ছিলেন প্রধানমন্ত্রী, হয়ে গেলেন প্রেসিডেন্ট৷ রবিবারের নির্বাচনে রেচেপ তাইয়িপ এর্দোয়ান প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে তুরস্কে ক্ষমতার রাশ নিজের হাতেই রাখতে সমর্থ হলেন৷ তবে বিতর্ক তাঁর পিছন ছাড়ছে না৷
বিজ্ঞাপন
তুরস্কের সমাজের একটা বড় অংশে এর্দোয়ানের জনপ্রিয়তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই৷ এমনকি এই প্রথম বিদেশে বসবাসরত তুর্কি নাগরিকরা ভোটদানের ক্ষমতা পেয়ে তাঁর প্রতি বিপুল আস্থা দেখিয়েছেন৷ শুধু জার্মানিতেই তাঁর পক্ষে ভোট পড়েছে ৮০ শতাংশের বেশি৷ দেশের মধ্যে ৫২ শতাংশ ভোটই তাঁর ঝুলিতে পড়েছে, যদিও তিনি আরও বেশি সমর্থন প্রত্যাশা করেছিলেন৷ ২০০৩ সালে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় আসার পর তিনি দেশের উন্নতির জন্য যে কাজ করেছেন এবং সাফল্য দেখিয়েছেন, তার স্বীকৃতি হিসেবেই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আস্থা অর্জন করতে পেরেছেন তিনি৷ তুরস্ককে বিশ্বমঞ্চে আরও শক্তিশালীভাবে প্রতিষ্ঠা করার অঙ্গীকার করে এসেছেন তিনি৷
বসফরাসের সুন্দর স্থাপত্য হাজিয়া সোফিয়া
আধুনিক তুরস্কের প্রতিষ্ঠাতা মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক ১৯৩৪ সালে হাজিয়া সোফিয়াকে জাদুঘরে পরিবর্তিত করেন৷১৯৮৫ সালে হাজিয়া সোফিয়া ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য স্থাপনার তালিকায় স্থান পায়৷
ছবি: picture-alliance/Marius Becker
স্থাপত্যশিল্পে ‘মাইলফলক’
৫৩২ খ্রিষ্টাব্দে রোমান সম্রাট জাস্টিনিয়ান কনস্ট্যান্টিনোপলের অধিবাসীদের জন্য এমন একটি গির্জা নির্মাণের নির্দেশ দেন, যেটি আগে কখনো নির্মাণ হয়নি, এমনকি ভবিষ্যতেও হবে না৷ গির্জাটি নির্মাণে কাজ করেছিল ১০ হাজার কর্মী৷ অন্তত এক হাজার বছর ধরে বসফরাস ব্যাসিলিকাই ছিল খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় চার্চ৷
ছবি: imago/blickwinkel
বাইজেন্টাইনদের অভিষেক স্থল
হাজিয়া সোফিয়ার নিমার্ণে জাস্টিনিয়ান প্রায় ১৫০ টন স্বর্ণ বিনিয়োগ করেছিলেন৷ এরপরও ভবনটির কিছু সংস্কার প্রয়োজন ছিল৷ কেননা গম্বুজটা ছিল একেবারে সমতল এবং ভূমিকম্পের কারণে যা কিছুটা বেঁকে গিয়েছিল৷ নির্মাণের পর থেকে হাজিয়া সোফিয়া রোমান সাম্রাজ্যের প্রধান গির্জা হিসেবে ব্যবহৃত হত৷ সপ্তম শতক থেকে সব বাইজেন্টাইন সম্রাটদের অভিষেক হত এখানে৷
ছবি: Getty Images
গির্জা থেকে মসজিদে রূপান্তর
১৪৫৩ খ্রিষ্টাব্দে কনস্ট্যান্টিনোপলে বাইজেন্টাইনদের রাজত্ব শেষ হয়৷ এর দখল নেন অটোমান সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় সুলতান মোহাম্মদ এবং তখন হাজিয়া সোফিয়াকে মসজিদে রূপান্তর করেন৷ প্রথমে একটি মিনার নির্মাণের মাধ্যমে রূপান্তরের কাজ শুরু হয়৷ এরপর ক্রস, ঘণ্টা এবং চিত্রকর্মের পরিবর্তন করা হয়৷
ছবি: public domain
মসজিদ থেকে জাদুঘর
আধুনিক তুরস্কের প্রতিষ্ঠাতা মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক ১৯৩৪ সালে হাজিয়া সোফিয়াকে জাদুঘরে পরিবর্তিত করেন৷ সংস্কারের সময় পুরোনো বাইজেন্টাইন স্থাপত্য মোজাইক খুঁড়ে বের করা হয়৷ তবে খুব সতর্কতার সাথে এটা করা হয়েছে, যাতে পরবর্তীতে ইসলামিক যে নিদর্শনগুলো তৈরি হয়েছে সেগুলো যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়৷
ছবি: AP
ইসলাম ও খ্রিষ্ট ধর্মের সহাবস্থান
হাজিয়া সোফিয়ার ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো যেন এর মধ্য দিয়েই প্রতিফলিত হয়েছে৷ একপাশে মোহাম্মদ, অন্যদিকে আল্লাহ লেখা আবার মাদার মেরীর কোলে যীশু খ্রিষ্ট সবই আছে এখানে৷ সেই সাথে গম্বুজে ৪০টি জানালা দিয়ে আলো এসে এটিকে যেন অতিপ্রাকৃত করে তোলে৷
ছবি: Bulent Kilic/AFP/Getty Images
বাইজেন্টাইন আইকন
হাজিয়া সোফিয়ার সবচেয়ে সুন্দর শিল্পকর্মের একটি এটি৷ হাজিয়া সোফিয়া খুঁড়ে ১৪ শতকের এই নিদর্শন পাওয়া গেছে, যা গ্যালারিতে রাখা আছে৷
ছবি: STR/AFP/Getty Images
প্রার্থনার জায়গা নেই
হাজিয়া সোফিয়াতে বর্তমানে প্রার্থনা করা নিষিদ্ধ৷ ২০০৬ সালে পোপ ষোড়শ বেনেডিক্ট যখন হাজিয়া সোফিয়াতে গিয়েছিলেন, তখন এই ব্যবস্থাপনাকে সম্মান জানিয়েছিলেন৷ তবে তুরস্কের মানুষ এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিল৷
ছবি: Mustafa Ozer/AFP/Getty Images
প্রতীকি মূল্য
হাজিয়া সোফিয়ার পাশেই অবস্থিত সুলতান আহমেদ মসজিদ যা ব্লু মস্ক বা নীল মসজিদ হিসেবে বেশি পরিচিত৷ তুরস্কবাসী চান যাতে হাজিয়া সোফিয়াকে মসজিদে রূপান্তর করা হয় এবং সেখানে নামাজ পড়ার ব্যবস্থা করা হয়৷
ছবি: picture-alliance/Arco
খ্রিষ্টানদের দাবি
কনস্ট্যান্টিনোপলে সনাতন খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বীদের প্রধান যাজক প্রথম বার্থোলোমায়সও হাজিয়া সোফিয়া তাঁদের বলে দাবি করেছেন৷ বহু বছর ধরে তিনি এর পক্ষে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন৷ এটাকে গির্জা হিসেবে ব্যবহারের আবেদন জানিয়েছেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/dpa
সিন্ধান্ত হয়নি
হাজিয়া সোফিয়ার ভবিষ্যত এখনো অনিশ্চিত৷ বিরোধী দল এমএইচটি এটিকে মসজিদে রূপান্তরের জন্য এখনও দাবি জানাচ্ছে৷ এখন পর্যন্ত পার্লামেন্টে দুটি আবেদন করেছে তারা, যা নাকচ হয়েছে৷ ১৯৮৫ সালে হাজিয়া সোফিয়া ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য স্থাপনার তালিকায় স্থান পায়৷
ছবি: picture-alliance/Marius Becker
10 ছবি1 | 10
এই সময়কালে অর্থনৈতিক উন্নতি ও কৌশলগত গুরুত্বের মূল্যও দিতে হয়েছে তুরস্ককে৷ সমালোচকরা এর্দোয়ানের অনেক পদক্ষেপের মধ্যে স্বৈরতান্ত্রিক প্রবণতা দেখছেন৷ তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, সংবাদমাধ্যম ও বিরোধীদের পদে পদে বাধা সৃষ্টি করে সুস্থ গণতান্ত্রিক পরিবেশও শেষ করে দিয়েছেন তিনি৷ তাছাড়া ক্ষমতার রাশ নিজের হাতে রেখে দিতে তিনি প্রেসিডেন্ট পদের গুরুত্বও আচমকা বাড়িয়ে দিচ্ছেন৷ সংবিধান অনুযায়ী আগামী ২৮শে আগস্ট শপথ নেবার পর তিনি পর পর দু'বার পাঁচ বছরের জন্য প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারেন৷ সে ক্ষেত্রে আগামী ২০২৪ সাল পর্যন্ত তুরস্কের একচ্ছত্র নেতা থাকতে পারেন এর্দোয়ান৷ ফলে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা মুস্তাফা কামাল আতাতুর্কের থেকেও বেশি সময় ক্ষমতা ভোগ করার সুযোগ পাবেন তিনি৷
এই প্রথম সরাসরি প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করিয়ে পদের মর্যাদাও বাড়িয়ে নিয়েছেন তিনি৷ আগামী ২০১৫ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর সংবিধানে পরিবর্তন এনে প্রেসিডেন্টের হাতে আরও ক্ষমতা তুলে দেওয়ার চেষ্টা চলছে এর্দোয়ানের ইসলামপন্থি আক পার্টির মধ্যে৷ আপাতত প্রধানমন্ত্রী পদে নিজের অনুগত কাউকে বসিয়ে আরও এক দশক ধরে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন এর্দোয়ান৷
সমালোচনা দূরে রাখতে এর্দোয়ান নিজেকে সব নাগরিকের প্রেসিডেন্ট হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন৷ সব বিভেদ ভুলে তিনি মানুষের উদ্দেশ্যে ঐক্যবদ্ধ হবার আহ্বান জানিয়েছেন৷ উল্লেখ্য, আতাতুর্কের আদর্শে অনুপ্রাণিত ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি এর্দোয়ানের তুমুল বিরোধিতা করে চলেছে৷ তাঁর আমলে ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগদানের প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়েছে৷ মানবাধিকার, সব সম্প্রদায়ের ধর্মীয় স্বাধীনতা থেকে শুরু করে অনেক প্রশ্নে তুরস্কের বিরুদ্ধে সমালোচনার মাত্রা বাড়ছে৷
এর্দোয়ানের জয়ের পর জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল সহ ইউরোপীয় নেতারা তাঁকে অভিনন্দন জানিয়েছেন৷ সিরিয়া, ইরাক ও মধ্যপ্রাচ্যে চলমান সংকটের প্রেক্ষাপটে তুরস্কের ভূমিকা আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে৷