হামবুর্গে জি-টোয়েন্টি সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে অন্তত ৩২ জন সাংবাদিককে কোনো কারণ দর্শানো ছাড়াই কালো তালিকাভুক্ত করে পুলিশ৷ সম্মেলনে তাঁদের অ্যাক্রেডিটেশনও বাজেয়াপ্ত করা হয়৷ এই নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছে জার্মানিতে৷
বিজ্ঞাপন
গত সপ্তাহান্তে যেসব সাংবাদিকের জি-টোয়েন্টি অ্যাক্রেডিটেশন বাতিল করা হয়, তাঁদের মধ্যে অন্তত চারজন অতীতে তুরস্কের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে কুর্দি এলাকায় কাজ করেছেন৷ সন্দেহ করা হচ্ছে, তুর্কি সরকারের চাপেই জার্মান কর্তৃপক্ষ সেসব সাংবাদিকের জি-টোয়েন্টি সম্মেলন কাভার করার অধিকার কেড়ে নিয়েছে৷
জার্মানির সরকারি সম্প্রচার মাধ্যম এআরডি এবং স্যুডডয়েচে সাইটুং পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, জি-টোয়েন্টি সম্মেলন শুরুর পর হঠাৎ করে কোনো কারণ দর্শানো ছাড়াই আলোচিত সাংবাদিকদের অ্যাক্রেডিটেশন বাতিল করা হয়৷ বাতিল করার আগ অবধি তাঁদের কেউ কেউ একাধিকবার সম্মেলন কেন্দ্রের নিরাপত্তা বলয়ে প্রবেশ করেছেন এবং বের হয়েছেন৷
জার্মানির জনপ্রিয় পত্রিকা ডেয়ার স্পিগেল-এর আলোকচিত্রী ক্রিস গ্রোডৎস্কি ডয়চে ভেলেকে জানান, তিনি স্বাভাবিক উপায়ে বুধবার তাঁর অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড সংগ্রহ করেন৷ কিন্তু শনিবার সম্মেলন কেন্দ্রে পুনরায় প্রবেশ করতে চাইলে তিনি পুলিশের বাধার মুখে পড়েন৷ পুলিশ সদস্যদের হাতে সাংবাদিকদের নামের দুই পাতার একটি তালিকা ছিল উল্লেখ করে তিনি জানান যে, তাঁকে আর সম্মেলন কেন্দ্রে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি৷ সাংবাদিকদের এই তালিকা জার্মানির কেন্দ্রীয় ক্রিমিনাল পুলিশ অফিস বা বিকেএ পুলিশকে সরবরাহ করেছে বলেও জানান গ্রোডৎস্কি৷
ফিরে দেখা: ২০১৬ সাংবাদিকদের জন্য যেমন ছিল
সাংবাদিকদের অধিকার বিষয়ক সংগঠন কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্ট (সিপিজে)-র বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, সাংবাদিকরা ২০১৬ সালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন৷ এ বছরই সর্বোচ্চ সংখ্যক সাংবাদিককে কারাবন্দি করা হন৷
ছবি: picture-alliance/AP/M. Ugarte
যারা তালিকা বানিয়েছে
সাংবাদিকদের অধিকার বিষয়ক বেসরকারী এবং অলাভজনক সংগঠন কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্ট (সিপিজে) যাত্রা শুরু করে ১৯৮১ সালে৷ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাকস্বাধীনতার পরিস্থিতি এবং সাংবাদিকদের উপরে হামলার তথ্যাদি বার্ষিক প্রতিবেদনে তুলে ধরে সংগঠনটি৷
কারাবন্দি ২৫৯ সাংবাদিক
সিপিজে-র বাৎসরিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৬ সালে কমপক্ষে ২৫৯ সাংবাদিককে কারাবন্দি করা হয়৷ আগের বছর এই সংখ্যাটি ছিল ১৯৯৷
ছবি: AFP/Getty Images/K. Desouki
শীর্ষে তুরস্ক
সাংবাদিকদের কারাবন্দি করা দেশগুলোর মধ্যে তুরস্কের অবস্থান এক নম্বরে রয়েছে৷ গতবছরের এক ডিসেম্বর অবধি এক বছরে ৮১ সাংবাদিককে আটক করেছে দেশটি৷ গত জুলাইয়ে এক ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানের ঘটনার পর সন্দেহের বশে সাংবাদিকদের আটকসহ বেশ কিছু গণমাধ্যম বন্ধও করে দিয়েছে সেই দেশ৷
ছবি: picture-alliance/dpa
দ্বিতীয় অবস্থানে চীন
তুরস্কের পরই রয়েছে চীন৷ ২০১৬ সালে কমপক্ষে ৩৮ সাংবাদিককে কারাবন্দি করেছে সেদেশ৷ দেশটিতে সরকারবিরোধী যে কোনো আন্দোলনের প্রতিবেদন প্রকাশে কড়াকড়ি রয়েছে৷ আর মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়গুলোও চাপা দেয়ার চেষ্টা করে দেশটি৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/Apple Daily
তৃতীয় স্থানে মিশর
গতবছর ২৫ সাংবাদিককে আটক করেছে মিশর৷ কিছুক্ষেত্রে সাংবাদিকতা নয় বরং অবৈধ কর্মকাণ্ডে সম্প্রক্ত থাকার দায়ে সাংবাদিক গ্রেপ্তারের ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছে সে’দেশের সরকার৷
ছবি: Reuters/A.A.Dalsh
প্রথম পাঁচে নেই ইরান
তবে সাংবাদিক গ্রেপ্তারের তালিকায় প্রথম পাঁচটি দেশের মধ্যে নেই ইরান৷ বরং অতীতে কারাবন্দি সাংবাদিকদের কয়েকজন রেহাই পেয়েছে বছরটিতে৷
ছবি: Ilna
বাংলাদেশের দুই সাংবাদিক কারাবন্দি
বাংলাদেশের দু’জন সাংবাদিক এখনো কারাবন্দি রয়েছে বলে জানিয়েছে সিপিজে৷ সাপ্তাহিক ব্লিটস পত্রিকার সম্পাদক সালাহউদ্দিন শোয়েব চৌধুরী ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে জেলে রয়েছেন৷ অন্যদিকে, একুশে টেলিভিশনের মালিক আব্দুস সালাম জেলে আছেন ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাস থেকে৷
ছবি: Getty Images/AFP/I. Mukherjee
7 ছবি1 | 7
তিনি বলেন, ‘‘পুলিশ পর্যায়ক্রমে কেন্দ্রে প্রবেশ করতে যাওয়া সব সাংবাদিককেই চেক করছিল৷ তাঁরা আমাকে জানায় যে, আমি ভেতরে যেতে পারবো না৷ আমাকে তখন একটি চারদিক ঘেরা তাঁবুতে বসতে বলা হয়৷ কিছুক্ষণ পরে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এসে আমাকে অ্যাক্রেডিটেশন বাতিল হওয়ার কথা জানায়৷ তবে কী কারণে সেটা বাতিল হয়েছে তা বলতে পারেনি৷ আর আমাকে কোনোরকম জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়নি৷''
জার্মান সরকার অবশ্য তথ্য সুরক্ষা নীতির দোহাই দিয়ে কালো তালিকাভুক্ত সাংবাদিকদের তালিকা গণমাধ্যমের কাছে প্রকাশ করেনি৷ তবে গ্রোডৎস্কি জানান যে, সেসময় তিনি তালিকা দেখেছিলেন এবং ৩২ জনের নাম থাকার বিষয়টি সঠিকই মনে হচ্ছে তাঁর কাছে৷
এদিকে, জি-টোয়েন্টি সম্মেলনে প্রবেশ করতে না দেয়া অন্তত নয় জন সাংবাদিককে বিকেএ আনুষ্ঠানিক এক চিঠিতে জানিয়েছে যে, সম্মেলনে অংশ নেয়া বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে পরামর্শের ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে৷ জানা গেছে, সম্মেলনে প্রবেশ করতে না দেয়া নয় সাংবাদিকের অধিকাংশই জার্মান৷
বাকস্বাধীনতা যেখানে যেমন
আপনার দেশে বাকস্বাধীনতা পরিস্থিতি কেমন? ডয়চে ভেলের দুই সাংবাদিক এই প্রশ্ন করেছিলেন সদ্য সমাপ্ত গ্লোবাল মিডিয়া ফোরামে আগত বিভিন্ন দেশের ব্লগার, সাংবাদিক, অ্যাক্টিভিস্টদের৷
ছবি: DW/A. S. Brändlin
শাম্মী হক, অ্যাক্টিভিস্ট, বাংলাদেশ
‘‘বাংলাদেশের মানুষ তাদের মনের কথা বলতে পারেন না৷ সেখানে কোনো বাকস্বাধীনতা নেই এবং প্রতিদিন পরিস্থিতি খারাপের দিকেই যাচ্ছে৷ একজন সামাজিক অ্যাক্টিভিস্ট এবং ব্লগার হিসেবে আমি ধর্ম নিয়ে লেখালেখি করি, যা ইসলামিস্টরা পছন্দ করেনা৷ তারা ইতোমধ্যে ছয় ব্লগারকে হত্যা করেছে৷ ফলে আমি দেশ ছাড়তে বাধ্য হই৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
নিরাপত্তার কারণে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, ভেনেজুয়েলা
‘‘বাকস্বাধীনতা হচ্ছে এমন এক ধারণা যার অস্তিত্ব আমার দেশে নেই৷ সাংবাদিকরা জরিমানা আর নিজের জীবনের উপর ঝুঁকি এড়াতে সরকারের সমালোচনা করতে চায়না৷ সরকারের সমালোচনা করলে সাংবাদিকদের বিচারের মুখোমুখি হতে হয়৷ এরকম পরিস্থিতির কারণে অনেক সাংবাদিক দেশ ছেড়ে চলে গেছেন৷ দেশটির আশি শতাংশ গণমাধ্যমের মালিক সরকার, তাই সাধারণ মানুষের মত প্রকাশের একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়া৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
রোমান দবরোখটভ এবং একাতেরিনা কুজনেটসোভা, সাংবাদিক, রাশিয়া
রোমান: ‘‘রাশিয়ায় সরকার আপনাকে সেন্সর করবে৷ আমাদের ওয়েবসাইটটি ছোট এবং লাটভিয়ায় নিবন্ধিত৷ ফলে আমি সেন্সরশিপ এড়াতে পারছি৷ তা সত্ত্বেও সরকার মাঝে মাঝে আমাদের সার্ভারে হামলা চালায়৷’’ একাতেরিনা: ‘‘রাশিয়ায় বাকস্বাধীনতার কোনো অস্তিত্ব নেই৷ ইউরোপের মানুষ রাজনীতিবিদদের সমালোচনা করার ক্ষেত্রে স্বাধীন৷ আমি আশা করছি, রাশিয়ার পরিস্থিতিও বদলে যাবে৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
নিরাপত্তার কারণে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, সিরিয়া
‘‘বেশ কয়েক বছর ধরেই সিরিয়ায় বাকস্বাধীনতার কোনো অস্তিত্ব নেই৷ এমনকি আসাদের শাসনামল সম্পর্কে অনুমতি ছাড়া মতামতও প্রকাশ করা যায়না৷ এটা নিষিদ্ধ৷ কেউ যদি সেই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে তাহলে খুন হতে পারে৷ আমি যদি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনামূলক কিছু লিখি, তাহলে বেশিদিন বাঁচতে পারবো না৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
আয়েশা হাসান, সাংবাদিক, পাকিস্তান
‘‘পাকিস্তানে ‘গণমাধ্যমের স্বাধীনতা’ শব্দ দু’টি খুবই বিপজ্জনক৷ এগুলোর ব্যবহার আপনার ক্যারিয়ার বা জীবন শেষ করে দিতে পারে৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
রাবা বেন দউখান, রেডিও সাংবাদিক, টিউনিশিয়া
‘‘আমাদের অভ্যুত্থানের একমাত্র ফল হচ্ছে বাকস্বাধীনতা৷ আমরা এখন আমাদের সরকারের সমালোচনা করার ব্যাপারে স্বাধীন৷ এবং আমি যখন আমাদের অঞ্চলের অন্য দেশের বাসিন্দাদের বাকস্বাধীনতার কথা জিজ্ঞাসা করি, তখন একটা বড় ব্যবধান দেখতে পাই৷ আমাদের দেশে দুর্নীতিসহ নানা সমস্যা আছে সত্যি, তবে বাকস্বাধীনতা কোনো সমস্যা নয়৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
খুসাল আসেফি, রেডিও ম্যানেজার, আফগানিস্তান
‘‘বাকস্বাধীনতা আফগানিস্তানে একটি ‘সফট গান৷’ এটা হচ্ছে মানুষের মতামত, যা সম্পর্কে সরকার ভীত৷ এটা চ্যালেঞ্জিং হলেও আমাদের প্রতিবেশীদের তুলনায় আমাদের অবস্থা ভালো৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
সেলিম সেলিম, সাংবাদিক, ফিলিস্তিন
‘‘ফিলিস্তিনে সাংবাদিকদের খুব বেশি স্বাধীনতা নেই৷ একটা বড় সমস্যা হচ্ছে, সাংবাদিকরা মুক্তভাবে ঘোরাফেরা করতে পারে না৷ ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার করছে৷ তারা যদি ফেসবুকে তাদের মতামত জানায়, তাহলেও সরকার গ্রেপ্তার করে৷ তবে সিরিয়া বা ইরাকের চেয়ে অবস্থা ভালো৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
অনন্য আজাদ, লেখক, বাংলাদেশ
‘‘আমাদের দেশে কোনো বাকস্বাধীনতা নেই৷ আপনি ইসলাম বা সরকারের সমালোচনা করে কিছু বলতে পারবেন না৷ ইসলামী মৌলবাদীরা ঘোষণা দিয়েছে, কেউ যদি ইসলামের সমালোচনা করে, তাহলে তাকে হত্যা করা হবে৷ আমি একজন সাংবাদিক এবং গত বছর আমাকে ইসলামিস্ট জঙ্গিরা হত্যার হুমকি দিয়েছে৷ ফলে আমাকে দেশ থেকে পালাতে হয়েছে৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
9 ছবি1 | 9
স্যুডডয়েচে সাইটুং পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, এই নয় সাংবাদিকের মধ্যে চারজন অতীতে তুরস্কের কুর্দি এলাকায় কাজ করেছেন৷ তবে জার্মান সরকারের মুখপাত্র স্টেফেন জাইবার্ট জানিয়েছেন, বিদেশি কোনো কর্তৃপক্ষ নয়, জার্মানির বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের মধ্যে পরামর্শের ভিত্তিতে সাংবাদিকদের অ্যাক্রেডিটেশন বাতিল করা হয়৷
সাংবাদিকদের তালিকাভুক্ত করার সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্ক থাকার বিষয়টি আরো এক কারণে আলোচনায় আসছে৷ গ্রোডৎস্কি এবং তাঁর সঙ্গে থাকা আরেক সাংবাদিক ২০১৪ সালে তুরস্ক-সিরিয়া সীমান্তের কোবানিতে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন৷ দেখা যাচ্ছে, তাঁদের দু'জনের নিবন্ধনই বাতিল করেছে পুলিশ৷ আরো এক জার্মান সাংবাদিক, যিনি অতীতে তুরস্কে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন, তাঁর নামও পুলিশের তালিকায় যোগ হয়৷ এছাড়া এক তুর্কি সাংবাদিকও সম্মেলনে নিষিদ্ধ হন৷ ফলে তুরস্কের পরামর্শে ৩২ সাংবাদিককে জি-টোয়েন্টিতে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ ঘুরপাক খাচ্ছে৷