ডয়চে ভেলে বাংলার সাপ্তাহিক ইউটিউব টকশো ‘খালেদ মুহিউদ্দীন জানতে চায়'-এর এবারের পর্বে অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দল তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদ অর্পিতা ঘোষ এবং ঢাকা থেকে ছিলেন বিএনপির সাংসদ রুমিন ফারহানা৷ এবারের প্রশ্ন ছিল, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক কি ক্রমশ খারাপ হচ্ছে? আলোচনার কেন্দ্রে থাকে তিস্তার পানিবণ্টন ও সীমান্ত হত্যার প্রসঙ্গ৷
এ বিষয়ে অনুষ্ঠানে প্রথম প্রশ্ন করা হয় তৃণমুল কংগ্রেসের সাংসদ ও নাট্যকর্মী অর্পিতা ঘোষকে৷ তিনি বলেন, ‘‘আমাদের মুখ্যমন্ত্রী কিন্তু সব সময়ই বাংলাদেশের সাথে ভালো সম্পর্ক রেখে এসেছেন৷ কিন্তু তবুও ইস্যু থাকেই, যেমন তিস্তার বিষয়টি৷ আমি যে অঞ্চলের সাংসদ, সেই দক্ষিণ দিনাজপুর, একেবারে বাংলাদেশের গায়ে৷ তিস্তার জল আমাদের জন্যেও সমস্যা, কারণ, তার ওপর নির্ভর করে আমাদের গোটা উত্তরবঙ্গের কৃষি৷ আমাদের অঞ্চলের কৃষকদের দিকে তাকিয়েও সিদ্ধান্ত নিতে হয়৷’’
কিন্তু এই পানি না দেওয়া ও এতে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে অর্পিতা ঘোষ বলেন, ‘‘ভারতবর্ষের কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে আমাদের দলের দৃষ্টিভঙ্গির অনেক তফাত৷ সব সিদ্ধান্ত দুই অংশ মিলে হয় না৷ রাজ্যের সাথে আলোচনা করে না কেন্দ্র৷ কিন্তু রাজ্য যখন বলে যে আমরা তিস্তার জল দেবো না, তখন তার অল্টারনেটিভও কিন্তু রাজ্য দেয়৷ কেন্দ্র তা দেখে না, তা নিয়ে কথা বলে না৷ গোটা বিশ্বের সব ডিপ্লোমেসিই কারো না কারো স্বার্থের ওপরে দাঁড়িয়ে থাকে৷ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও তাই নিজের স্বার্থের জন্যই জল দিতে রাজি হচ্ছেন না৷’’
সাম্প্রতিক ভারত-বাংলাদেশ বৈঠকে কেন এসব আলোচিত হলো না, সে প্রসঙ্গে বিএনপির রুমিন ফারহানা বলেন, ‘‘মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পর বারবার বৈঠক হয়েছে দুই দেশের প্রধানের মধ্যে৷ তিস্তার পানি নিয়ে, সীমান্ত হত্যা নিয়ে শুধু আশ্বাসই রয়েছে৷ দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য-বৈষম্যের মতো ইস্যু নিয়েও কথা হয়নি৷ মানুষের ইস্যু নিয়ে এই দুই রাষ্ট্রের প্রধানদের মধ্যে কথা হয় না৷ এটাকে দুই রাষ্ট্রের সুসম্পর্ক বলে না৷ ভারতের কাছ থেকে ২০১১ সাল থেকে দীর্ঘ নয় বছর ধরে আমরা শুধু আশ্বাসই পেয়েছি৷ দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্ব হয় আসলে যার যার স্বার্থমতে৷ এখানে দুই দেশের প্রধানের প্রায়োরিটি কী, তা বুঝতে হবে৷’’
এই পর্বে এছাড়াও আলোচিত হয় ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে হত্যার প্রসঙ্গ৷ রুমিন ফারহানা তোলেন ক্ষমতাসীন দলের ভূমিকার কথা, অর্পিতা ঘোষ সীমান্তে রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় এক্তিয়ারের কথা উল্লেখ করেন৷
এসএস/এসিবি
ভারত বাংলাদেশ যত চুক্তি
সাম্প্রতিক সময়ে ভারত-বাংলাদেশ কূটনৈতিক সম্পর্ক পেয়েছে অন্য এক মাত্রা৷ দুই দেশের সরকারের মধ্যে বেড়েছে পারস্পরিক যোগাযোগ, হয়েছে নানা চুক্তি, আর একে অপরকে দিয়েছে ‘সবচেয়ে পছন্দের দেশের’ মর্যাদা৷
ছবি: AFP/P. Singh
১০০ কোটি ডলার ঋণ ও ১৪ প্রকল্প
২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার একবছর পর ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথম ভারত সফরে যান৷ সেসময় ১০০ কোটি ডলারের এলওসি বা ঋণরেখা অনুমোদন করে ভারত৷ এই অর্থে জনপরিবহন, সড়ক, রেলপথ সেতু আর অভ্যন্তরীন নৌপথের ১৪ টি প্রকল্প বাস্তবায়নের চুক্তি হয়৷
ছবি: Getty Images/G. Crouch
বন্দী বিনিময়
২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে দুই দেশের মধ্যে বন্দী বিনিময় চুক্তি হয়৷ ২০১১ সালের ১৩ই জানুয়ারি তা কার্যকর হয়৷ চুক্তি অনুযায়ী কোনো দেশের নাগরিক অন্য দেশে সাজাপ্রাপ্ত হলে তাকে অনুরোধক্রমে ফেরত পাঠাতে পারবে৷ তবে এর আগেই অনুপ চেটিয়াসহ ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদি নেতাদের গ্রেপ্তার করে দেশটিতে পাঠানো হয় বলে গণমাধ্যমে খবর বেরোয়৷
ছবি: Getty Images/AFP/J. Barreto
ছিটমহল বিনিময়
২০১৫ সালের জুন মাসে ভারত-বাংলাদেশের স্থল সীমান্ত চুক্তি অনুমোদন হয়৷ যার মাধ্যমে ২০১৫ সালের জুলাইতে দুই দেশের মধ্যে অমীমাংসিত ছিটমহল বিনিময় হয়৷ ভারতের ১১১টি ছিটমহল যুক্ত হয় বাংলাদেশের সাথে৷ একইভাবে ভারতের অভ্যন্তরে থাকা বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলও হয়ে যায় ভারতের অংশ৷
ছবি: AFP/Getty Images
নদীর পানি বন্টন
বাংলাদেশের ভারতের অভিন্ন নদীর সংখ্যা ৫৪ টি৷ এর মধ্যে শুধু গঙ্গা নিয়ে দুই দেশের মধ্যে চুক্তি আছে৷ যদিও পানি বন্টনের ক্ষেত্রে এই চুক্তি ভারত মানছে না বলে অভিযোগ আছে৷ অন্যদিকে পাঁচ দশক ধরে তিস্তা চুক্তির চেষ্টা চললেও তা সম্ভব হচ্ছে না দেশটির উদাসীনতার কারণে৷ যার ফলে এখন একতরফাভাবে নদীটির পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে ভারত৷
ছবি: DW/A. Chatterjee
ভারসাম্যহীন বাণিজ্য
১৯৭২ সালে প্রথম বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর হয়৷ ২০১৫ সালে স্বাক্ষর হয় এ বিষয়ে নতুন চুক্তি৷ এর আওতায় দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত হাটসহ আরো কিছু বাণিজ্য সম্পর্কিত চুক্তি হয়েছে৷ ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যের আকার ছিল ৯১৪ কোটি ডলার৷ যার সিংগভাগই ভারতের অনুকূলে৷
ছবি: Getty Images/AFP/D. Dutta
উন্নয়ন সহযোগিতার কাঠামো
২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরকালে একটি উন্নয়ন সহযোগিতাবিষয়ক কাঠামোগত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়৷ যার মধ্যে আছে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য, বিনিয়োগ, পানি সম্পদ; বিদ্যুৎ; শিক্ষা, সাংস্কৃতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি ইত্যাদি৷
ছবি: Getty Images/AFP/M.U. Zaman
দ্বিপক্ষীয় বিনিয়োগ বৃদ্ধি
এই চুক্তি সম্পর্কে ভারতীয় দূতাবাসের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, ‘‘দ্বিপক্ষীয় বিনিয়োগ প্রবাহ বৃদ্ধির লক্ষ্যে এক দেশ অন্য দেশের ভূখণ্ড থেকে বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও রক্ষার লক্ষ্যে এ চুক্তি হয়েছে৷ ভারত ও বাংলাদেশ একে অপরকে ‘সবচেয়ে পছন্দের দেশ’-এর মর্যাদা দিয়েছে৷’’
ছবি: picture-alliance/AP Photo/M. Swarup
বাংলাদেশ ভারতের পণ্য পরিবহন
দুই দেশের মধ্যে হওয়া বাণিজ্য চুক্তি অনুযায়ী এক দেশ আরেক দেশের জল, স্থল ও রেলপথ ব্যবহার করে তৃতীয় দেশে পণ্য ট্রানজিটের সুবিধা নিতে পারে৷ ২০১৬ সালে মাশুলের বিনিময়ে ভারতকে আশুগঞ্জ নৌ বন্দর দিয়ে বহুমাত্রিক ট্রানজিট সুবিধা দেয় বাংলাদেশ৷ সড়কপথে ট্রানজিট দিতে ২০১৫ সালে আখাউড়া অগরতলা সীমান্ত দিয়ে পরীক্ষামূলক চালান পাঠানো হয়৷ যা পরবর্তীতে নিয়মিত হয়নি৷
ছবি: DW/M. Mamun
ভারতের রেল যাবে বাংলাদেশ হয়ে
আগামী বছরের মাঝামাঝি সময়ে কোলকাতা থেকে ছেড়ে আসা ট্রেন বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে শিলিগুড়ি যাবে৷ ২০১১ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সময় এ বিষয়ক একটি চুক্তি হয়৷ চুক্তি অনুযায়ী এজন্য দুই দেশকে তাদের অংশের রেলপথ নির্মাণ করতে হবে৷ বাংলাদেশ অংশের সাত কিলোমিটার রেলপথ আগামী বছরে জুন মাসের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা৷
ছবি: DW/P. Mani
সাবরুমের মানুষে জন্য ফেনীর পানি
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে সাতটি সমঝোতা সই ও চুক্তি হয়েছে৷ একটি সমঝোতার আওতায় ফেনী নদীর ১ দশমিক ৮২ কিউসেক পানি প্রত্যাহার করতে পারবে ভারত৷ ওই পানি তারা ত্রিপুরার সাবরুম শহরে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ প্রকল্পে ব্যবহার করবে৷
ছবি: AFP/P. Singh
বন্দর ব্যবহার করে পণ্য পরিবহন
বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্র বন্দর ব্যবহার করে ভারত আটটি রুটে তার উত্তর পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোদে পণ্য আনা নেয়া করতে পারবে৷ এজন্য স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিওর বা পদ্ধতি কী হবে, তা নির্ধারণে একটি সমঝোতা স্বাক্ষর হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক সফরে৷
ছবি: DW/U. Danisman
চুক্তি থাকলেও হত্যা থেমে নেই
সীমান্তে হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনতে ২০১১ সালে বিজিবি-বিএসএফ একটি চুক্তি করে৷ নেয়া হয় সীমান্ত পারাপারে অস্ত্র ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত৷ তবে সীমান্তে দেশটির আচরণে তার প্রতিফলন নেই৷ গত ১০ বছরে ২৯৪ বাংলাদেশি নাগরিককে হত্যা করেছে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিএসএফ৷