তিস্তার পানি না পওয়ায় চেয়ে এখন বাংলাদেশে আলোচনা-সমালোচনার তুঙ্গে আছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি৷ ‘তিস্তায় তো পানি নাই' – এ কথা বলার পর হাসিনাকে তোরসা আর দুধকুমারের পানি নিয়ে বিকল্প প্রস্তাব দেন তিনি৷
বিজ্ঞাপন
তিস্তার পানি না পওয়ায় চেয়ে এখন বাংলাদেশে আলোচনা-সমালোচনার তুঙ্গে আছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি৷ ‘তিস্তায় তো পানি নাই' – এ কথা বলার পর হাসিনাকে তোরসা আর দুধকুমারের পানি নিয়ে বিকল্প প্রস্তাব দেন তিনি৷
তিস্তা নদীর উৎপত্তি সিকিমে৷ আর এ নদী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে লালমনিরহাট জেলার সীমান্ত দিয়ে৷ মাঝখানে পশ্চিমবঙ্গ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে তিস্তা৷ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের মূল লক্ষ্য ছিল তিস্তার পানিবণ্টণ চুক্তি৷ ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সদিচ্ছাও ছিল৷ কিন্তু বেঁকে বসেন মমতা ব্যানার্জি৷ প্রসঙ্গত, ভারতের সংবিধান অনুযায়ী রাজ্য সরকারের অনুমমোদন ছাড়া কেন্দ্র এ ধরনের রাজ্য সংক্রান্ত চুক্তি করতে পারে না৷ এর আগে ২০১১ সালেও সব কিছু চূড়ান্ত হওয়ার পরও মমতার কারণেই চুক্তিটি আলোর মুখ দেখেনি৷ ঐ সময় মমতা তাঁর ওপর বিশ্বাস রাখতে বললেও, এবার কিন্তু আর বিশ্বাসের কথা বলেননি৷ ৭ এপ্রিল শেখ হাসিনার ভারত সফরের শুরুর মাত্র ৪৮ ঘণ্টা আগে তিনি বলেই দেন ‘‘তিস্তায় তো পানি নাই''৷
ইমামুল হক
মমতার এই কথাকে মিথ্যাচার বলে অভিহিত করেছেন বাংলাদেশের পানি ও নদী বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী ইমামুল হক৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘গজলডোবা এলাকায় বাধ ও ড্যাম দিয়ে তিস্তার পনি প্রত্যাহার করা হয়েছে৷ তাছাড়া তিস্তার পানি দিয়েই সেখানে কৃষিকাজ হচ্ছে, বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে৷ আর সেখান থেকে পানি নেওয়া হচ্ছে গঙ্গায়৷ মমতা আসলে তথ্য গোপন করে তিস্তার পানি লুকিয়ে রেখেছেন৷''
রিভারাইন পিপল-এর মহাসচিব শেখ রোকন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সিকিমে ড্যামের কারণে কিছু পানি বাস্পিভূত হয়ে হয়ত কমতে পারে, কিন্তু তিস্তায় পানি নেই – এটা মিথ্যাচার ছাড়া আর কিছুই নয়৷ এই যুগে কিছু গোপন করা যায় না৷ কারণ গুগল বা স্যাটেলাইট ইমেজে সব কিছু স্পষ্ট দেখা যায়৷ তিস্তার পানি দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে যে সেচ প্রকল্পসহ আরো অনেক প্রকল্প চলছে – সেটাও স্পষ্ট দেখা যায়৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘তিস্তার পানি কমে গেলেও অভিন্ন নদী হিসেবে এর যতটুকু হিস্যা তা তো বাংলাদেশ পাবে৷ তিস্তার পানি দেবো না, এটা বলার অধিকার মমতার নেই৷''
অন্যদিকে ভারত সফরের দ্বিতীয় দিন ৮ এপ্রিল শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করেন মমতা ব্যানার্জি৷ বেঠকের পর তিনি সাংবাদিকদের জানান, তিস্তার পানি নয়, তোরসা ও জলঢাকার পানি নিয়ে ভাবা হতে পারে৷ ঐ দু'টি নদীর পানি আন্তঃনদী সংযোগের মাধ্যমে দেওয়ার বিকল্প প্রস্তাব দেন মমতা৷
শেখ রোকন
বাংলাদেশে তোরসা, দুধকুমার এবং জলঢাকা ধরলা নামে পরিচিত৷ এই দু'টি নদী বাংলাদেশে কুঁড়িগ্রাম সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করে যমুনায় পড়েছে৷
প্রকৌশলী ইমামুল হক হক বলেন, ‘‘এক অববাহিকার পানি আরেক অববাহিকায় নেওয়া বাস্তব সম্মত নয়৷ এমনিতেই তিস্তার কারণে পরিবশে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে৷ এখন ওটা করা হলে পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে৷ তাছাড়া মমতা যে প্রস্তাব দিয়েছেন, তা ভারতই অনুমোদন করবে না৷ কারণ এটা তাদের পরিবেশেরও ক্ষতি করবে৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘ঐ দু'টি নদী তো আলাদা নদী৷ তারা কোনোমতেই তিস্তার বিকল্প নয়৷''
শেখ রোকন আরো বলেন, ‘‘তোরসা এবং জলঢাকা বাম প্রবাহী নদী৷ অন্যদিকে তিস্তা ডানদিক দিয়ে প্রবাহিত হয়৷ তাই এই দুই নদীর পানি তিস্তায় নেওয়া কারিগরিভাবে অসম্ভব বলেই আমার মনে হয়৷''
তাঁর কথায়, ‘‘তারপরও দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর আলোচনায় যে সাতটি নদীর কথা আছে, তার মধ্যে তোরসা আর জলঢাকা রয়েছে৷ তাই ওই দুই নদী আলাদা৷ তিস্তার পানির হিসাবের সাথে তা মেলানো যাবে না৷''
এদিকে এ সব নিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথায়ও হতাশা ফুটে উঠেছে৷ তিনি ভারত সফরের শেষ দিনে সোমবার ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হওয়ার আগে ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশনের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে দেওয়া বৃক্ততায় অনেকটা তির্যকভাবেই বলেন, ‘‘চাইলাম পানি, পেলাম বিদ্যুৎ৷ তবে ভালোই হয়েছে, কিছু তো পেয়েছি৷''
তিস্তা চুক্তি নিয়ে ভারতীয়রা যা ভাবছেন
শেখ হাসিনা ভারতে এলেও তিস্তা চুক্তি আপাতত হচ্ছে না৷ তারপরেও তিস্তার দিকে চাতক পাখির মতো তাকিয়ে আছে বাংলাদেশ৷ আশা-আকাঙ্খায় দিন গুনছে বহু মানুষ৷ চলুন জেনে নেওয়া যাক ভারতের কয়েকজন সাধারণ মানুষ এ সম্পর্কে কী ভাবছেন৷
ছবি: DW/A. Chatterjee
সুস্মিতা সর্বাধিকারী, কবি ও সমাজসেবী
তিস্তা নদী ভারতের যে যে রাজ্যের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে, বাংলাদেশের সঙ্গে জলবণ্টন চুক্তিতে সেই রাজ্যগুলির স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রেখে আন্তর্জাতিক স্তরে চুক্তিবদ্ধ হওয়া আবশ্যক৷ তা না হলে অন্যান্য জলচুক্তির ক্ষেত্রে ভারত যে শিক্ষা পেয়েছে, এক্ষেত্রেও তা-ই হবে৷ মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির অবস্থান সাধুবাদের যোগ্য৷
ছবি: DW/R. Chakraborty
মলয় হালদার, পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন প্রশাসনিক কর্তা
নদীর গতিপথ যখন প্রাকৃতিকভাবে নিয়ন্ত্রিত হতো, তখন কোনো দেশের একক সিদ্ধান্ত কার্যকর করা সহজ হতো না৷ এখন ভাটির দেশকে নির্ভর করতে হয় উজান দেশের মনোভাবের ওপর৷ তিস্তার জল যেমন ভারতের, তেমনি বাংলাদেশেরও৷ শুধু উত্তরবঙ্গের কথা বলে আন্তর্জাতিক বন্ধুত্বকে বলি দেওয়া সমীচীন নয়৷
ছবি: DW/R. Chakraborty
পাপন মালাকার, বেসরকারি সংস্থার কর্মী
বাংলাদেশের সঙ্গে কোথায় যেন আত্মার টান অনুভব করি৷ আমরা জল অপচয় করব আর প্রতিবেশী দেশের ভাই-বোনেরা জলের অভাবে কষ্ট পাবে এটা মন থেকে মেনে নিতে পারি না৷ তবে, মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি যে যুক্তি দেখিয়েছেন তা নিয়েও আলোচনা প্রয়োজন৷
ছবি: DW/R. Chakraborty
কমলিকা ভট্টাচার্য, চাকুরিজীবী
তিস্তা একটি আন্তর্জাতিক নদী৷ এই ধরনের নদীতে কোনো একটি দেশ বা রাজ্যের একছত্র অধিকার থাকে না৷ সিকিম থেকে গজলডোবা পর্যন্ত তিস্তার ওপর বেশ কয়েকটি বাঁধ নির্মাণের কারণে বাংলাদেশের রংপুর-রাজশাহী অঞ্চল মরুর চেহারা নিচ্ছে৷ সেক্ষেত্রে নদী বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে প্রতি বছর এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত শুখা মরশুমে দুই দেশের মধ্যে সমবন্টনের নীতি গ্রহন করা উটিত৷
ছবি: DW/R. Chakraborty
অসীম দাস, সমাজসেবী
নদীর জল আটকে রাখার চেষ্টা, নিজের অধিকারের এক্তিয়ার বলে মনে করা নেহাৎ মুর্খামি৷ ভারত বা বাংলাদেশ উভয়েই কৃষিপ্রধান দেশ৷ কৃষিকাজ না হলে দুর্ভিক্ষ নেমে আসবে৷ বাংলাদেশকে তিস্তার জল না দিয়ে ভারত যদি শুধুমাত্র নিজের স্বার্থ দেখে, তাহলে ভবিষ্যতে নেপাল যদি ভারতকে ব্রহ্মপুত্র নদীর জল দিতে অস্বীকার করে, কী হবে তখন?
ছবি: DW/R. Chakraborty
বনশ্রী কোনার, হোম মেকার
দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যখন বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইছেন, তখন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি ‘ইগো’ নিয়ে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন৷ এমনটা কখনওই কাম্য নয়৷ দেশ তথা সার্বিক স্বার্থকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া উচিত৷
ছবি: DW/R. Chakraborty
অভিজিৎ চ্যাটার্জি, প্রকাশনী সংস্থার কর্মী
তিস্তা জলবণ্টন চুক্তি হোক বা না হোক, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকে নিজের রাজ্যে রাজনীতি করতেই হবে৷ তাই তাঁকে রাজ্যবাসীর স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রেখে কাজ করতে হয়৷ নদীর জলে কোনোরকম নিয়ন্ত্রণ না রেখে উত্তরবঙ্গকে বঞ্চিত করে বাংলাদেশকে জল দেওয়ার মধ্যে কোনও মহত্ব নেই৷ বরং সবার আগে রাজ্যবাসীর দিকে তাকানো উচিত৷
ছবি: DW/R. Chakraborty
মানবেন্দু সরকার, কলেজ শিক্ষক
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে আসছেন৷ তিস্তা জলবণ্টন চুক্তি নিয়ে চূড়ান্ত আলোচনা করে প্রাথমিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর এটাই উপযুক্ত সময়৷ হাসিনা চাইছেন, নরেন্দ্র মোদী চাইছেন৷ সিকিমের মুখ্যমন্ত্রীও চাইছেন৷ বেঁকে বসেছেন মমতা ব্যানার্জি৷ এটা সৌহার্দ্যের ছবি নয়৷ ভুল বার্তা যাচ্ছে৷
ছবি: DW/R. Chakraborty
রাখী বিশ্বাস, কলেজ ছাত্রী
দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে তিস্তাচুক্তি নিয়ে আলোচনা চললেও তা ফলপ্রসূ হয়নি৷ ফলে তিস্তার জলের দিকে তাকিয়ে আছে বাংলাদেশ৷ মমতা ব্যানার্জিকেই ঠিক করতে হবে, উনি রাজনীতি করবেন, নাকি দেশের স্বার্থে প্রধানমন্ত্রীর পাশে দাঁড়াবেন৷