তুরস্কে বাল্যবিবাহের শিকার মেয়েদের নির্যাতন নিয়ে চলচ্চিত্র
২২ অক্টোবর ২০১৬
তুরস্কে বাল্যবিবাহের শিকার মেয়েরা প্রায়ই ধর্ষণের শিকার হন৷ তাদের পেটানোও হয়, এমনকি ‘সতীত্বের পরীক্ষায়'ও উত্তীর্ণ হতে হয়৷ মুসলিম প্রধান দেশটিতে বাল্যবিবাহ নিয়ে নির্মিত এক তথ্যচিত্রের পরিচালক জানিয়েছেন এসব তথ্য৷
বিজ্ঞাপন
‘গ্রোয়িং আপ ম্যারিড' তথ্যচিত্রটি আগামী ৩০ অক্টোবর লন্ডনে মুক্তি পাবে৷ এতে তুরস্কের চার নারীর উপর বাল্যবিবাহের প্রভাব তুলে ধরা হয়েছে, যাদের বাড়ি তুরস্কের পশ্চিমাঞ্চলে৷ ছবিটির পরিচালক আইলেম আতাকাভ থমসন রয়টার্ষ ফাউন্ডেশনকে বলেছেন, ‘‘তাদের কথা শোনার পরে আমি নিজের কাছে প্রশ্ন করেছিলাম, ‘তুমি কিভাবে এখনো বেঁচে আছো?'৷''
চীন ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে প্রতি তিনজন মেয়ের একজনের ১৮ পেরুনোর আগেই বিয়ে হয়ে যায়৷ ১৫ পেরুনোর আগে বিয়ে হয়ে যাওয়ার হার প্রতি নয়জনে একজন, জানিয়েছে জাতিসংঘ৷
বাল্যবিবাহ বিরোধী প্রচারকরা জানান, বাল্যবিবাহের শিকার মেয়েরা ছোটবেলাটা উপভোগ করেত পারে না এবং তাদের শিক্ষাজীবনও অনেক সময় আগেভাগে শেষ হয়ে যায়৷ তারা বাড়িতে নির্যাতনের এবং যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে৷ আর নিজেদের দেহ তৈরি হওয়ার আগেই গর্ভধারণ করে অনেক মেয়ে মৃত্যু বা মারাত্মক শারীরিক ক্ষতির ঝুঁকিতে থাকে৷
‘‘গ্রোয়িং আপ ম্যারিড'' তথ্যচিত্রে অংশ নেয়া নারীরা তাদের জীবনের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন৷ তাদের সকলের বিয়ে হয়েছে ১৪ থেকে ১৭ বছর বয়সের মধ্যে৷ বর্তমানে তাদের বয়স ৩০ থেকে পঞ্চাশের মধ্যে৷ ছবিতে এক নারী বাল্যবিবাহের অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে বলেন, ‘‘এক রাতে তারা আমাকে বিয়ের গাউন পরিয়ে অপরিচিত এক জায়গায় নিয়ে যায়৷ তারপর থেকে আমি চুপ আছি৷''
বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের যে ছবি আলোড়ন তুলেছে
বাংলাদেশে বাল্যবিবাহ এখনো এক বড় সমস্যা৷ দেশটিতে ৬৫ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হচ্ছে আঠারো বছর বয়স পার হওয়ার আগেই৷ বার্তা সংস্থা গ্যাটি ইমেজেস-এর এক ফটোগ্রাফার তাঁর ক্যামেরায় ধারণ করছেন এমনই একটি বাল্যবিবাহের কিছু ছবি৷
ছবি: Getty Images/A. Joyce
নওশিনের বিয়ে
নওশিন আক্তারের বয়স ১৫ বছর৷ বাবার বাড়ি বাংলাদেশের মানিকগঞ্জে৷ বিয়ের দিনও সে ছুটে বেড়াচ্ছিল পড়শিদের বাড়ি বাড়ি৷ সেখান থেকেই ধরে এনে বিয়ের পিড়িতে বসানো হয় তাকে৷ তার বিয়ের, আইনি দৃষ্টিতে যা অবৈধ, কিছু ছবি থাকলো এই ছবিঘরে৷
ছবি: Getty Images/A. Joyce
বিয়ে বাড়িতে উৎসব
আগস্টের ২০ তারিখে বিয়ে হয় নওশিনের৷ নিজে বিয়ের অর্থ সে তেমন না বুঝলেও, পাড়াপড়শির এই বিয়ে নিয়ে আগ্রহের কমতি ছিল না৷ বিয়ের দিন উৎসবের এই ছবি জানান দিচ্ছে একটি অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোরের বয়স নিয়ে তাঁদের কোনো ভাবনা নেই৷
ছবি: Getty Images/A. Joyce
নওশিনের গোসল
বিয়ের দিন প্রকাশ্যেই গোসল করানো হয় নওশিন আক্তারকে৷ বাল্যবিবাহের জন্য তাকে প্রস্তুত করার অংশ এই গোসল৷ অনেকের সঙ্গে এএফপি-র আলোকচিত্রিও দেখেছেন সেই আচার৷
ছবি: Getty Images/A. Joyce
বিউটি পার্লারে নওশিন
বিয়ের জন্য সাজাতে নওশিনকে নেয়া হয়েছে বিউটি পার্লারে৷ বাংলাদেশের আনাচেকানাচে এ রকম পার্লারের সংখ্যা অনেক৷ ছবিতে কাপড় পরার সময় অপর এক নারীকে দেখছে নওশিন৷
ছবি: Getty Images/A. Joyce
কনের মেকআপ
বিয়ের সাজে সাজানো হচ্ছে নওশিনকে৷ বাংলাদেশে কনেকে বেশ রংচংয়ে মেকআপে সাজানো হয়৷ অনেক সময় চেহারার রং ফর্সা করার চেষ্টা করা হয় জোর করে, যা অনেকসময় দেখতে কিছুটা দৃষ্টিকটু হলেও ঐতিহাসিকভাবে চলে আসছে৷
ছবি: Getty Images/A. Joyce
গহনা ছাড়া কি বিয়ে হয়?
কনে নওশিনকে গহনা পড়িয়ে দিচ্ছেন তার আত্মীয়রা৷ বাংলাদেশে বিয়েতে সোনার গহনা এক অপরিহার্য উপাদান৷ কনের পরিবারের আর্থিক অবস্থা যেমনই হোক, সোনাদানা ছাড়া বিয়ে, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে একরকম ভাবাই যায় না৷
ছবি: Getty Images/A. Joyce
জোর করে বিছানায় নেয়া হচ্ছে নওশিনকে
নওশিনকে তার এক আত্মীয় জোর করে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন একটি বিছানায়, যেখানে তার ছবি তোলা হবে৷ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের হিসেব অনুযায়ী, বাংলাদেশে গড়ে ২৯ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয় তাদের বয়স ১৫ পার হওয়ার আগে৷
ছবি: Getty Images/A. Joyce
ভিডিও-র জন্য ‘পোজ’
ভিডিও-র জন্য পোজ দিচ্ছে নওশিন আক্তার৷ তার বিয়ের মুহূর্তগুলো এভাবেই ক্যামেরাবন্দি করেছেন ভাড়া করা আলোকচিত্রিরা৷
ছবি: Getty Images/A. Joyce
৩২ বছর বয়সি বর
নওশিনের বরের নাম মোহাম্মদ হাসামুর রহমান, বয়স ৩২ বছর৷ বিয়ের সন্ধ্যায় অপ্রাপ্তবয়স্ক কনের সঙ্গে ছবির জন্য পোজ দিয়েছেন রহমান৷ এএফপি-র একজন বিদেশি আলোকচিত্রি সেই বিয়েতে উপস্থিত হতে পারলেও বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পারেনি গিয়ে বিয়েটি বন্ধ করতে৷
ছবি: Getty Images/A. Joyce
শ্বশুর বাড়ির উদ্দেশ্যে নওশিন
বিয়ে শেষে শ্বশুর বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছে ১৫ বছর বয়সি নওশিন৷ পরিবারের সদস্যরা তাকে গাড়িতে তুলে দিচ্ছেন৷ বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের এ সব ছবি গোটা বিশ্বের আলোড়ন তুলেছে৷
ছবি: Getty Images/A. Joyce
10 ছবি1 | 10
আরেক নারী জানিয়েছেন, কিভাবে তিনি কখন রাত হবে ভেবেই আতঙ্কিত হয়ে পড়তেন, কেননা রাতের বেলা তাঁর স্বামী তাঁকে টেনে হেঁচড়ে বিছানায় নিয়ে যেতো এবং তাঁর চুল টেনে টেনে তুলে বিকৃত আনন্দ পেতো৷ তিনি বলেন, ‘‘ভোরবেলা আমি মেঝে আর বিছানায় পরে থাকা চুলগুলো তুলতাম৷ এই নির্যাতন থেকে বাঁচতে একসময় আমি চুল কেটে ছোট করে ফেলি যাতে যন্ত্রণা কম হয়৷''
লন্ডনের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আতাকাভ জানিয়েছেন, বাল্যবিবাহের পর মেয়েদের দুর্বিষহ জীবনের দিকে নজর দিয়েছেন তিনি৷ ‘‘তুরস্কের ঐতিহ্য হচ্ছে বিয়ের রাতে স্বামীর সঙ্গে সহবাসের আগ পর্যন্ত একটি মেয়েকে কুমারী থাকতে হবে,'' বলেন তিনি৷
‘‘বরের পরিবারের সদস্যরা বাসর রাতের পর বিছানার চাদরে রক্ত লেগে আছে কিনা পরীক্ষা করে দেখে,'' যোগ করেন তিনি৷
আতাকাভ জানান, তাঁর চলচ্চিত্রে অংশ নেয়া এক নারীর জীবন দুর্বিষহ হয়ে গিয়েছিল, কেননা বাসর রাতে যৌন সঙ্গমের সময় তাঁর রক্তপাত হয়নি৷ তিনি বলেন, ‘‘তাঁর স্বামী তখন পরিবারের সদস্যদের চিৎকার করে বলেছিল, তোমরা আমার জন্য একজন নারী এনেছ, মেয়ে নয়৷'' পরবর্তীতে তাঁকে পাশের গ্রামে নিয়ে যাওয়া হয় সতীত্ব পরীক্ষা করতে৷
তথ্যচিত্রে অংশ নেয়া নারীদের তিনজনের ইতোমধ্যে বিচ্ছেদ হয়ে গেছে৷ একজন পুনরায় বিয়ে করেছেন৷ তবে আগের ঘরের মেয়েকে তাঁর সাবেক স্বামী দেখতে দেয় না৷
উল্লেখ্য, ইউরোপের যেসব দেশে বাল্যবিবাহ বেশি সেই দেশগুলোর মধ্যে তুরস্ক অন্যতম৷ সেদেশে ১৮ বছর বয়স পেরুনোর আগেই ১৫ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়ে যায়৷ তুরস্কে বিয়ের সর্বনিম্ন বয়স ১৭ বছর, তবে আদালতের সম্মতিতে ১৬ বছরেও বিয়ে সম্ভব৷
এআই/ এসিবি (থমসন রয়টার্স ফাউন্ডেশন)
মেয়েদের জন্য সেরা দেশ
২০১৬ সালে ‘সেভ দ্য চিলড্রেন ফান্ড’ ১৪৪টি দেশে মেয়েদের পরিস্থিতি বিচার করে একটি ‘গার্লস অপরচুনিটি ইনডেক্স’ তৈরি করে৷ সূচকে ছিল বাল্যবিবাহ, কিশোরী মাতৃত্ব, প্রসূতিমৃত্যু, মহিলা সাংসদদের অনুপাত ও স্কুলের পড়াশুনা৷
ছবি: picture alliance / empics
তালিকার শীর্ষে সুইডেন
তাতে সম্ভবত কেউই বিশেষ আশ্চর্য হবেন না৷ মেয়েদের সুযোগ-সম্ভাবনার তালিকা যেন শুরুই হচ্ছে ইউরোপের উত্তরে সুইডেন, ফিনল্যান্ড, নরওয়ে - সেখান থেকে নেমে আসছে নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, ডেনমার্ক হয়ে স্লোভেনিয়ায়...
ছবি: Getty Images/D. Ramos
১২ নম্বরে জার্মানি
স্লোভেনিয়ার পর পর্তুগাল, সুইজারল্যান্ড, ইটালি, স্পেন হয়ে তবে জার্মানি৷ জার্মানির পরপরই অস্ট্রিয়া ও লুক্সেমবুর্গ৷ তারপর আসছে...
ছবি: Reuters/M. Dalder
১৫ নম্বরে ব্রিটেন
‘স্পাইস গার্লস’দের দেশ ব্রিটেনে যে মেয়েরা বেশি সুযোগ পাবে, সেটা ধরে নেওয়াটা বোধহয় ভুল হতো, কেননা ‘সেভ দ্য চিলড্রেন’-এর ইনডেক্সে যে ইন্ডিকেটরগুলি ব্যবহার করা হয়েছে, সেগুলি সামগ্রিক৷
ছবি: picture alliance / empics
২১ নম্বরে অস্ট্রেলিয়া
ইউএনডিপি’র হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্সে এই দেশ কিন্তু দ্বিতীয় স্থানে৷ ‘গার্লস অপরচুনিটি ইনডেক্স’-এ অস্ট্রেলিয়ার এতটা নেমে যাওয়ার কারণ মহিলা সাংসদদের স্বল্পতা ও কিশোরী মাতৃত্বের অপেক্ষাকৃত উচ্চ হার৷ যুক্তরাজ্য (১৫) বা ক্যানাডার (১৯) স্থানও মূলত ঐ দু’টি কারণে৷
ছবি: Getty Images/S. Barbour
৩২ নম্বরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন তালিকায় যে দেশ অষ্টম, তার স্থান মেয়েদের সুযোগ-সম্ভাবনার বিচারে কাজাখস্তান (৩০) ও আলজেরিয়া (৩১)-এর চেয়েও নীচে৷ এর কারণ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কিশোরী মাতৃত্ব ও প্রসূতি মৃত্যুর হার অনুরূপ ধনী দেশগুলির তুলনায় বেশি৷ ২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র্রে প্রতি এক লক্ষ শিশুর জন্মে ১৪ জন প্রসূতি মারা যান, যেখানে পোল্যান্ড, গ্রিস বা ফিনল্যান্ডে প্রতি এক লাখ শিশুর জন্মে তিনজন করে মা প্রাণ হারান৷
ছবি: picture-alliance/dpa/A. Rain
৬০ নম্বরে শ্রীলঙ্কা
উপমহাদেশের দিকে নজর দিলে, সবচেয়ে ভালো ফলাফল করেছে শ্রীলঙ্কা...
ছবি: Messe Berlin
৮৮ নম্বরে পাকিস্তান
এটাকেও চমক বলা চলে...
ছবি: Mirza Tours
৯০ নম্বরে ভারত
এটাকে চমক বলা চলে না...
ছবি: Getty Images/AFP/N. Seelam
১১১ নম্বরে বাংলাদেশ
বাদবাকি উপমহাদেশের মতোই, এখানেও অনেক কিছু করা বাকি৷
ছবি: N.Seelam/AFP/GettyImages
১৪৪ নম্বরে নাইজার
বিশ্বের দরিদ্রতম দেশগুলির মধ্যে পড়ে৷ নাইজারের মতো দেশে দারিদ্র্যকেই মেয়েদের দুরবস্থার মূল কারণ বলে ধরে নেওয়া চলে৷