা দিয়েছে বলে এপারের মানুষের অভিযোগ৷ এই জেলার প্রায় ৬০ কিলোমিটার এলাকায় বহমান আত্রেয়ী৷ সরকারি হিসেব অনুযায়ী, এই এলাকায় প্রায় আড়াই হাজার হেক্টর জমি সেচের আওতায় রয়েছে, যার জন্য আত্রেয়ীর জলের উপর নির্ভর করতে হয়৷ গ্রীষ্মকালে নদী শুকিয়ে যাওয়ায় সেচ ব্যবস্থা কোনো কাজে আসছে না৷ জলের অভাবে কৃষিকাজের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে৷ এ বছর দফায় দফায় বৃষ্টি হওয়ায় পরিস্থিতি কিছুটা ভালো, গত বছরের তুলনায় বেশি জল রয়েছে আত্রেয়ীতে৷ তবে প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে থাকলে সমস্যার সমাধান হবে না, ঘোর অনিশ্চয়তাও থাকবে৷ শুধু কৃষি নয়, মৎস্যজীবীরাও এই নদীর উপর নির্ভরশীল৷ পরিবহণের ক্ষেত্রেও আত্রেয়ী গুরুত্বপূর্ণ৷

আত্রেয়ী বাঁচানোর আন্দোলন মুখ্যমন্ত্রীর দাবিতে নতুন প্রাণ পেয়েছে৷ বাংলাদেশকে মোহনপুরের বাঁধ ভেঙে দিতে হবে, ক্রমশ এই দাবি জোরালো হচ্ছে৷ ছাত্র-ছাত্রীরা স্বাক্ষর সংগ্রহ করছে, দাবিপত্র জমা দিচ্ছে প্রশাসনের কাছে৷ কিন্তু একটি আন্তর্জাতিক বিষয় নিয়ে এত সহজে সমাধান সম্ভব নয়, সেটা দু'পক্ষেরই জানা আছে৷ তাই তিস্তার পর আত্রেয়ী ভারতীয় রাজনীতির এক নয়া বিতর্কের রসদ হয়ে উঠেছে৷ কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি ও পশ্চিমবঙ্গের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের মধ্যে রাজনৈতিক লড়াই এখন তুঙ্গে৷ তাতে আরও ইন্ধন জোগাচ্ছে রুখা-শুখা এক নদী৷

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আত্রেয়ীর প্রসঙ্গ সামনে এনে ভারত সরকারের উপর চাপ তৈরির চেষ্টা করেছেন৷ বাংলার রাজনীতিতে ক্রমশ শক্তি সঞ্চয় করতে থাকা বিজেপির মোকাবিলায় এটা তৃণমূলনেত্রীর আর একটি চাল বলে মনে করছেন রাজনীতির বিশেষজ্ঞরা৷ বাংলাজুড়ে গত বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূলের ঝড় উঠলেও দক্ষিণ দিনাজপুরে বামেরা ভালো ফল করেছিল৷ পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি ক্রমশ বামেদের ভোটব্যাংক দখল করছে৷ উত্তরবঙ্গে এই জেলাতে যদি রাজনৈতিক জমি বামেদের হাত থেকে গেরুয়া শিবিরের কাছে যায়, সেটা মমতার মাথাব্যথা বাড়াবে৷ তাই এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চাইছেন তৃণমূলনেত্রী – কেন্দ্রীয় সরকারকে রাজ্যের দাবির কথা বলে তিস্তার পাল্টা চাপ দিচ্ছেন এবং উত্তরবঙ্গে বিজেপির রাজনৈতিক উত্থানের প্রতিষেধক প্রয়োগ করছেন৷ বাংলাদেশের বিরুদ্ধে জিগির তুলে সহজেই বিজেপি দক্ষিণ দিনাজপুরের মানুষের মন জয় করতে পারত৷ কিন্তু নরেন্দ্র মোদীর দল দেরি করায় আত্রেয়ীর অস্ত্র ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধেই ব্যবহার করেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী৷ 

Arpita Ghosh - MP3-Stereo

This browser does not support the audio element.

আত্রেয়ী প্রসঙ্গে কেন্দ্র-রাজ্য বিরোধ আগামীতে আরও তীব্র হতে চলেছে, এমনই ইঙ্গিত মিলেছে বালুরঘাটের তৃণমূল কংগ্রেস সাংসদ ও নাট্যব্যক্তিত্ব অর্পিতা ঘোষের কথায়৷ তাঁর ক্ষোভ, ‘‘গত বছর ১০ আগস্ট কেন্দ্রীয় সরকারকে চিঠি দিয়েছিলাম৷ কিছুদিন আগে তার জবাব পেয়েছি৷ তাতে বলা হয়েছে, এ ব্যাপারে রাজ্য সরকারের সঙ্গে কথা বলতে হবে৷'' অর্পিতার প্রশ্ন, ‘‘একটা আন্তর্জাতিক বিষয়ে রাজ্য সরকার কীভাবে বাংলাদেশের সঙ্গে কথা বলবে? মোদী সরকারের এই পরামর্শ হাস্যকর৷'' সাংসদ জানিয়েছেন, ‘‘আমি আবার আত্রেয়ীর প্রসঙ্গ লোকসভায় তুলব৷ কেন্দ্রের কাছে হাস্যকর প্রস্তাবের ব্যাখ্যা চাইব৷'' বিশ্লেষকদের একাংশের মত, বিজেপির রাজনৈতিক ইস্যু মমতা কেড়ে নেওয়ায় পাল্টা তিস্তা নিয়ে চাপ বাড়াতে পারে কেন্দ্রীয় সরকার৷ বাংলাদেশের সঙ্গে বোঝাপড়া যাই হোক, ভারতের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে উর্বর করে তুলেছে নদীর জল৷

এই দুই নদীর বহমানতার অতীতে তাকালে মনে হবে, তিস্তার গর্ভেই যেন আত্রেয়ী বিতর্কের বীজ লুকিয়ে ছিল৷ তিস্তার তিনটি শাখানদীর একটি থেকে আত্রেয়ীর জন্ম৷ পরে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে গতিপথ বদলে যায়৷ তিস্তা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় আত্রেয়ী৷ বিচ্ছিন্ন হলেও তাদের মধ্যে যেন অন্তঃসলিলা যোগ বিদ্যমান আজও৷ তাই কি তিস্তা বিতর্কের মধ্যেই চর সরিয়ে জেগে উঠেছে আত্রেয়ী? জলবণ্টন-বিতর্ক ভাবাচ্ছে বাংলার নাগরিক সমাজকেও৷ পশ্চিমবঙ্গের বুদ্ধিজীবীদের একাংশ অবশ্য মমতারই পাশে৷ তাঁরা মুখ্যমন্ত্রীর বিকল্প প্রস্তাবের উপর জোর দিচ্ছেন৷ কবি সুবোধ সরকারের মত, ‘‘নদীর জল উত্তরবঙ্গের জন্য আমাদেরও দরকার৷ তাই মুখ্যমন্ত্রী তোর্সা বা অন্যান্য নদী নিয়ে যে বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছেন, তা ভেবে দেখা দরকার৷ দু'দেশের আলোচনার মাধ্যমে নিশ্চয়ই পথ বেরিয়ে আসবে৷''

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য
স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ