বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবারের ভারত সফরে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি না হলে তা তাঁর জন্য হবে অনেক বিব্রতকর৷ আর তিস্তার পানির জন্য যদি সামরিক চুক্তি করতে হয়, তাহলে তার প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশে নেতিবাচব হবে৷
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশের রাজনৈতিক এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশ তিস্তা চুক্তির আশা করে, কিন্তু এমনও হতে পারে তিস্তা বা সামরিক চুক্তি কোনটাই হবে না৷
আগামী ৭ এপ্রিল ভারত সফরে যাচ্ছেন বাংলাদেশের প্রধারমন্ত্রী শেখ হাসিনা৷ নরেন্দ্রমোদী ক্ষমতা গ্রহণের পর এটা হবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর প্রথম ভারত সফর৷ এর আগে ২০১৫ সালে মোদী ঢাকা সফর করেন৷ শেখ হাসিনাকে সর্বোচ্চ সম্মান দেখিয়ে ভারত সফরের সময় দিল্লির রাষ্ট্রপতি ভবনে থাকার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে৷ আর গত সপ্তাহে ঢাকায় ভারতীয় রাষ্ট্রদূত বলেছেন, শেখ হাসিনার ভারত সফর ফলপ্রসূ হবে৷
Imtiaz.mp3 - MP3-Stereo
তবে শেখ হাসিনার ভারত সফর ফলপ্রসূ হবে কি হবে না তা অনেকটা নির্ভর করছে তিস্তা পানি চুক্তির ওপর৷ বাংলাদেশ এটাকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে৷ ২০১১ সালেই ভারতের তখনকার প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এর বাংলদেশ সফরের সময় তিস্তা পানি চুক্তির প্রবল আশা জেগেছিল৷ কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিরোধিতায় সে আসা নিরাশায় পরিণত হয়৷ আর মোদীর ঢাকা সফরেও কোন ফল আসেনি৷ কিন্তু এবার ঢাকা যেন অনেকটা মরিয়া হয়ে উঠেছে৷
বাংলাদেশের পানিসম্পদমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ শেখ হাসিনার দিল্লি সফরের আগে তাই গত সপ্তাহে ভারত সফরে তিস্তার পানির জন্য ঢাকা কতটা উদগ্রীব তা জানিয়েছেন৷ সেখানে ১৬ মার্চ তিনি বলেছেন, ‘‘বাংলাদেশের কৃষি এবং পানির জন্য চিস্তা চুক্তি অপরিহার্য৷ এটা আমাদের সত্যিই প্রয়োজন৷ ভারতের দুই প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এবং নরেন্দ্র মোদী তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন৷ আমরা মনে করি ভারত এখন এটার ওপর কাজ করছে৷''
প্রসঙ্গত, সিকিম থেকে উৎপত্তি হয়ে তিস্তা নদী ভারতের পশ্চিমবঙ্গ হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে৷ ডিসেম্বর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত বাংলাদেশে এর পানি প্রবাহ এক হাজার কিউসেকেরও নিচে নেমে যায়৷ ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে নরেন্দ্র মেদীর সঙ্গে মমতাও ঢাকা সফর করেন৷ তখন তিনি তিস্তার পানির ব্যাপারে বাংলাদেশের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের চুক্তি করায় ইতিবাচক ভূমিকার আশ্বাস দিয়েছিলেন৷ কিন্তু সেই আশ্বাসের কোন ফল এখনো দেখা যায়নি৷
শতবর্ষ পুরানো ‘কুড়িয়ানা নৌকার হাট’
ধান, নদী, খাল – এই তিনে বরিশাল৷ জালের মতো ছড়ানো ছিটানো নদী আর খালের প্রাধান্য থাকায় এ অঞ্চলে আজও চলাচলের প্রধান যান নৌকা৷ আর বর্ষার সময় নদী-খালের পানি বেড়ে যাওয়ায় নৌকার ব্যবহারও যায় বেড়ে৷ বসে নৌকার হাটও৷
ছবি: DW/M. Mamun
ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক
পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠি উপজেলার কুড়িয়ানা হাটে নৌকা নিয়ে যাচ্ছেন কারিগররা৷ স্বরূপকাঠির সন্ধ্যা নদীর শাখা খাল ‘কুড়িয়ানা’-তে সপ্তাহের প্রতি শুক্রবার বসে এ নৌকার হাট৷ প্রায় আধা কিলোমিটার এলাকাজুড়ে জলে ও ডাঙ্গায় বসা এ হাট এই অঞ্চলের ঐতিহ্যেরও ধারক৷
ছবি: DW/M. Mamun
নৌকা তৈরি করা যাঁদের পেশা
স্বরূপকাঠি উপজেলার এগারোটি গ্রামের প্রায় দেড় হাজারেরও বেশি পরিবারের প্রধান পেশা নৌকা তৈরি করা৷ উপজেলার আটঘর, কুড়িয়ানা, আদমকাঠি, জিন্দাকাঠি, ইন্দুরকানি, দলাহার, আতাপাড়া, শেখেরহাট, চামির, গাগর, গগন প্রভৃতি গ্রামের নৌকার কারিগররা সারা সপ্তাহজুড়ে ব্যস্ত থাকেন নৌকা তৈরিতে৷ আর তারপর শুক্রবার সেই সব নৌকা নিয়ে বিক্রি করেন কুড়িয়ানা নৌকার হাটে৷
ছবি: DW/M. Mamun
বর্ষায় রবিবারেও বসে হাট
শুক্রবার খুব সকাল থেকেই কারিগররা কুড়িয়ানার হাটে আসতে শুরু করেন৷ ক্রেতা সমাগম বিকেলে হলেও, ক্রেতা আকৃষ্ট করতে ভালো জায়গা দখলের প্রতিযোগিতা থাকে এখানে৷ কুড়িয়ানার হাট সাধারণত সপ্তাহে মাত্র একদিন, অর্থাৎ শুক্রবার বসলেও বর্ষা মৌসুমে চাহিদা বেশি থাকায় রবিবারেও সীমিত আকারে হাট বসান বিক্রেতারা৷
ছবি: DW/M. Mamun
দুর্লভ হয়ে উঠেছে সুন্দরী
আটঘর বাজারে সাধারণত বিক্রি হয় কোষা ও ডিঙ্গি নৌকা৷ এ বাজারের নৌকার কারিগর আশুতোষ জানালেন যে, তাঁর বাপ-দাদারা নৌকা তৈরি করতেন সুন্দরী কাঠ দিয়ে৷ সে সময়ে সুন্দরী কাঠের সবচেয়ে বড় মোকাম ছিল স্বরূপকাঠি৷ তবে দিনে দিনে সুন্দরী কাঠ দুর্লভ হয়ে ওঠায়, তাঁরা এখন নৌকা তৈরি করছেন মেহগনি, চাম্বল, রেইনট্রি, গাব, গুলাব, আমড়া, বাদাম প্রভৃতি কাঠ দিয়ে৷
ছবি: DW/M. Mamun
দু’জন মিলে করি কাজ...
ইন্দুরকানি গ্রাম থেকে আসা নৌকা বিক্রেতা আমজাদ মোল্লা জানান যে, দু’জন মিস্ত্রী দিনে একটি ছোট নৌকা তৈরি করতে পারেন৷ আকার আর কাঠের রকম ভেদে একেকটি নৌকা বিক্রি হয় দেড় হাজার থেকে চার হাজার টাকায়৷ তবে নৌকায় গাব, আলকাতরা কিংবা অন্য কোনো কারুকাজ থাকলে দামের তারতম্য তো হয়-ই৷
ছবি: DW/M. Mamun
নামাজের পর জমে ওঠে বাজার
দিনের প্রথমভাগে নৌকা বিক্রেতারা হাটে এসে অলস সময় কাটান৷ এই ফাঁকে কেউ কেউ আবার একটিখানি জিরিয়ে বা ঘুমিয়েও নেন৷ তবে শুক্রবারের জুম্মার নামাজের পর বাজার জমে উঠলে বিক্রেতাদের ব্যস্ত সময় কাটাতে হয়৷
ছবি: DW/M. Mamun
মুঠোফোনেও হয় লেনদেন
কুড়িয়ানা নৌকার হাটে ক্রেতার অপেক্ষা করছেন বিক্রেতারা৷ তবে সব সময় এ সব বিক্রেতাকে ক্রেতার অপেক্ষায় থাকতে হয় না৷ মোবাইল নেটওয়ার্কের সম্প্রসারণ ও মুঠোফোন সহজলভ্য হওয়ায় অনেক ক্রেতাই আজকাল কারিগরদের কাছে আগাম চাহিদার কথা জানান৷ পরে হাটের দিনে এসে যাচাই বাচাই করে সে নৌকা বুঝে নেন৷
ছবি: DW/M. Mamun
এক নৌকায় দুই মৌসুম
কুড়িয়ানা হাটে ক্রেতারা নৌকা কেনার আগে ভালো করে যাচাই বাচাই করে নেন৷ স্বল্প আয়ের এ সব মানুষদের প্রতিটি নৌকা দিয়ে কমপক্ষে দুটি মৌসুম পার করতে হয়৷ প্রত্যেক ক্রেতাই তাই তাঁদের টাকার সর্বোচ্চ মূল্য পেতে সচেষ্ট থাকেন৷ তারপর নৈকা কিনে আনন্দে ঘরে ফেরেন তাঁরা৷
ছবি: DW/M. Mamun
বৈঠাও বিক্রি হয় বাজারে
নৌকা চালানোর জন্য দরকার বৈঠা৷ কুড়িয়ানা বাজারে কোনো কোনো বিক্রেতা তাই শুধু নৌকার বৈঠা বিক্রি করেন৷ আর ক্রেতারা নৌকা কেনার পর আকার অনুযায়ী বৈঠা কিনে নেন বাজার থেকে৷ কুড়িয়ানা নৌকার হাটে সাধারণত একেকটি বৈঠার দাম ৮০-২০০ টাকা৷ বলা বাহুল্য, কাঠের ধরণ ও আকার অনুযায়ী বৈঠার দামের তারতম্য হয়৷
ছবি: DW/M. Mamun
নানা কাজে ব্যবহৃত হয় নৌকা
কুড়িয়ানা বাজারে বিক্রি হওয়া নৌকাগুলো এ অঞ্চলের মানুষের দৈনন্দিন কাজে বহুল ব্যবহৃত হয়৷ সাধরণত মাছ ধরা, কোথাও বেড়াতে যাওয়া, বাজারে পণ্য সরবাহ, পেয়ারা ধরা, হাট-বাজারে যাওয়াসহ নানান কাজে এ সব নৌকার ব্যবহার হয়৷
ছবি: DW/M. Mamun
ভাসমান হাট বেশি দূরে নয়
স্বরূপকাঠির পার্শ্ববতী ঝালকাঠি জেলার ভিমরুলি গ্রামের কৃত্তিপাশা খালে বসে এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় ভাসমান হাট৷ বর্ষা ও শরতে এ হাটে শত শত নৌকা বোঝাই পেয়ারা আর আমড়া বিক্রি হয়৷ আর এ সব নৌকার বেশিরভাগেরই যোগান আসে কুড়িয়ানার নৌকার হাট থেকে৷
ছবি: DW/M. Mamun
পাশেই রয়েছে আরেক হাট
কুড়িয়ানার পাশেই আরেকটি হাট ‘আটঘর’৷ ভাসমান এ হাটেও ছোট ছোট নৌকায় কৃষিপণ্য নিয়ে জড়ো হন বিক্রেতারা৷ এ বাজারেও কুড়িয়ানা হাটের নৌকারই প্রাধান্য৷
ছবি: DW/M. Mamun
12 ছবি1 | 12
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. শান্তনূ মজুমদার ডয়চে ভেলেকে বলের, ‘‘মমতার সঙ্গে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সম্পর্কের এখন আরো অবিনতি ঘটেছে৷ তাই মমতা তিস্তার ব্যাপারে কোনো ছাড় দেবেন বলে আমার মনে হয়না৷ এটা সত্য যে এবার তিস্তা চুক্তি হওয়া না হওয়ার উপরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সিভির ওজন অনেকটা নির্ভর করছে৷ কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন৷''
অন্যদিকে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহেমেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এবার যদি তিস্তা চুক্তি না হয় তার রাজনৈতিক ব্যাখ্যা ভিন্ন রকম হতে পারে৷ দেড় দু'বছর পর বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন৷ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য তাই এই চুক্তি খুবই গুরুত্বপূর্ণ৷ আমরা সবসময়ই এ ধরনের সফরের সময় তিস্তা চুক্তি আশা করি৷ কিন্তু সেজন্য শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে৷''
তিনি বলেন, ‘‘সামরিক চুক্তির বিনিময়ে তিস্তা চুক্তি -এটা গ্রহণযোগ্য নয়৷ আর বাংলাদেশ তা করবে বলে মনে হয় না৷ করলে বাংলাদেশে তার নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া হবে৷ এতটা ছাড় বাংলাদেশ দেবেনা৷ সমেঝাতা স্মারক হতে পারে৷''
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ তিস্তা পানি চুক্তির জন্য মুখিয়ে থাকলেও ভারত চায় সামরিক বা প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তি৷