ইস্তাম্বুলে প্রসিকিউটারের দপ্তর থেকে জানানো হয়, এই দুই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হুমকি এবং ব্ল্যাকমেলের অভিযোগ আছে। তারা আরো জানান, "অভিযুক্তদের আটক করে তল্লাশি করা হচ্ছে এবং তদন্ত চলছে।"
তিমুর এবং মুরাদ সরকার বিরোধী দৈনিক বিরগুন এবং কমহুরিয়াতের সাংবাদিক। আটকের নিন্দা করে এই দুই পত্রিকার তরফ থেকে জানানো হয়েছে, ইস্তাম্বুলের মেয়র ইমামোলুর গ্রেপ্তারি নিয়ে অনুসন্ধান করার কারণেই তিমুর এবং মুরাদকে আটক করা হয়।
তুরস্কে আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এর্দোয়ানের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন ইমামোলু।
কর্তৃপক্ষকে সহযোগিতার আশ্বাস সত্ত্বেও আটক
এই দুই ধৃত সাংবাদিকদের আইনজীবী এনেস এরমানের জানিয়েছেন, আগে থেকে কর্তৃপক্ষের সামনে স্বেচ্ছায় জবানবন্দি দিতে রাজি হওয়া সত্ত্বেও তাদেরকে আটক করা হয়।
এক্স হ্যান্ডেলে তিনি লেখেন, "সহযোগিতা করার জন্য প্রস্তুত এবং সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য সময় নির্ধারণ করা ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করা কেবলমাত্র বেআইনিই নয়, এর থেকে প্রমাণিত হয় শত্রু বিষয়ক ফৌজদারি আইন প্রণয়ন করা হচ্ছে।"
তুরস্কের রেচেপ তাইয়েপ এর্দোয়ান কে?
ইসলামপন্থি তরুণ অ্যাক্টিভিস্ট থেকে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট– রাজনীতিতে নিজের ক্যারিয়ার ভালোভাবেই গড়েছেন রেচেপ তাইয়েপ এর্দোয়ান৷ তবে রাজনৈতিক জীবনে বহুবার বিতর্কে জড়িয়েছেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/E. Morenatti
এর্দোয়ানের উত্থান
তুরস্কে এবং বিদেশে রেচেপ তাইয়েপ এর্দোয়ান সম্পর্কে নানা ধরনের মতামত রয়েছে৷ তাঁকে নব্য-অটোমান ‘সুলতান’ হিসেবে যেমন বিবেচনা করা হয়, তেমনি কারো কারো চোখে তিনি একজন স্বৈরাচারী নেতা৷ রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকেই ইসলামপন্থিদের বিভিন্ন দাবিদাওয়ার ব্যাপারে সচেতন ছিলেন তিনি৷ পাশাপাশি ন্যাটোতে তাঁর নেতৃত্বে বড় ধরনের অবদান রাখছে তুরস্ক৷ এর্দোয়ানের উত্থান নিয়ে এই ছবিঘর৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/E. Morenatti
ইস্তানবুলের কারাবন্দি মেয়র
তুরস্কে ইসলামপন্থিদের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত দল ওয়েলফেয়ার পার্টিতে নিজের অবস্থান দ্রুতই পাকাপোক্ত করেছিলেন এর্দোয়ান৷ ১৯৯৪ সালে তিনি সেই দল থেকে ইস্তানবুলের মেয়রও নির্বাচিত হন৷ কিন্তু এর্দোয়ান মেয়র হওয়ার চার বছরের মাথায় সেই দলটিকে সে দেশের সরকার তুরস্কের ধর্মনিরপেক্ষ নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় ঘোষণা দিয়ে নিষিদ্ধ করে৷ এরপর জনসমক্ষে বিতর্কিত কবিতা আবৃত্তির দায়ে জেলে যান এর্দোয়ান৷ চার মাস জেল খাটেন৷
তুরস্কের একেপি পার্টির সহপ্রতিষ্ঠাতা এর্দোয়ান৷ ২০০২ সালের নির্বাচনে দলটি সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করে৷ আর ২০০৩ সালে তিনি প্রধানমন্ত্রী হন৷ দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম বছরগুলোতে এর্দোয়ান দেশবাসীকে সামাজিক সুযোগ-সুবিধা প্রদান, অর্থনীতির উন্নয়ন এবং বিভিন্ন গণতান্ত্রিক সংস্কারের দিকে মনোযোগী হন৷ তবে কেউ কেউ এটাও মনে করেন যে, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি রাজনীতিতে ধর্মের মিশ্রণ ঘটানোয় ভূমিকা রেখেছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/B. Ozbilici
ইসলামপন্থিদের স্বার্থ রক্ষা
যদিও তুরস্কের সংবিধান দেশটির ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থানকে সমর্থন করে, তারপরও এর্দোয়ান কট্টর ইসলামপন্থিদের মন জয়ের নানা চেষ্টা করেছেন৷ তুরস্কের এই শীর্ষনেতা একসময় বলেছিলেন যে, তাঁর লক্ষ্যগুলোর একটি হচ্ছে এক ‘ধার্মিক প্রজন্ম’ গড়ে তোলা৷ এর্দোয়ানের সমর্থকরা এই লক্ষ্যের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন, কেননা, তাঁরা মনে করেন, ধর্মচর্চা করা মুসলমানরা তুরস্কে নানাভাবে বঞ্চিত হচ্ছিল৷
ছবি: picture-alliance/AA/C. Ozdel
ক্যু থেকে রক্ষা
২০১৬ সালের জুলাইয়ে এর্দোয়ানের বিরুদ্ধে সে দেশের সেনাবাহিনীর এক অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়৷ তবে সেই ঘটনায় দু’শ’র বেশি বেসামরিক নাগরিক এবং সেনা সদস্য নিহত হন৷ সেই ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানের পর এর্দোয়ান আরো ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠেন এবং জরুরি অবস্থা ঘোষণার পাশাপাশি সেনাবাহিনীতে ‘শুদ্ধি অভিযান’ শুরু করেন৷
ছবি: picture-alliance/AA/K. Ozer
দেশজুড়ে অভিযান
ব্যর্থ সেই সেনা অভ্যুত্থানের পর দেশজুড়ে অভিযান পরিচালনা করে তুর্কি কর্তৃপক্ষ৷ এতে সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিচার ব্যবস্থা, স্কুল এবং গণমাধ্যম থেকে পঞ্চাশ হাজারের বেশি মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ এর্দোয়ান সেই সেনা অভ্যুত্থানের পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাসিত ধর্মীয় নেতা এবং তাঁর প্রাক্তন সঙ্গী ফেতুল্লাহ গুলেনের হাত রয়েছে বলে দাবি করেন৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/E. Gurel
বিভেদ সৃষ্টিকারী রাজনীতিবিদ
যদিও নিজের দেশে এবং বিদেশে বসবাসরত তুর্কিদের একটি বড় অংশের সমর্থন রয়েছে এর্দোয়ানের প্রতি, তা সত্ত্বেও তিনি তাঁর কঠোর নীতি এবং কুর্দিদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালানোয় কড়া সমালোচনার মুখে পড়েছেন৷ চলতি বছরের জানুয়ারিতে আফরিনে মারাত্মক আক্রমণ পরিচালনা করেন এর্দোয়ান, যার সমালোচনা করে মানবাধিকা সংস্থাগুলো৷
ছবি: picture- alliance/ZUMAPRESS/Brais G. Rouco
ব্যাপক ক্ষমতাধর
২০১৭ সালে এক গণভোটের মাধ্যমে দেশটির সংবিধান সংশোধন করা হয়৷ সংসদীয় গণতন্ত্র থেকে রাষ্ট্রপতি শাসিত প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয় তুরস্ক৷ ২০১৮ সালের ২৪ জুন নতুন করে ৫ বছরের জন্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন তিনি৷ দেশটির ইতিহাসে এতো ক্ষমতাবান প্রেসিডেন্ট এর আগে আসেননি৷ শপথ নেয়ার দিন নিজের জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি- একেপির সদস্যদের এর্দোয়ান বলেন, ‘তুরস্ক নতুন যুগে প্রবেশ করেছে’৷
ছবি: picture-alliance/abaca
8 ছবি1 | 8
অন্যদিকে, প্রসিকিউটারের অফিসের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ফ্ল্যাশ হাবর টিভির মালিক মেহমত এমিন গোকটুগের অভিযোগের ভিত্তিতে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এই দুই সাংবাদিককে। অভিযোগকারী যদিও এই মুহূর্তে জেলবন্দি। তার বিরুদ্ধে টাকা তছরুপ এবং খেলাধুলা নিয়ে বেআইনি জুয়া খেলার অভিযোগের বিচার চলছে।
গোকটুগ বলেন, তিমুর এবং মুদার তাকে ভয় দেখিয়ে এবং ব্ল্যাকমেল করে তার চ্যানেলটি হাতাতে চেয়েছিল।
'সরকার বিরোধী স্বরের কারণেই আটক'
অন্যদিকে, রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস বা আরএসএফ-এর পক্ষও থেকে জানানো হয়, ইমামোলুর গ্রেপ্তারি নিয়ে প্রশ্ন করার জেরেই আটক হন ওই দুই সাংবাদিক। আরএসএফ-এর তুরস্কও শাখার প্রতিনিধি এরল ওন্ডেরোগলু একটি বিবৃতিতে বলেন, "সাংবাদিকদের আটক, জিজ্ঞাসাবাদ এবং তল্লাসি কেবলমাত্র তাদের খবরের উৎস জানার জন্যেই করা হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।" আরএসএফ আরো জানায় ১৯ মার্চের উত্তাল পরিস্থিতির পর থেকেই তুরস্কে সাংবাদিক এবং সংবাদ মাধ্যমকে নিশানা করা হচ্ছে।
তিমুর এবং মুরাদকে চার দিন পর্যন্ত আটক রাখা হতে পারে। এখনো কোন আদালতে তোলার তারিখ জানা যায়নি। এরদোয়ান-বিরোধী সংবাদ প্রকাশ করার জন্য এর আগেও আইনি চাপে পরতে হয়েছিল এই দুই সাংবাদিককে।
বৃহস্পতিবার রাতেই কনটেম্পোরারি জার্নালিস্টস অ্যাসোসিয়েশানের পক্ষ থকে 'স্টোরি অফ দ্য ইয়ারের' সম্মান পাওয়ার কথা ছিল তিমুরের।