তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এর্দোয়ান ও তাঁর সাম্প্রতিক গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে যাবতীয় সংশয় সত্ত্বেও তাঁকে উপেক্ষা করা যে সম্ভব নয়, তা ইউরোপের নেতারা ভালো করেই জানেন৷ দরকষাকষির মাধ্যমে তাঁকে শান্ত রাখতে চলছে নানা প্রচেষ্টা৷
বিজ্ঞাপন
অভ্যুত্থানের ব্যর্থ প্রচেষ্টার পর তুরস্কের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি উত্তাল হয়ে উঠেছে৷ সামান্যতম বিরোধিতাও চরম পরিণতি ডেকে আনছে৷ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত হওয়া সত্ত্বেও প্রেসিডেন্ট রেচেপ তাইয়েপ এর্দোয়ান স্বৈরাচারী নেতার মতো আচরণ করছেন বলে অভিযোগ উঠছে৷ কুর্দি জনগোষ্ঠীর উপর চলছে দমনমূলক নীতি৷ এমনকি সীমান্ত পেরিয়ে সিরিয়ার ভূখণ্ডেও কুর্দি বিদ্রোহীদের দমন করছে সেনাবাহিনী৷ ন্যাটোর সদস্য হওয়া সত্ত্বেও রাশিয়ার দিকে বেশি ঝুঁকে পড়ছেন এর্দোয়ান৷
তবে তাঁর সবচেয়ে জটিল সম্পর্ক ইউরোপের সঙ্গে৷ এক চুক্তির মাধ্যমে ইউরোপে শরণার্থীদের ঢল আটকাতে তুরস্ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে৷ এর বদলে নিজেদের নাগরিকদের জন্য ভিসামুক্ত প্রবেশের অধিকার আশা করেছিল সে দেশ৷ কিন্তু তুরস্ক এখনো সব শর্ত মেনে না নেওয়ায় ইইউ সেই সুবিধা দিতে প্রস্তুত নয়৷ এমনই এক প্রেক্ষাপটে আঙ্কারা সফর করলেন ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রেসিডেন্ট মার্টিন শুলৎস ও শরণার্থী বিষয়ক কমিশনর দিমিত্রিস আভ্রামোপুলোস৷
তুরস্ক আবার জানিয়ে দিয়েছে, বিদেশের চাপের মুখে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে প্রস্তুত নয় সে দেশ৷ অর্থাৎ সন্ত্রাস দমনের লক্ষ্যে বিতর্কিত আইনের সংস্কার করা হবে না, যা কিনা ইউরোপে ভিসামুক্ত প্রবেশাধিকারের অন্যতম প্রধান পূর্বশর্ত৷ প্রধানমন্ত্রী বিনালি ইলদিরিম বলেন, ব্যর্থ অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে এই আইন তুরস্কের কাছে জীবন-মরণের বিষয়৷ এই অবস্থায় মনঃক্ষুণ্ণ তুরস্ক শরণার্থী বিষয়ক চুক্তি কার্যকর করবে না বলে জানিয়েছে৷
চীনে আগামী সপ্তাহে জি-টোয়েন্টি শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়ে জার্মানি, ফ্রান্স ও ইটালির শীর্ষ নেতারা প্রেসিডেন্ট এর্দোয়ানের সঙ্গে শরণার্থী সংকটের বিষয়ে আলোচনা করতে আলাদা বৈঠকে বসতে চলেছেন৷ জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল এই ঘোষণা করেছেন৷ এমনকি এর্দোয়ানের দাবি মেনে তিনি জার্মান সংসদে অনুমোদিত আর্মেনীয়দের গণহত্যা সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব সম্পর্কে তাঁর সরকারের অবস্থান বদলেছেন৷ এই প্রস্তাবের প্রতিবাদে এর্দোয়ান সরকার জার্মান সংসদ সদস্যদের তুরস্কে মোতায়েন করা জার্মান সৈন্যদের সঙ্গে সাক্ষাতের উপর নিষেধাজ্ঞা চাপিয়েছিল৷ এর প্রতিবাদে তুরস্কে ন্যাটোর ঘাঁটি থেকে জার্মান সৈন্য প্রত্যাহারের উদ্যোগ চলছে৷
নতুন তুরস্ক গড়ার অঙ্গীকার দিলেন এর্দোয়ান
ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানের পর টানা তিন সপ্তাহ ধরে এর্দোয়ানের পক্ষে ব়্যালির পর, তুরস্কের ৮০টি শহরে গত রবিবার চূড়ান্ত বিক্ষোভের আয়োজন করা হয়৷ আঙ্কারা থেকে জানাচ্ছেন ডিয়াগো কুপোলো৷
ছবি: DW/D. Cupolo
রাজপথে নামার আহ্বান
গতমাসে সেনা অভ্যুত্থানের সময় তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিচেপ তাইয়েপ এর্দোয়ান তাঁর সমর্থকদের রাজপথে নেমে ক্ষমতাসীনদের রক্ষায় সেনাবাহিনীকে হটাতে সহায়তার আহ্বান জানান৷ সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে সত্যিই রাস্তায় নামেন অসংখ্য মানুষ এবং সেনাবাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়৷ এরপর এর্দোয়ান প্রতিরাতে তাঁর সমর্থকদের রাস্তায় থাকতে আহ্বান জানিয়েছিলেন৷
ছবি: DW/D. Cupolo
লাখো মানুষের উপস্থিতি
রবিবার চূড়ান্ত ব়্যালিতে ইস্তানবুলে হাজির ছিলেন ২০ লাখের মতো মানুষ৷ আঙ্কারায় ছিলেন দশ হাজার৷ তুরস্কের মোট ৮০টি শহরে এ সময় বিক্ষোভের আয়োজন করা হয়৷ এর্দোয়ানের একেপি হচ্ছে প্রথম দল, যেটি ইসলামিক মনোভাব প্রদর্শন সত্ত্বেও একটি সেনা অভ্যুত্থান ঠেকাতে পেরেছে৷ এর্দোয়ানের সমর্থকরা একে দেশটির ইতিহাসরচনাকারী সেনাবাহিনী এবং ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের বিপরীতে বড় জয় মনে করছে৷
ছবি: DW/D. Cupolo
এক নতুন তুরস্ক নিয়ে আশাবাদ
ইস্তানবুল থেকে দেয়া বক্তব্যে এর্দোয়ান নতুন এক তুরস্ক গড়ার প্রতিজ্ঞা করেছেন এবং তাঁর সমর্থকরাও এ ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন৷ আঙ্কারার রিয়েল স্টেট ব্যবসায়ী লালে আলিচি সেনা অভ্যুত্থানের পর থেকে আয়োজিত প্রতিটি ব়্যালিতে অংশ নিয়েছেন৷ তিনি জানান, অভ্যুত্থানে জড়িতদের শাস্তি দেয়ার পর তুরস্ক দ্রুত উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যাবে, কেননা তখন সরকারকে বাধা দেয়ার আর কেউ থাকবে না৷
ছবি: DW/D. Cupolo
‘‘আমরা বড় শক্তি হবো’’
ইন্টেরিয়র ডিজাইনার আতালে জানান, তিনি এর্দোয়ানকে সমর্থন দিয়েছেন কেননা তিনি তুরস্ককে বিশ্বমঞ্চে নিয়ে গেছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘এর্দোয়ান বিশ্বকে জানিয়েছেন, আমরাও আছি এবং শীঘ্রই বড় শক্তিতে পরিণত হবো৷’’
ছবি: DW/D. Cupolo
এইচডিপিকে নেয়া হয়নি
যদিও রবিবারের ব়্যালিতে অংশ নেয়া অনেকে দাবি করেছেন, গণতন্ত্রকে বাঁচাতে রাস্তায় নেমেছেন তারা, তাসত্ত্বেও বিরোধীরা জানিয়েছেন, সেদেশের তৃতীয়-বৃহত্তম রাজনৈতিক দল কুর্দিপন্থি ডেমোক্রেটিক পার্টি (এইচডিপি)-কে ব়্যালিতে যোগ দিতে দেয়া হয়নি৷ এক কুর্দ এই বিষয়ে বলেন, ‘‘কুর্দ হিসেবে আমি সেখানে যেতে পারি না, কেননা আমি নিরাপদ বোধ করছি না৷’’
ছবি: DW/D. Cupolo
সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমের উত্থান
জাতীয় জরুরি অবস্থায় সাধারণত ব্লক করা থাকলেও ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানের পর তুরস্কে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম বেশ গুরুত্ব পাচ্ছে৷ এর্দোয়ানের ‘ফেসটাইম’ বক্তব্য থেকে বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে সহিংসতা দেখানো ‘পেরিসকোপ’ ভিডিও অবধি সবকিছুই অনেক গুরুত্ব পেয়েছে৷ বিরোধীরা অবশ্য বলছেন, সরকার নিজেদের জন্য লাভজনক মনে করায় সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে বাধা সৃষ্টির কোনো উদ্যোগ নেয়নি৷