ভূমধ্যসাগর জলসীমানা নিয়ে তুরস্ক-গ্রিসের দ্বন্দ্ব কি কাটতে যাচ্ছে? সোমবার দুই দেশের বৈঠকে সেই সম্ভাবনাই উঁকি দিচ্ছে৷ এর মাধ্যমে ইউরোপের সাথেও তুরস্কের সম্পর্ক বদলের সূচনা হতে পারে৷
বিজ্ঞাপন
দুই দেশের আলোচনায় পাঁচ বছরের অচলাবস্থার পর সোমবার বৈঠকে বসবে গ্রিস ও তুরস্ক৷ এই বিষয়ে দুই দেশের কূটনৈতিক পর্যায় থেকেই ইতিবাচক মনোভাবের আভাস মিলছে৷ যেমন, গ্রিসের পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিকোস ডেনডিয়াস দেশটির স্থানীয় গণমাধ্যমকে দেয়া সাক্ষাৎকারে, বৈঠক নিয়ে অ্যাথেন্সের দিক থেকে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির কথা নিশ্চিত করেছেন৷ তার আশা তুরস্কও একই মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসবে৷ অন্যদিকে বিতর্কিত জলসীমানায় গ্যাস অনুসন্ধান থামিয়ে আলোচনার পথটি প্রশস্ত করেছে তুরস্কও৷ এই পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে ইউরোপীয় নেতারা সামনের দিনে তুরস্ক সফরে যাওয়ার সম্ভাবনাও তৈরি হচ্ছে৷
অবশ্য দুই পক্ষ থেকে যতই রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রকাশ পাক না কেন শরণার্থী, মানবাধিকার, জলসীমানা ও বিভিন্ন জায়গায় সামরিক হস্তক্ষেপসহ বিস্তর দ্বন্দ্ব নিরসনটা একেবারে সহজ হবে না৷ কূটনীতিকরাও মনে করছেন শুধু কথায় নয় সম্পর্কোন্নয়নে তুরস্ককে বিতর্কিত জলসীমা থেকে জরিপ জাহাজ সরিয়ে নেয়াসহ আরো কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে, যে কারণে আঙ্কারার উপর অবরোধ আরোপের ব্যাপারে ইউরোপের কয়কেটি দেশের উপর চাপও রয়েছে৷ এসব বিষয়ে আগামী মার্চে ইউরোপীয় নেতাদের একটি বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে৷
তুরস্কের রেচেপ তাইয়েপ এর্দোয়ান কে?
ইসলামপন্থি তরুণ অ্যাক্টিভিস্ট থেকে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট– রাজনীতিতে নিজের ক্যারিয়ার ভালোভাবেই গড়েছেন রেচেপ তাইয়েপ এর্দোয়ান৷ তবে রাজনৈতিক জীবনে বহুবার বিতর্কে জড়িয়েছেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/E. Morenatti
এর্দোয়ানের উত্থান
তুরস্কে এবং বিদেশে রেচেপ তাইয়েপ এর্দোয়ান সম্পর্কে নানা ধরনের মতামত রয়েছে৷ তাঁকে নব্য-অটোমান ‘সুলতান’ হিসেবে যেমন বিবেচনা করা হয়, তেমনি কারো কারো চোখে তিনি একজন স্বৈরাচারী নেতা৷ রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকেই ইসলামপন্থিদের বিভিন্ন দাবিদাওয়ার ব্যাপারে সচেতন ছিলেন তিনি৷ পাশাপাশি ন্যাটোতে তাঁর নেতৃত্বে বড় ধরনের অবদান রাখছে তুরস্ক৷ এর্দোয়ানের উত্থান নিয়ে এই ছবিঘর৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/E. Morenatti
ইস্তানবুলের কারাবন্দি মেয়র
তুরস্কে ইসলামপন্থিদের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত দল ওয়েলফেয়ার পার্টিতে নিজের অবস্থান দ্রুতই পাকাপোক্ত করেছিলেন এর্দোয়ান৷ ১৯৯৪ সালে তিনি সেই দল থেকে ইস্তানবুলের মেয়রও নির্বাচিত হন৷ কিন্তু এর্দোয়ান মেয়র হওয়ার চার বছরের মাথায় সেই দলটিকে সে দেশের সরকার তুরস্কের ধর্মনিরপেক্ষ নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় ঘোষণা দিয়ে নিষিদ্ধ করে৷ এরপর জনসমক্ষে বিতর্কিত কবিতা আবৃত্তির দায়ে জেলে যান এর্দোয়ান৷ চার মাস জেল খাটেন৷
তুরস্কের একেপি পার্টির সহপ্রতিষ্ঠাতা এর্দোয়ান৷ ২০০২ সালের নির্বাচনে দলটি সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করে৷ আর ২০০৩ সালে তিনি প্রধানমন্ত্রী হন৷ দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম বছরগুলোতে এর্দোয়ান দেশবাসীকে সামাজিক সুযোগ-সুবিধা প্রদান, অর্থনীতির উন্নয়ন এবং বিভিন্ন গণতান্ত্রিক সংস্কারের দিকে মনোযোগী হন৷ তবে কেউ কেউ এটাও মনে করেন যে, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি রাজনীতিতে ধর্মের মিশ্রণ ঘটানোয় ভূমিকা রেখেছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/B. Ozbilici
ইসলামপন্থিদের স্বার্থ রক্ষা
যদিও তুরস্কের সংবিধান দেশটির ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থানকে সমর্থন করে, তারপরও এর্দোয়ান কট্টর ইসলামপন্থিদের মন জয়ের নানা চেষ্টা করেছেন৷ তুরস্কের এই শীর্ষনেতা একসময় বলেছিলেন যে, তাঁর লক্ষ্যগুলোর একটি হচ্ছে এক ‘ধার্মিক প্রজন্ম’ গড়ে তোলা৷ এর্দোয়ানের সমর্থকরা এই লক্ষ্যের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন, কেননা, তাঁরা মনে করেন, ধর্মচর্চা করা মুসলমানরা তুরস্কে নানাভাবে বঞ্চিত হচ্ছিল৷
ছবি: picture-alliance/AA/C. Ozdel
ক্যু থেকে রক্ষা
২০১৬ সালের জুলাইয়ে এর্দোয়ানের বিরুদ্ধে সে দেশের সেনাবাহিনীর এক অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়৷ তবে সেই ঘটনায় দু’শ’র বেশি বেসামরিক নাগরিক এবং সেনা সদস্য নিহত হন৷ সেই ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানের পর এর্দোয়ান আরো ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠেন এবং জরুরি অবস্থা ঘোষণার পাশাপাশি সেনাবাহিনীতে ‘শুদ্ধি অভিযান’ শুরু করেন৷
ছবি: picture-alliance/AA/K. Ozer
দেশজুড়ে অভিযান
ব্যর্থ সেই সেনা অভ্যুত্থানের পর দেশজুড়ে অভিযান পরিচালনা করে তুর্কি কর্তৃপক্ষ৷ এতে সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিচার ব্যবস্থা, স্কুল এবং গণমাধ্যম থেকে পঞ্চাশ হাজারের বেশি মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ এর্দোয়ান সেই সেনা অভ্যুত্থানের পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাসিত ধর্মীয় নেতা এবং তাঁর প্রাক্তন সঙ্গী ফেতুল্লাহ গুলেনের হাত রয়েছে বলে দাবি করেন৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/E. Gurel
বিভেদ সৃষ্টিকারী রাজনীতিবিদ
যদিও নিজের দেশে এবং বিদেশে বসবাসরত তুর্কিদের একটি বড় অংশের সমর্থন রয়েছে এর্দোয়ানের প্রতি, তা সত্ত্বেও তিনি তাঁর কঠোর নীতি এবং কুর্দিদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালানোয় কড়া সমালোচনার মুখে পড়েছেন৷ চলতি বছরের জানুয়ারিতে আফরিনে মারাত্মক আক্রমণ পরিচালনা করেন এর্দোয়ান, যার সমালোচনা করে মানবাধিকা সংস্থাগুলো৷
ছবি: picture- alliance/ZUMAPRESS/Brais G. Rouco
ব্যাপক ক্ষমতাধর
২০১৭ সালে এক গণভোটের মাধ্যমে দেশটির সংবিধান সংশোধন করা হয়৷ সংসদীয় গণতন্ত্র থেকে রাষ্ট্রপতি শাসিত প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয় তুরস্ক৷ ২০১৮ সালের ২৪ জুন নতুন করে ৫ বছরের জন্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন তিনি৷ দেশটির ইতিহাসে এতো ক্ষমতাবান প্রেসিডেন্ট এর আগে আসেননি৷ শপথ নেয়ার দিন নিজের জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি- একেপির সদস্যদের এর্দোয়ান বলেন, ‘তুরস্ক নতুন যুগে প্রবেশ করেছে’৷
ছবি: picture-alliance/abaca
8 ছবি1 | 8
তবে তুরস্ক-গ্রিসের বৈঠক নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্র নীতি বিষয়ক প্রধান জোসেপ বরেল একটি ‘সম্ভাবনার দ্বার’ দেখতে পাচ্ছেন৷ যদিও এজন্য আঙ্কারাকে ‘বিরোধের পথ’ এড়িয়ে আলোচনার পথে হাঁটতে হবে বলে বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে জানিয়েছেন তিনি৷
তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত চাভুসোগলু গত সপ্তাহে বেলজিয়াম সফরে আসেন৷ তিনি একে আঙ্কারা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে ‘ইতিবাচক পরিবেশ’ বজায় রাখার মিশন হিসেবে অভিহিত করেছেন৷ আগামী দুই মাসের মধ্যে নিয়ইয়র্কে ভূমধ্যসাগরে জলসীমানা নিয়ে বিরোধ থাকা সাইপ্রাসের সঙ্গেও বৈঠক হবে বলে শুক্রবার জানান তিনি৷
তবে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এর্দোয়ানের মনোভাব পরিবর্তনের পেছনে অর্থনৈতিক কারণও দেখছেন অনেকে৷ কোভিডের কারণে দেশটির অর্থনীতি মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত হয়েছে৷ তার উপর আন্তর্জাতিকভাবে নানা টানাপোড়েনও সেখানে প্রভাব ফেলছে৷ বাণিজ্যিক কারণেও তাই সবচেয়ে বড় অংশীদার ইউরোপের সঙ্গে দেশটির সম্পর্ক ভালো রাখা দরকার৷ অনেকে মনে করেন সেই প্রেক্ষাপটেই নভেম্বরে বিচার বিভাগ পুনর্গঠনেরও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এর্দোয়ান৷ ২০১৬ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর দেশটিতে আইনের শাসন নিয়ে বরাবরই সমালোচনা করে আসছিল ইউরোপ৷
এফএস/এডিকে (রয়টার্স)
ইস্তাম্বুল কতটা ইউরোপীয়?
তুরস্কের ইস্তাম্বুলের একটি অংশ পড়েছে ইউরোপে, বাকিটা এশিয়ায়৷ কিন্তু আসলে ঠিক কতটা ইউরোপীয় এই শহর?
ছবি: Rena Effendi
সবচেয়ে বিখ্যাত
দুটি মহাদেশের ছোঁয়া পাওয়া বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত শহর তুরস্কের ইস্তাম্বুল৷ সেখানে ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিকতা আর ধর্মনিরপেক্ষ লাইফস্টাইলের সঙ্গে ধর্মের যে সংঘাত সেটি বোধ হয় আর অন্য কোনো শহরে পাওয়া যাবে না৷ অনেকে মনে করেন, ঠিক এ কারণেই ইস্তাম্বুল এত আকর্ষণীয়৷
ছবি: Rena Effendi
ইতিহাস
ইস্তাম্বুলের ইতিহাস ২,৬০০ বছরের পুরনো৷ পার্সিয়ান, গ্রিক, রোমান, অটোমান– সবাই বিভিন্ন সময়ে এই শহর নিয়ন্ত্রণ করেছে৷ ফলে তার নামও একেক সময় একেকরকম ছিল৷ এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত নাম বোধহয় কনসট্যান্টিনোপল৷ ১৯৩০ সালে শহরটির নাম হয় ইস্তাম্বুল৷
ছবি: Rena Effendi
বসফরাস পাড়ি
ইস্তাম্বুলের ইউরোপ অংশের কারাকয় আর এশিয়ার কাদিকয়ের মধ্যে আছে বসফরাস প্রণালী৷ প্রতিদিন ফেরিতে করে হাজার হাজার মানুষ এক পার থেকে আরেক পারে যায়৷ সময় লাগে ২০ মিনিট৷
ছবি: Rena Effendi
গালাতা সেতু
ইস্তাম্বুলের একটি বিখ্যাত সেতু৷ সেখানে দাঁড়িয়ে নৌকা চলাচল দেখা যায়৷ শহরের অনেকে সেখানে যান মাছ ধরতে৷ আর আছেন খুচরা বিক্রেতারা৷
ছবি: Rena Effendi
নতুন মসজিদ
২০১৯ সালে শহরের বিখ্যাত তাকসিম চত্বরের কাছে নতুন একটি মসজিদ নির্মাণ করা হয়৷ সমালোচকরা বলছেন, এর মাধ্যমে তুর্কি প্রেসিডেন্ট রেচেপ তাইয়্যেপ এর্দোয়ান চত্বরটিকে একটি নতুন পরিচয় দিতে চাইছেন৷ সেটি হচ্ছে, ধর্মনিরপেক্ষ ও ইউরোপীয় পরিচয়ের পরিবর্তে রক্ষণশীল ও নিউ-অটোমান পরিচয়৷
ছবি: Rena Effendi
ধর্মপ্রাণদের এলাকা
ইস্তাম্বুলের ফাতিহ এলাকাটি ইউরোপীয় অংশ পড়েছে৷ তুলনামূলকভাবে যাঁরা বেশি রক্ষণশীল, তাঁরা সেখানে বাস করেন৷ অনেকে ফাতিহকে ‘ধর্মপ্রাণদের শহর’ বলে ডাকেন৷ তুর্কি প্রেসিডেন্টের একেপি দলের অনেক সমর্থক আছেন সেখানে৷
ছবি: Rena Effendi
ছোট্ট সিরিয়া
সাম্প্রতিক সময় ফাতিহতে অনেক সিরীয় বসবাস শুরু হয়েছে৷ যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশ থেকে পালিয়ে অনেক সিরীয় নাগরিক ফাতিহতে আশ্রয় নিয়েছেন৷ তুরস্কের সরকার এই সিরীয়দের নাগরিকত্ব দেয়ার অঙ্গীকার করেছে৷ সমালোচকরা বলছেন, এটি ভোটার বাড়ানোর একটি উদ্যোগ মাত্র৷
ছবি: Rena Effendi
নাইটলাইফ
রাতের বেলায় পার্টি কিংবা কিছু পানীয় পান করতে চাইলে যেতে হবে ইস্তাম্বুলের কাদিকয় এলাকায়৷ সেটি পড়েছে শহরের এশীয় অংশে৷
ছবি: Rena Effendi
পরিবর্তন
শহরের গালাতা এলাকার একটি ডিজাইনার স্টোরে কাজ করেন আয়সেগুল সারাকোগলু৷ এলাকাটি পর্যটকদের প্রিয় স্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম৷ তবে ইদানীং ইউরোপীয় পর্যটকদের সংখ্যা কমেছে বলে জানান তিনি৷ এখন শুধু আরব পর্যটকরা সেখানে যাচ্ছেন৷ তাঁর আশা, শিগগিরই এই অবস্থার পরিবর্তন হবে৷