যা শুধু সর্বোচ্চ শ্রেণির স্তন্যপায়ী জীব ও পাখিরা পারে বলে ভাবা হতো৷ দেখা যাচ্ছে, মাছেরাও তা করতে সক্ষম, যদিও তাদের মস্তিষ্কের সংশ্লিষ্ট অংশটিই নেই৷
বিজ্ঞাপন
‘সায়েন্টিফিক রিপোর্টস' জার্নালে প্রকাশিত বিবরণ অনুযায়ী, বিজ্ঞানীরা আটটি আর্চার ফিশ বা তীরন্দাজ মাছ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন৷ তীরন্দাজ মাছেরা মুখটাকে পিচকিরির মতো করে জলের ফোয়ারা ছুঁড়ে দিতে পারে; যার ফলে জলের ওপর ঘাসপাতায় বসা পোকামাকড় ঘায়েল হয়ে জলে পড়ে ও মাছের শিকার হয়ে যায়৷
বিজ্ঞানীরা মাছি বা পোকামাকড়ের বদলে অ্যাকোয়ারিয়ামের ওপর ঝোলানো মনিটরে মানুষের মুখ দেখিয়েছেন: প্রথমে মাত্র দু'জন মানুষ, তাদের একজনকে চিনে, সেদিকে তাক করে জলের ‘তীর' ছুঁড়তে পারলেই মাছেরা পুরস্কার হিসেবে খাবার পায়৷ দেখা যায়, মাছেরা অতি তাড়াতাড়ি ব্যাপারটা রপ্ত করে ফেলে৷ এরপর তাদের ৪৪টি মুখ দেখিয়ে তার মধ্যে সেই পরিচিত মুখটি দেখানো হয়, যার দিকে ‘তীর' ছুঁড়তে পারলে তারা পুরস্কার পাবে৷ এবারেও মাছেরা শতকরা ৮০ ভাগ ক্ষেত্রে ঠিক মুখটি চিনে, জল ছুঁড়ে, তাদের পুরস্কার সংগ্রহ করে!
মাছের জগতের আশ্চর্য
পৃথিবীতে মাছের প্রজাতি প্রায় তিন হাজার৷ তাদের মধ্যে কিছু কিছু মাছ সত্যিই চমকে দেবার মতো, যেমন ইলেকট্রিক ইল বা বৈদ্যুতিক পাঁকাল মাছ৷
ছবি: imago/Olaf Wagner
ইলেকট্রিক ইল
ইলেকট্রিক ইল কিন্তু পাঁকাল মাছ নয়, বাংলায় সে পড়বে ছুরি মাছদের পর্যায়ে৷ ৬০০ ভোল্ট অবধি ইলেকট্রিক শক মারতে পারে! সেভাবেই শিকার ধরে - বা মারে - এই বৈদ্যুতিক পাঁকাল৷ গবেষণা করে দেখা গেছে যে, বাদুড়রা যেমন শব্দতরঙ্গ ব্যবহার করে পোকামাকড়ের অবস্থান জানতে পারে, তেমন ইলেকট্রিক ইল’ও কারেন্ট মারার সময় সেই পন্থায় শিকারের অবস্থিতিও জানতে পারে৷
ছবি: imago/Olaf Wagner
ডোরাকাটা তীরন্দাজ মাছ
এই মাছগুলো জলের নীচে থেকেই পুকুরের ধারের ঘাস-গুল্ম থেকে পোকামাকড় শিকার করতে পারে৷ কিভাবে? মুখ থেকে জলের পিচকিরি ছুঁড়ে পোকাগুলোকে পানিতে ফেলে দেয় এই তীরন্দাজ মাছ৷ বড় মাছগুলো তিন মিটার দূরত্বে বসা শিকারকে ঘায়েল করতে পারে!
এই মাছটি বালির মধ্যে শরীর ডুবিয়ে বসে থাকে শিকার ধরার আশায়৷ শিকার এলে লাফ দিয়ে উঠে শিকার ধরে৷ স্টারগেজার মাছের চোখ মাথার উপর বসানো, থ্যাবড়া মুখটাও ওপরদিকে বাঁকানো৷ মনে রাখতে হবে, মাছটি কিন্তু বিষাক্ত৷
ছবি: picture-alliance / OKAPIA KG
স্টোনফিশ বা পাথর মাছ
এ’মাছটিও বিষাক্ত এবং ক্যামোফ্লেজ, মানে ছদ্মবেশ ধারণে ওস্তাদ৷ দেখলে মনে হবে যেন শ্যাওলায় ঢাকা এক টুকরো পাথর৷ কিন্তু পায়ের নীচে পড়লেই বিষাক্ত কাঁটাগুলো ফুটে যাবে! বিশ্বের সবচেয়ে বিষাক্ত মাছগুলোর মধ্যে পড়ে এই পাথর মাছ৷ সে বিষে মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে৷
ছবি: gemeinfrei
পটকা মাছ
পটকা মাছেদের পেটটা রাবারের মতো বাড়ে বা কমে৷ পটকা মাছেরা পেটে পানি ঢুকিয়ে বলের মতো গোলাকৃতি হয়ে যেতে পারে৷ এদের শরীরেও টেট্রোডোটক্সিন নামের একটি মারাত্মক বিষ আছে৷ জাপানে এই মাছ সুখাদ্য বলে পরিগণিত৷ তবে অতি সাবধানে কাটতে হয়, বিষের অংশটা বাদ দিয়ে৷ কেননা সে’ বিষে মানুষ মরতে পারে৷
ছবি: picture alliance/Arco Images
অ্যাঙ্গলার ফিশ বা মাছ ধরা মাছ
এই মাছের মাথায় ইলিসিয়াম নামধারী একটি আঙুলের মতো দেখতে আঁচিল আছে৷ সেই আঁচিলের ওপর দিকটা বাতির মতো জ্বল জ্বল করে, যা’তে হবু শিকাররা আকৃষ্ট হয়৷ তারপরেই সেই শিকার অ্যাঙ্গলার মাছের সুবিশাল মুখগহ্বরে ঢুকে যায়৷ এই মাছের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল, বিশ্বের সর্বত্র এদের পাওয়া যায়, এমনকি গভীর সমুদ্রেও৷
ছবি: Flickr/Stephen Childs
ভাইপার ফিশ বা সর্প মাছ
আজগুবি মাছ দেখতে হলে যেতে হয় সাগরের অতলে৷ সেখানে জলের চাপ বেশি, আলো প্রায় নেই বললে চলে, খাবারও কম৷ এই পরিবেশে শিকার ফসকালে চলবে না৷ তাই ভাইপার ফিশদের দাঁত, মুখ, সবই ভয়ংকর, ভয়াবহ...
ছবি: picture-alliance/dpa
প্লেইস বা রূপচাঁদা মাছ
চাঁদা মাছরা চ্যাপটা৷ তাদের ক্যামোফ্লেজ বা নিজেকে লুকনোর ক্ষমতা অসাধারণ, বিশেষ করে কাদার মধ্যে৷ মজার কথা: বড় হওয়ার সময় তাদের একটা চোখ মাথার এপাশ থেকে ওপাশে চলে গিয়ে অন্য চোখটির সঙ্গে যুক্ত হয়!
ছবি: picture-alliance/dpa/H.Bäsemann
সিহর্স ঘোড়া নয়
যদিও এই ছোট্ট মাছগুলোকে ঘোড়ার মতো দেখতে এবং এদের প্রকৃতিও অত্যন্ত নিরীহ৷ দ্বিতীয়ত, ‘সাগরের ঘোড়া’ নামধারী এই মাছগুলি চিৎ হয়ে নয়, খাড়া হয়ে সাঁতার কাটে - ফলে এরা খুব ভালো সাঁতারু হয় না৷ তৃতীয়ত, পুরুষ সিহর্সরা নিষিক্ত ডিমগুলোকে পেটের ভাঁজে বয়ে নিয়ে বেড়ায় এবং পরে বাচ্চাদের জন্মও দেয়৷
ছবি: picture-alliance/ dpa
মাডস্কিপার বা লাফানো কাদা মাছ
মাডস্কিপাররা মাছ হলেও, তাদের জল বেশি পছন্দ, না ডাঙা বেশি পছন্দ, তা তারা কখনো ঠিক করে উঠতে পারেনি৷ নিঃসন্দেহে মাছ হলেও, তারা পাখনা ব্যবহার করে কাদার ওপর দিয়ে হাঁটতে পারে৷ এছাড়া তারা অন্যান্য উভয়চরের মতো ত্বক দিয়ে নিঃশ্বাস নিতে পারে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/MAXPPP
হাতুড়ি-মাথা হাঙর
বিজ্ঞানীদের মতে হ্যামারহেড শার্কের মাথাটা হাতুড়ির মতো দেখতে হওয়ার কারণ হল, এর ফলে তার চোখ দু’টো আরো দূরে দূরে হয়৷ ফলে হাতুড়ি-মাথা হাঙর আরো বেশি দেখতে পায়... যেমন শিকার...
ছবি: imago/imagebroker
11 ছবি1 | 11
বিজ্ঞানীরা এবার রঙীন ছবির বদলে সাদা-কালো ছবি ব্যবহার করেন, মানুষগুলোকেও এমনভাবে বাছেন যে তাদের মাথার আকৃতি যেন একরকম হয়৷ তা সত্ত্বেও মাছেদের ‘লক্ষ্যভ্রষ্ট' করা যায়নি৷ কাজেই বিজ্ঞানীদের তরফে রিপোর্টের যুগ্ম-রচয়িতা, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের কেইট নিউপোর্ট বলতে বাধ্য হন, ‘‘এই মাছগুলো যে কতোটা চালাক-চতুর, তা দেখলে সাধারণ মানুষ অবাক হয়ে যাবেন৷''
তবে মানুষের মতোই, সব মাছেরা একই রকম চালাক-চতুর নয়: কোনো মাছ একবার ট্রেনিং দিলেই যা শিখে ফেলে, অন্য মাছেদের তা শিখতে ১৭ দিন অবধি সময় লেগে যায়৷ বলতে কি, মানুষের মুখ আলাদা করে চিনতে পারাটা খুব সহজ কাজ নয়৷ আগে ধরে নেওয়া হতো, এ কাজের জন্য বড় আকারের, জটিল মস্তিষ্ক প্রয়োজন৷ বিশেষ করে বিবর্তনের প্রক্রিয়ায় মস্তিষ্কের যে অংশটির সবার শেষে বিকাশ ঘটেছে, সেই নিওকর্টেক্স বস্তুত মাছেদের ক্ষেত্রে পুরোপুরি অনুপস্থিত৷ পাখিরা যে মানুষের মুখ চিনতে পারে, সেও তাদের মস্তিষ্কে নিওকর্টেক্স জাতীয় কাঠামো আছে বলে৷ তাহলে মাছেরা – অন্তত তীরন্দাজ মাছেরা সেই অসাধ্যসাধন করল কিভাবে?
বিজ্ঞানীরা বলছেন, মাছেদের মস্তিষ্ক সহজ-সরল বলে তাদের বুদ্ধি যে কম হবে, এমন কোনো কথা নেই৷ গবেষণা থেকে দেখা যাচ্ছে, মাছেরা আরো অনেক কিছু শিখতে পারে – যদিও তীরন্দাজ মাছ ছাড়া অন্য কোনো জাতের মাছ নিয়ে এই পরীক্ষা করে দেখা হয়নি৷ আরো কিছু প্রশ্ন থেকে যায়: মুখ চিনতে পারাটা একটি সহজাত ক্ষমতা, নাকি অর্জিত ক্ষমতা? আবার এমনও তো হতে পারে যে, মানুষের মুখাবয়ব জীবজগতে কোনো বিশেষ বস্তু নয়?
মাছের জন্য লিফট, সিঁড়ি, ট্রেন!
কখনও ভেবে দেখেছেন নদীর যে অংশে বাঁধ দেয়া আছে সেই অংশটি মাছ পার হয় কীভাবে? ছবিঘরে থাকছে সেই উত্তর৷
লিফট
ছবিতে বাঁধের ডানপাশে যে স্থাপনাটি দেখতে পাচ্ছেন সেখানে মাছের জন্য লিফটের ব্যবস্থা করা হয়েছে৷ এর মাধ্যমে মাছ উপর থেকে নীচে কিংবা নীচ থেকে উপরে যেতে পারে৷ জার্মানি এক কোম্পানি এই লিফট তৈরি করে ‘জার্মান ইনোভেশন অ্যাওয়ার্ড’ জিতেছে৷
ছবি: Baumann Hydrotec
যেভাবে কাজ করে
বাঁধের নীচে স্থাপিত একটি চেম্বারের মধ্যে থাকা কন্টেনারের মধ্যে মাছ প্রবেশ করার পর ঢাকনা বন্ধ হয়ে যায়৷ এরপর চেম্বারের মধ্যে পানি প্রবেশ করতে থাকলে কন্টেনারটি উপরের দিকে উঠতে থাকে৷ এভাবে সম্পূর্ণ উপরে উঠে যাওয়ার পর ঢাকনাটি খুলে গেলে মাছ বের হয়ে যায়৷
ছবি: Baumann Hydrotec
লিফট কেন দরকার
কারণ অনেক মাছই আছে যেগুলো ডিম পাড়তে কিংবা খাবারের সন্ধানে অনেক পথ পাড়ি দেয়৷ যেমন স্যামন মাছ ডিম পাড়ার উপযুক্ত জায়গার সন্ধানে শত শত কিলোমিটার দূরে যায়৷ এই চলার পথে মনুষ্যসৃষ্ট কোনো বাধা পেরোতে মাছের লিফট প্রয়োজন হয়৷
ছবি: picture alliance/Arco Images GmbH
কিন্তু ব্যবস্থা না থাকলে?
ছবিতে যে বাঁধটি দেখতে পাচ্ছেন সেখানকার নীচের অংশে কোনো মাছ পৌঁছানোর পর যদি লিফট না পেয়ে সামনে যেতে না পারে তাহলে কী হতে পারে? উপর থেকে পানি যে বেগে পড়ছে তার প্রভাবে কি মাছ মরে যেতে পারে না?
ছবি: Getty Images/Jeff T. Green
মাছের জন্য ট্রেন!
১৯৪৪ সালে যখন দক্ষিণ কোরিয়ার হওয়াচন বাঁধ তৈরি হয় তখন তার কারণে মাছেদের একটি গুরুত্বপূর্ণ চলার পথ বাধাগ্রস্ত হয়েছিল৷ এর সমাধান করা হয় মাছের জন্য মনোরেল তৈরি করে৷ এর মাধ্যমে মাছকে বাঁধের এক স্তর থেকে আরেক স্তরে পৌঁছে দেয়া হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Yonhap News
ইউরোপের সবচেয়ে বড়
জার্মানির হামবুর্গে এলবে নদীতে মাছেদের জন্য প্রায় সাড়ে ৫০০ মিটার দীর্ঘ এই স্থাপনাটি তৈরি করা হয়েছে৷ সেখানে মোট ৪৫টি পুল রয়েছে, যেগুলো একটি আরেকটির সঙ্গে যুক্ত৷ চলার পথে মাছেদের এই পুলগুলো ব্যবহার করে সামনে এগিয়ে যেতে হয়৷ প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২৫ হাজার মাছ এই পথ পাড়ি দেয়৷
ছবি: dapd
ঘুরানো সিঁড়ি
লিফট বা মনোরেল ছাড়াও অনেক জায়গায় মাছেদের জন্য এমন ঘুরানো সিঁড়ির ব্যবস্থা করা হয়েছে৷ এর সুবিধা হলো, এতে মাছেদের আঘাত পাওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/J. Lübke
জার্মানির কিল শহরে
উত্তর জার্মানির কিল শহরের একটি পানিবিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাছে মাছেদের জন্য এই ঘুরানো সিঁড়ি স্থাপনা করা হয়েছে৷ এটি ২০০ মিটার দীর্ঘ৷ আর এতে ৩৬টি পুল আছে৷