প্রবল মার্কিন চাপের মুখে আর্থিক ও অর্থনৈতিক সংকটের মুখে পড়েছে তুরস্ক৷ ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে৷ সে দেশের প্রেসিডেন্ট এর্দোয়ান একাধিক পদক্ষেপ নিয়ে পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে চান৷
বিজ্ঞাপন
সামরিক জোট ন্যাটোর দুই সদস্য দেশের মধ্যে এমন সংঘাতের ঘটনা সত্যি বিরল৷ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রেচেপ তাইয়িপ এর্দোয়ান একাধিক বিষয়কে কেন্দ্র করে পরস্পরের মধ্যে ব্যবধান এত বাড়িয়ে তুলেছেন যে, তার ফলে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের মারাত্মক অবনতি ঘটেছে৷ সিরিয়ায় তুরস্কের ভূমিকা, রাশিয়ার সঙ্গে সে দেশের বেড়ে চলা ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের জের ধরে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম আমদানি থেকে শুরু করে তুরস্কের এক মার্কিন যাজককে আটক করার ঘটনার পর ওয়াশিংটন আংকারার উপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করছে৷ তারই আওতায় ট্রাম্প প্রশাসন তুরস্ক থেকে ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়াম আমদানির উপর শুল্ক দ্বিগুণ করে দিয়েছে৷
এই সংঘাতের জের ধরে তুরস্কের মুদ্রা লিরার ব্যাপক অবমূল্যায়ন ঘটে চলেছে৷ চলতি বছরেই লিরার বিনিময় মূল্য প্রায় ৪০ শতাংশ কমে গেছে৷ ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে তুরস্ককে নিয়ে দুশ্চিন্তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে৷
এর্দোয়ান অবশ্য এমন প্রবণতাকে মুদ্রা সংকট হিসেবে মানতে রাজি নন৷ তাঁর মতে, তুরস্ককে অর্থনৈতিক যুদ্ধের লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে৷ ২০১৬ সালের জুলাই মাসে ব্যর্থ অভ্যুত্থানের নেপথ্যে যারা ছিল, তারা এবার সে দেশের অর্থনীতির ক্ষতি করতে চাইছে বলে দাবি করেছেন তিনি৷ কোনো দেশের নাম না করলেও এর্দোয়ান এই প্রচেষ্টা রুখতে সংগ্রামের ঘোষণা করেছেন৷ তাঁর মতে, তুরস্ক মোটেই কোনো ধরনের সংকটে পড়েনি৷ উৎপাদন বাড়িয়ে ও সুদের হার কমিয়ে তিনি এই ষড়যন্ত্রের মোকাবিলা করতে চান৷ সেইসঙ্গে তিনি তুরস্কের নাগরিকদের উদ্দেশ্যে সঞ্চিত ডলার ও ইউরো বিক্রি করে লিরার বিনিময় মূল্য চাঙ্গা করার ডাক দেন৷ তুরস্কের বিরুদ্ধে ‘রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র' রুখতে তিনি নতুন বাজার ও সহযোগী খুঁজবেন বলে জানিয়েছেন৷
মার্কিন এভানজেলিস্ট যাজকযাজক বিতর্ক ‘সমাধানে' রাজি তুরস্ক অ্যান্ড্রু ব্রানসনকে আটক করে ওয়াশিংটনের রোষ আরও জোরালোভাবে টের পাচ্ছে তুরস্ক৷ এর্দোয়ান বলেন যে, ব্রানসনের মুক্তির জন্য সময়সীমা স্থির করে দেওয়া হয়েছিল৷ কিন্তু সেই হুমকির মুখে তুরস্ক নতি স্বীকার করবে না বলে সাফ জানিয়ে দেন তিনি৷ উল্লেখ্য, প্রায় ২০ মাস ধরে কারাবাসের পর ব্রানসকে গৃহবন্দি রাখার নির্দেশ দেয় আদালত৷ ট্রাম্প ও মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স বার বার তাঁর মুক্তির দাবি করে চলেছেন৷
তুরস্কের এক প্রতিনিধিদল সম্প্রতি ওয়াশিংটন সফর করেও কোনো বোঝাপড়ায় পৌঁছতে পারেনি৷ এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে মার্কিন প্রশাসন তুরস্কের দুই মন্ত্রীর উপর বাধানিষেধ আরোপ করেছে৷
এসবি/এসিবি (রয়টার্স, এএফপি)
তুরস্কের রেচেপ তাইয়েপ এর্দোয়ান কে?
ইসলামপন্থি তরুণ অ্যাক্টিভিস্ট থেকে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট– রাজনীতিতে নিজের ক্যারিয়ার ভালোভাবেই গড়েছেন রেচেপ তাইয়েপ এর্দোয়ান৷ তবে রাজনৈতিক জীবনে বহুবার বিতর্কে জড়িয়েছেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/E. Morenatti
এর্দোয়ানের উত্থান
তুরস্কে এবং বিদেশে রেচেপ তাইয়েপ এর্দোয়ান সম্পর্কে নানা ধরনের মতামত রয়েছে৷ তাঁকে নব্য-অটোমান ‘সুলতান’ হিসেবে যেমন বিবেচনা করা হয়, তেমনি কারো কারো চোখে তিনি একজন স্বৈরাচারী নেতা৷ রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকেই ইসলামপন্থিদের বিভিন্ন দাবিদাওয়ার ব্যাপারে সচেতন ছিলেন তিনি৷ পাশাপাশি ন্যাটোতে তাঁর নেতৃত্বে বড় ধরনের অবদান রাখছে তুরস্ক৷ এর্দোয়ানের উত্থান নিয়ে এই ছবিঘর৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/E. Morenatti
ইস্তানবুলের কারাবন্দি মেয়র
তুরস্কে ইসলামপন্থিদের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত দল ওয়েলফেয়ার পার্টিতে নিজের অবস্থান দ্রুতই পাকাপোক্ত করেছিলেন এর্দোয়ান৷ ১৯৯৪ সালে তিনি সেই দল থেকে ইস্তানবুলের মেয়রও নির্বাচিত হন৷ কিন্তু এর্দোয়ান মেয়র হওয়ার চার বছরের মাথায় সেই দলটিকে সে দেশের সরকার তুরস্কের ধর্মনিরপেক্ষ নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় ঘোষণা দিয়ে নিষিদ্ধ করে৷ এরপর জনসমক্ষে বিতর্কিত কবিতা আবৃত্তির দায়ে জেলে যান এর্দোয়ান৷ চার মাস জেল খাটেন৷
তুরস্কের একেপি পার্টির সহপ্রতিষ্ঠাতা এর্দোয়ান৷ ২০০২ সালের নির্বাচনে দলটি সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করে৷ আর ২০০৩ সালে তিনি প্রধানমন্ত্রী হন৷ দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম বছরগুলোতে এর্দোয়ান দেশবাসীকে সামাজিক সুযোগ-সুবিধা প্রদান, অর্থনীতির উন্নয়ন এবং বিভিন্ন গণতান্ত্রিক সংস্কারের দিকে মনোযোগী হন৷ তবে কেউ কেউ এটাও মনে করেন যে, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি রাজনীতিতে ধর্মের মিশ্রণ ঘটানোয় ভূমিকা রেখেছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/B. Ozbilici
ইসলামপন্থিদের স্বার্থ রক্ষা
যদিও তুরস্কের সংবিধান দেশটির ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থানকে সমর্থন করে, তারপরও এর্দোয়ান কট্টর ইসলামপন্থিদের মন জয়ের নানা চেষ্টা করেছেন৷ তুরস্কের এই শীর্ষনেতা একসময় বলেছিলেন যে, তাঁর লক্ষ্যগুলোর একটি হচ্ছে এক ‘ধার্মিক প্রজন্ম’ গড়ে তোলা৷ এর্দোয়ানের সমর্থকরা এই লক্ষ্যের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন, কেননা, তাঁরা মনে করেন, ধর্মচর্চা করা মুসলমানরা তুরস্কে নানাভাবে বঞ্চিত হচ্ছিল৷
ছবি: picture-alliance/AA/C. Ozdel
ক্যু থেকে রক্ষা
২০১৬ সালের জুলাইয়ে এর্দোয়ানের বিরুদ্ধে সে দেশের সেনাবাহিনীর এক অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়৷ তবে সেই ঘটনায় দু’শ’র বেশি বেসামরিক নাগরিক এবং সেনা সদস্য নিহত হন৷ সেই ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানের পর এর্দোয়ান আরো ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠেন এবং জরুরি অবস্থা ঘোষণার পাশাপাশি সেনাবাহিনীতে ‘শুদ্ধি অভিযান’ শুরু করেন৷
ছবি: picture-alliance/AA/K. Ozer
দেশজুড়ে অভিযান
ব্যর্থ সেই সেনা অভ্যুত্থানের পর দেশজুড়ে অভিযান পরিচালনা করে তুর্কি কর্তৃপক্ষ৷ এতে সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিচার ব্যবস্থা, স্কুল এবং গণমাধ্যম থেকে পঞ্চাশ হাজারের বেশি মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ এর্দোয়ান সেই সেনা অভ্যুত্থানের পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাসিত ধর্মীয় নেতা এবং তাঁর প্রাক্তন সঙ্গী ফেতুল্লাহ গুলেনের হাত রয়েছে বলে দাবি করেন৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/E. Gurel
বিভেদ সৃষ্টিকারী রাজনীতিবিদ
যদিও নিজের দেশে এবং বিদেশে বসবাসরত তুর্কিদের একটি বড় অংশের সমর্থন রয়েছে এর্দোয়ানের প্রতি, তা সত্ত্বেও তিনি তাঁর কঠোর নীতি এবং কুর্দিদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালানোয় কড়া সমালোচনার মুখে পড়েছেন৷ চলতি বছরের জানুয়ারিতে আফরিনে মারাত্মক আক্রমণ পরিচালনা করেন এর্দোয়ান, যার সমালোচনা করে মানবাধিকা সংস্থাগুলো৷
ছবি: picture- alliance/ZUMAPRESS/Brais G. Rouco
ব্যাপক ক্ষমতাধর
২০১৭ সালে এক গণভোটের মাধ্যমে দেশটির সংবিধান সংশোধন করা হয়৷ সংসদীয় গণতন্ত্র থেকে রাষ্ট্রপতি শাসিত প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয় তুরস্ক৷ ২০১৮ সালের ২৪ জুন নতুন করে ৫ বছরের জন্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন তিনি৷ দেশটির ইতিহাসে এতো ক্ষমতাবান প্রেসিডেন্ট এর আগে আসেননি৷ শপথ নেয়ার দিন নিজের জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি- একেপির সদস্যদের এর্দোয়ান বলেন, ‘তুরস্ক নতুন যুগে প্রবেশ করেছে’৷