ইউরোপের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন চাইলে আঙ্কারাকে মানবাধিকারের মৌলিক দিকগুলোর প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে৷ দেশটির প্রতি এমন বার্তাই দিয়েছেন ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন ডেয়ার লাইয়েন৷
ছবি: Presidential Press Office/REUTERS
বিজ্ঞাপন
নারীদের প্রতি সহিংসতা রোধে ৪৫ টি দেশের স্বাক্ষরিত একটি চুক্তি থেকে সম্প্রতি সরে আসার ঘোষণা দিয়েছে তুরস্ক৷ কাউন্সিল অব ইউরোপের উদ্যোগে ২০১১ সালে ইস্তাম্বুলে এই চুক্তিটি স্বাক্ষর হয়েছিল৷ বিষয়টিতে অসন্তোষ প্রকাশ করে ইউরোপীয় কমিশনের প্রধান উরসুলা ফন ডেয়ার লাইয়েন আঙ্কারার উদ্দেশ্যে বলেছেন, মানবাধিকারের বিষয়গুলোতে তুরস্কের সঙ্গে কোন সমঝোতা বা ছাড় দেয়া হবে না৷ তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিচেপ তাইয়েপ এর্দোয়ানের সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের কাছে এমন মন্তব্য করেছেন তিনি৷
লাইয়েন বলেন, মৌলিক অধিকার ও আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধা ইউরোপীয় ইউনিয়নের জন্য অনিবার্য বিষয়৷ ‘‘তুরস্ক ও ইউরোপের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রেও সেগুলো অবিচ্ছেদ্য হিসেবে বিবেচিত হবে৷ তুরস্ককে অবশ্যই আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও মানদণ্ডগুলোর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে,'' বলেন জার্মানির সাবেক এই প্রতিরক্ষামন্ত্রী৷
লাইয়েনের সফরসঙ্গী হিসেবে ছিলেন ইউরোপীয় কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট শার্ল মিশেল তুরস্কের সরকারের সঙ্গে বৈঠকে তারা ২০১৬ সালের অভিবাসন চুক্তি নিয়েও আলোচনা করেন৷ ‘‘অবৈধ বহির্গমন ঠেকানো ও গ্রিস থেকে অবিলম্বে (অবৈধ অভিবাসী) ফেরত নেয়া শুরুর'' বিষয়ে তুরস্কের কাছে আহ্বান জানান তারা৷ আলোচনা হয়েছে কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক দিকগুলো নিয়েও৷
তুরস্কের রেচেপ তাইয়েপ এর্দোয়ান কে?
ইসলামপন্থি তরুণ অ্যাক্টিভিস্ট থেকে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট– রাজনীতিতে নিজের ক্যারিয়ার ভালোভাবেই গড়েছেন রেচেপ তাইয়েপ এর্দোয়ান৷ তবে রাজনৈতিক জীবনে বহুবার বিতর্কে জড়িয়েছেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/E. Morenatti
এর্দোয়ানের উত্থান
তুরস্কে এবং বিদেশে রেচেপ তাইয়েপ এর্দোয়ান সম্পর্কে নানা ধরনের মতামত রয়েছে৷ তাঁকে নব্য-অটোমান ‘সুলতান’ হিসেবে যেমন বিবেচনা করা হয়, তেমনি কারো কারো চোখে তিনি একজন স্বৈরাচারী নেতা৷ রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকেই ইসলামপন্থিদের বিভিন্ন দাবিদাওয়ার ব্যাপারে সচেতন ছিলেন তিনি৷ পাশাপাশি ন্যাটোতে তাঁর নেতৃত্বে বড় ধরনের অবদান রাখছে তুরস্ক৷ এর্দোয়ানের উত্থান নিয়ে এই ছবিঘর৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/E. Morenatti
ইস্তানবুলের কারাবন্দি মেয়র
তুরস্কে ইসলামপন্থিদের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত দল ওয়েলফেয়ার পার্টিতে নিজের অবস্থান দ্রুতই পাকাপোক্ত করেছিলেন এর্দোয়ান৷ ১৯৯৪ সালে তিনি সেই দল থেকে ইস্তানবুলের মেয়রও নির্বাচিত হন৷ কিন্তু এর্দোয়ান মেয়র হওয়ার চার বছরের মাথায় সেই দলটিকে সে দেশের সরকার তুরস্কের ধর্মনিরপেক্ষ নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় ঘোষণা দিয়ে নিষিদ্ধ করে৷ এরপর জনসমক্ষে বিতর্কিত কবিতা আবৃত্তির দায়ে জেলে যান এর্দোয়ান৷ চার মাস জেল খাটেন৷
তুরস্কের একেপি পার্টির সহপ্রতিষ্ঠাতা এর্দোয়ান৷ ২০০২ সালের নির্বাচনে দলটি সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করে৷ আর ২০০৩ সালে তিনি প্রধানমন্ত্রী হন৷ দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম বছরগুলোতে এর্দোয়ান দেশবাসীকে সামাজিক সুযোগ-সুবিধা প্রদান, অর্থনীতির উন্নয়ন এবং বিভিন্ন গণতান্ত্রিক সংস্কারের দিকে মনোযোগী হন৷ তবে কেউ কেউ এটাও মনে করেন যে, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি রাজনীতিতে ধর্মের মিশ্রণ ঘটানোয় ভূমিকা রেখেছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/B. Ozbilici
ইসলামপন্থিদের স্বার্থ রক্ষা
যদিও তুরস্কের সংবিধান দেশটির ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থানকে সমর্থন করে, তারপরও এর্দোয়ান কট্টর ইসলামপন্থিদের মন জয়ের নানা চেষ্টা করেছেন৷ তুরস্কের এই শীর্ষনেতা একসময় বলেছিলেন যে, তাঁর লক্ষ্যগুলোর একটি হচ্ছে এক ‘ধার্মিক প্রজন্ম’ গড়ে তোলা৷ এর্দোয়ানের সমর্থকরা এই লক্ষ্যের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন, কেননা, তাঁরা মনে করেন, ধর্মচর্চা করা মুসলমানরা তুরস্কে নানাভাবে বঞ্চিত হচ্ছিল৷
ছবি: picture-alliance/AA/C. Ozdel
ক্যু থেকে রক্ষা
২০১৬ সালের জুলাইয়ে এর্দোয়ানের বিরুদ্ধে সে দেশের সেনাবাহিনীর এক অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়৷ তবে সেই ঘটনায় দু’শ’র বেশি বেসামরিক নাগরিক এবং সেনা সদস্য নিহত হন৷ সেই ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানের পর এর্দোয়ান আরো ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠেন এবং জরুরি অবস্থা ঘোষণার পাশাপাশি সেনাবাহিনীতে ‘শুদ্ধি অভিযান’ শুরু করেন৷
ছবি: picture-alliance/AA/K. Ozer
দেশজুড়ে অভিযান
ব্যর্থ সেই সেনা অভ্যুত্থানের পর দেশজুড়ে অভিযান পরিচালনা করে তুর্কি কর্তৃপক্ষ৷ এতে সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিচার ব্যবস্থা, স্কুল এবং গণমাধ্যম থেকে পঞ্চাশ হাজারের বেশি মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ এর্দোয়ান সেই সেনা অভ্যুত্থানের পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাসিত ধর্মীয় নেতা এবং তাঁর প্রাক্তন সঙ্গী ফেতুল্লাহ গুলেনের হাত রয়েছে বলে দাবি করেন৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/E. Gurel
বিভেদ সৃষ্টিকারী রাজনীতিবিদ
যদিও নিজের দেশে এবং বিদেশে বসবাসরত তুর্কিদের একটি বড় অংশের সমর্থন রয়েছে এর্দোয়ানের প্রতি, তা সত্ত্বেও তিনি তাঁর কঠোর নীতি এবং কুর্দিদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালানোয় কড়া সমালোচনার মুখে পড়েছেন৷ চলতি বছরের জানুয়ারিতে আফরিনে মারাত্মক আক্রমণ পরিচালনা করেন এর্দোয়ান, যার সমালোচনা করে মানবাধিকা সংস্থাগুলো৷
ছবি: picture- alliance/ZUMAPRESS/Brais G. Rouco
ব্যাপক ক্ষমতাধর
২০১৭ সালে এক গণভোটের মাধ্যমে দেশটির সংবিধান সংশোধন করা হয়৷ সংসদীয় গণতন্ত্র থেকে রাষ্ট্রপতি শাসিত প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয় তুরস্ক৷ ২০১৮ সালের ২৪ জুন নতুন করে ৫ বছরের জন্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন তিনি৷ দেশটির ইতিহাসে এতো ক্ষমতাবান প্রেসিডেন্ট এর আগে আসেননি৷ শপথ নেয়ার দিন নিজের জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি- একেপির সদস্যদের এর্দোয়ান বলেন, ‘তুরস্ক নতুন যুগে প্রবেশ করেছে’৷
ছবি: picture-alliance/abaca
8 ছবি1 | 8
বিভিন্ন কারণে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইউরোপ ও তুরস্কের সম্পর্কে টানাপোড়েন চলছিল৷ বিশেষ করে ভূমধ্যসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে সাইপ্রাস ও গ্রিসের সঙ্গে দ্বন্দ্বে ইউরোপের সঙ্গে তুরস্কের উত্তেজনা বাড়তে থাকে৷ এমনকি গত ডিসেম্বরে তুরস্কের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারির বিষয়েও আলোচনা শুরু করে ইইউ৷
প্রথমে এই হুমকি অগ্রাহ্য করলেও পরে নরম হতে শুরু করেন এর্দোয়ান৷ বিতর্কিত জলসীমানায় অনুসন্ধান বন্ধ করে আঙ্কারা৷ এর ধারাবাহিকতায় ইউরোপের সঙ্গে আলোচনার দ্বারও উন্মোচিত হয়৷
মহামারি, পর্যটনে ধ্বস, স্থানীর মুদ্রা লিরার দরপতনে তুরস্কের অর্থনীতি বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে৷ একইসঙ্গে এর্দোয়ানের মিত্র হিসেবে পরিচিত ডনাল্ড ট্রাম্পের হোয়াইট হাউস থেকে বিদায় আঙ্কারার দিক থেকে বরফ গলার অন্যতম কারণ বলে মনে করা হচ্ছে৷ তবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কর্মকর্তারা বলছেন সম্পর্কের উন্নয়ন কতটা হবে সেটি নির্ভর করছে তুরস্কের আচরণের উপরই৷ ‘‘যদি এর্দোয়ান সহযোগিতাসুলভ মনোভাব না দেখান তাহলে সবকিছু বন্ধ হয়ে যাবে,'' বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেছেন একজন ইইউ কর্মকর্তা৷
পূর্ব ভূমধ্যসাগরের বিতর্কিত সীমানায় জ্বালানি অনুসন্ধান কার্যক্রম পুনরায় চালু করা হলে ইইউর দিক থেকে নিষেধাজ্ঞার হুমকি আগে থেকেই রয়েছে তুরস্কের উপরে৷