তুরস্কে এক কুর্দি বিবাহ অনুষ্ঠানে ভয়াবহ আত্মঘাতী হামলার পর এর্দোয়ান সরকার ও কুর্দি জনগোষ্ঠীর মধ্যে উত্তেজনা বাড়ছে৷ আইএস-এর বিরুদ্ধে অভিযোগ সত্ত্বেও এই গোষ্ঠী দায় স্বীকার করেনি৷
বিজ্ঞাপন
হিংসা প্রদর্শনে তথাকথিত ইসলামিক স্টেট কোনো সীমার ধার ধারে না – বার বার তার প্রমাণ পাওয়া গেছে৷ এবার তুরস্কে এক বিবাহ অনুষ্ঠানের উপর হামলা যদি তারাই চালিয়ে থাকে, সে ক্ষেত্রে তাদের নৃশংসতারই আরেক দৃষ্টান্ত পাওয়া গেল৷ আত্মঘাতী হামলাকারীর বয়স নাকি মাত্র ১২ থেকে ১৪৷ কমপক্ষে ৫১ জন নিহত, আহত প্রায় ৯৪৷ হতাহতদের মধ্যেও শিশু-কিশোরদের সংখ্যা নজর কাড়ার মতো৷ অভিযোগ সত্ত্বেও আইএস অবশ্য এখনো এই হামলার দায় স্বীকার করেনি৷
সিরিয়া সীমান্তের কাছে গাজিয়ানটেপ শহরে এক কুর্দি পাড়ায় শনিবার এক বিবাহ অনুষ্ঠান চলছিল৷ মানুষের ভিড়েই হামলাকারী বিস্ফোরণ ঘটায়৷ বর ও কনে আহত অবস্থায় বেঁচে গেলেও দুই পরিবার ও প্রতিবেশীদের অনেকে নিহত হয়েছে৷
হামলার নিন্দার পাশাপাশি তুরস্কের জটিল রাজনৈতিক কাঠামোয় পারস্পরিক দোষারোপের খেলাও শুরু হয়ে গেছে৷ কুর্দিপন্থি রাজনৈতিক দল এইচডিপি রেচেপ তাইয়েপ এর্দোয়ানের সরকারকে আইএস-এর প্রতি নরম মনোভাবকে এই হামলার জন্য দায়ী করেছে৷ বিশেষ করে একাধিক কুর্দি দলের এক জোট সরকারের সঙ্গে আলোচনার পরিকল্পনার ঘোষণা করার ঠিক পরেই এমন হামলার গুরুত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে তারা৷
অনেক পর্যবেক্ষকের মতে, সিরিয়া ও ইরাকে আইএস-এর বিরুদ্ধে সংগ্রামে কুর্দি গোষ্ঠীগুলির জোরালো তৎপরতা ও সাফল্য তুরস্কের সরকারের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ তাছাড়া আইএস-এর বিরুদ্ধে এর্দোয়ান সরকার যথেষ্ট পদক্ষেপ নিচ্ছে না – এমন অভিযোগ বেশ কিছুকাল ধরে শোনা যাচ্ছে৷ ইস্তানবুলে এইচডিপি দলের এক প্রতিবাদের সময় এক বিক্ষোভকারী বলেন, কুর্দি বিবাহ অনুষ্ঠান, বিরোধীদের জমায়েত অথবা আঙ্কারায় যারা শান্তির কথা বলে, তারাই বার বার এমন হামলার লক্ষ্য হচ্ছে৷ শাসক দলের কোনো সমাবেশের উপর এমন হামলা ঘটে না৷
প্রেসিডেন্ট এর্দোয়ান এই হামলার তীব্র নিন্দা করে বলেছেন, ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে তুরস্কের মানুষের মধ্যে বিভাজনের অপচেষ্টা বিফল হবে৷ তিনি সরাসরি আইএস-কে এই হামলার জন্য দায়ী করেন৷ তিনি আরও বলেন, নিষিদ্ধ কুর্দি গোষ্ঠী পিকেকে এবং গ্যুলেন-এর আন্দোলনের সঙ্গে আইএস-এর কোনো তফাত নেই৷
তুরস্কে এই হামলার কড়া নিন্দা করেছে আন্তর্জাতিক মহল৷ জাতিসংঘ ছাড়াও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি সহ অনেক দেশ এই পরিস্থিতিতে তুরস্কের পাশে দাঁড়ানোর অঙ্গীকার করেছে৷ পোপ ফ্রান্সিস নিহতদের আত্মার শান্তির জন্য প্রার্থনা করেন৷
নতুন তুরস্ক গড়ার অঙ্গীকার দিলেন এর্দোয়ান
ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানের পর টানা তিন সপ্তাহ ধরে এর্দোয়ানের পক্ষে ব়্যালির পর, তুরস্কের ৮০টি শহরে গত রবিবার চূড়ান্ত বিক্ষোভের আয়োজন করা হয়৷ আঙ্কারা থেকে জানাচ্ছেন ডিয়াগো কুপোলো৷
ছবি: DW/D. Cupolo
রাজপথে নামার আহ্বান
গতমাসে সেনা অভ্যুত্থানের সময় তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিচেপ তাইয়েপ এর্দোয়ান তাঁর সমর্থকদের রাজপথে নেমে ক্ষমতাসীনদের রক্ষায় সেনাবাহিনীকে হটাতে সহায়তার আহ্বান জানান৷ সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে সত্যিই রাস্তায় নামেন অসংখ্য মানুষ এবং সেনাবাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়৷ এরপর এর্দোয়ান প্রতিরাতে তাঁর সমর্থকদের রাস্তায় থাকতে আহ্বান জানিয়েছিলেন৷
ছবি: DW/D. Cupolo
লাখো মানুষের উপস্থিতি
রবিবার চূড়ান্ত ব়্যালিতে ইস্তানবুলে হাজির ছিলেন ২০ লাখের মতো মানুষ৷ আঙ্কারায় ছিলেন দশ হাজার৷ তুরস্কের মোট ৮০টি শহরে এ সময় বিক্ষোভের আয়োজন করা হয়৷ এর্দোয়ানের একেপি হচ্ছে প্রথম দল, যেটি ইসলামিক মনোভাব প্রদর্শন সত্ত্বেও একটি সেনা অভ্যুত্থান ঠেকাতে পেরেছে৷ এর্দোয়ানের সমর্থকরা একে দেশটির ইতিহাসরচনাকারী সেনাবাহিনী এবং ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের বিপরীতে বড় জয় মনে করছে৷
ছবি: DW/D. Cupolo
এক নতুন তুরস্ক নিয়ে আশাবাদ
ইস্তানবুল থেকে দেয়া বক্তব্যে এর্দোয়ান নতুন এক তুরস্ক গড়ার প্রতিজ্ঞা করেছেন এবং তাঁর সমর্থকরাও এ ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন৷ আঙ্কারার রিয়েল স্টেট ব্যবসায়ী লালে আলিচি সেনা অভ্যুত্থানের পর থেকে আয়োজিত প্রতিটি ব়্যালিতে অংশ নিয়েছেন৷ তিনি জানান, অভ্যুত্থানে জড়িতদের শাস্তি দেয়ার পর তুরস্ক দ্রুত উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যাবে, কেননা তখন সরকারকে বাধা দেয়ার আর কেউ থাকবে না৷
ছবি: DW/D. Cupolo
‘‘আমরা বড় শক্তি হবো’’
ইন্টেরিয়র ডিজাইনার আতালে জানান, তিনি এর্দোয়ানকে সমর্থন দিয়েছেন কেননা তিনি তুরস্ককে বিশ্বমঞ্চে নিয়ে গেছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘এর্দোয়ান বিশ্বকে জানিয়েছেন, আমরাও আছি এবং শীঘ্রই বড় শক্তিতে পরিণত হবো৷’’
ছবি: DW/D. Cupolo
এইচডিপিকে নেয়া হয়নি
যদিও রবিবারের ব়্যালিতে অংশ নেয়া অনেকে দাবি করেছেন, গণতন্ত্রকে বাঁচাতে রাস্তায় নেমেছেন তারা, তাসত্ত্বেও বিরোধীরা জানিয়েছেন, সেদেশের তৃতীয়-বৃহত্তম রাজনৈতিক দল কুর্দিপন্থি ডেমোক্রেটিক পার্টি (এইচডিপি)-কে ব়্যালিতে যোগ দিতে দেয়া হয়নি৷ এক কুর্দ এই বিষয়ে বলেন, ‘‘কুর্দ হিসেবে আমি সেখানে যেতে পারি না, কেননা আমি নিরাপদ বোধ করছি না৷’’
ছবি: DW/D. Cupolo
সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমের উত্থান
জাতীয় জরুরি অবস্থায় সাধারণত ব্লক করা থাকলেও ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানের পর তুরস্কে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম বেশ গুরুত্ব পাচ্ছে৷ এর্দোয়ানের ‘ফেসটাইম’ বক্তব্য থেকে বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে সহিংসতা দেখানো ‘পেরিসকোপ’ ভিডিও অবধি সবকিছুই অনেক গুরুত্ব পেয়েছে৷ বিরোধীরা অবশ্য বলছেন, সরকার নিজেদের জন্য লাভজনক মনে করায় সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে বাধা সৃষ্টির কোনো উদ্যোগ নেয়নি৷