তুরস্কের ইনচিরলিক বিমান ঘাঁটি থেকে সব সেনা প্রত্যাহার করে নিয়েছে জার্মানি৷ তুরস্ক জার্মানির সাংসদদের সেখানে অবস্থানরত জার্মান সেনাদের সঙ্গে নিয়মিত সাক্ষাতের অনুমতি না দেয়ায় এই ব্যবস্থা নিয়েছে দেশটি৷
বিজ্ঞাপন
জার্মান সেনারা এখন জর্ডানে একটি ঘাঁটিতে অবস্থান নিয়েছে৷
জার্মান সেনাবাহিনীর ভারপ্রাপ্ত কমান্ডার স্টেফেন ক্লাইনহেয়ার বুধবার জানিয়েছেন যে, তুরস্ক থেকে জার্মানির পর্যবেক্ষক এবং তেলবাহী বিমান জর্ডানের আল-আসরাক বিমান ঘাঁটিতে সরিয়ে নেয়ার কাজটি নজিরবিহীন এবং বড় দায়িত্ব ছিল৷
জার্মান সেনাবাহিনীর যত কেলেঙ্কারি
জার্মান প্রতিরক্ষামন্ত্রীর মতে, ২০১৭ সাল ভয়ঙ্কর, বিভৎস, ভয়াবহ এবং খারাপ বছর৷ নিজের সেনাবাহিনীকে সমর্থন না করে বরং তাদের কেলেঙ্কারি তুলে ধরে ক্ষোভের মুখে পড়েছেন তিনি৷ জেনে নিন জার্মান সেনাবাহিনীর কেলেঙ্কারির কথা৷
ছবি: picture alliance/akg-images
এক ভুয়া শরণার্থী
সিরীয় শরণার্থী সেজে এক জার্মান সেনা কর্মকর্তা সন্ত্রাসী হামলা চালানোর পরিকল্পনা করেছিল৷ সমান্তরাল এক দ্বিতীয় জীবন শুরু করেছিলেন ফ্রাংকো৷ ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে সিরীয় শরণার্থী হিসেবে নথিভুক্ত হন তিনি৷ তার লক্ষ্য ছিল শরণার্থীদের উপর হামলার দোষ চাপানো৷ ২০১৪ সাল থেকেই ফ্রাংকো’র ডানপন্থি আচরণের কথা জানতেন সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা৷ এাই ফ্রাংকো ধরা পড়ার থেকে জার্মান সেনাবাহিনিকে শুরু হয় বিতর্ক৷
ছবি: picture-alliance/dpa/F. Rumpenhorst
বাড রাইশেনহাল পর্বতে রেঞ্জার ইউনিটে হয়রানি
ডানপন্থি সন্ত্রাসী আচরণের অভিযোগ যাচাইয়ের জন্য সেনাবাহিনী বর্তমানে ২৭৫ টি মামলার তদন্ত করছে৷ চলতি বছরের মার্চে জনগণ একজন ল্যান্স করপোরালের কথা জানতে পারেন, যিনি কয়েক মাস ধরে বাভেরিয়া পর্বতের রেঞ্জার ইউনিটে হয়রানির শিকার হয়েছেন৷ নির্যাতিত ব্যক্তি জানিয়েছেন, ২০১৫ এবং ২০১৬ সালে তাকে হত্যার হুমকি দিয়ে যৌন নীপিড়ন করা হয়েছে৷ এ ঘটনার জন্য ১৪ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/S. Hoppe
নারীদের পোল ড্যান্সে বাধ্য করা
প্রতিরক্ষামন্ত্রী সবচেয়ে বড় যে কেলেঙ্কারির কথা বলেছেন তাহলো, ফুলেনডর্ফে স্টাওফের সেনাঘাঁটির ভয়াবহ ঘটনা৷ জানুয়ারিতে সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত সেনা সদস্যদের নগ্ন করা ও যৌনতা প্রকাশ পায় এমন আচরণ করতে বাধ্য করেছিলেন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা, সেগুলো ভিডিও করা হয়েছিল৷ সদ্য নিয়োগ পাওয়া নারীদের ‘এনট্র্যান্স পরীক্ষা’র অংশ হিসেবে পোল ড্যান্সে বাধ্য করা হয়েছিল৷ একারণে সেনাবাহিনীর শীর্ষ প্রশিক্ষক কমান্ডারকে বরখাস্ত করা হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/T. Warnack
ডানপন্থি সন্ত্রাসবাদের অনেক ঘটনার তদন্ত চলছে
জার্মান সেনাবাহিনীর কেন্দ্রীয় পার্লামেন্টারি কমিশনারের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৬ সাল জার্মান সেনাবাহিনীর জন্য মোটেই ভালো বছর ছিল না৷ ডানপন্থি সন্ত্রাসবাদ বা ‘জার্মানির মুক্ত গণতান্ত্রিক সাংবিধানিক চেতনার লঙ্ঘন’ এর মোট ৬০টি অভিযোগের ঘটনা পাওয়া গেছে৷ এমনকি সেনারা নিজেদের নাৎসি চেতনা নিয়ে একে অপরের সাথে আলোচনা করে, নাৎসি সংগীত শোনে ও নাৎসি স্যালুটও দেয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/S. Sauer
জাহাজে মৃত্যু
২০১৩ সালের ডিসেম্বরে উরসুলা ফন ডেয়ার লাইয়েন প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব নেয়ার আগ পর্যন্ত এসব কেলেঙ্কারি নিয়ে কোনো মাথা ঘামায়নি সেনাবাহিনী৷ ২০১০ সালের একটি ঘটনা জনগণের মনোযোগ আকর্ষণ করে, তা হলো, গর্ক ফক-এ নৌবাহিনীর প্রশিক্ষণের সময় ২৫ বছরের এক সদস্যের মৃত্যুর ঘটনা৷ প্রশিক্ষণের সময় ঐ নারী জাহাজের পাল থেকে নীচে পড়ে মারা যান৷ ফলে অন্যান্য ক্যাডেটরা পালে উঠতে আর রাজি হননি৷ পরে ঐ প্রশিক্ষণ বাতিল করা হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/C. Rehder
জার্মান সেনাবাহিনীর জন্ম
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানি সেনাবাহিনী রাখার পক্ষে ছিল না৷ পশ্চিম জার্মানিতে সেনাবাহিনী প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৫৫ সালে৷ পুনরেকত্রীকরণের পর পূর্ব জামানির সেনাবাহিনী থেকে ২০ হাজার সদস্য নেয় কেন্দ্রীয় সেনাবাহিনী৷ ১৯৯৯ সালে যখন জার্মান সেনাবাহিনী আন্তর্জাতিক সংঘাতে (কসোভো যুদ্ধ) জড়িয়ে পড়ে, তখন এতে বড় ধরনের পরিবর্তন হয়৷ এর আগ পর্যন্ত কেবল বিদেশে শান্তিরক্ষা মিশনে তাদের অংশগ্রহণ ছিল৷
ছবি: picture alliance/akg-images
বাধ্যতামূলক সেবা নয়
বর্তমানে জার্মান সেনাবাহিনীতে সেনা সংখ্যা ১ লাখ ৭৮ হাজার ২০০৷ ২০১৭ সালের মার্চের হিসেব অনুযায়ী, সেনাবাহিনীর মোট সদস্যের ১১.৪ শতাংশ নারী৷ ২০১১ সাল পর্যন্ত জার্মান সেনাবাহিনীতে পুরুষদের অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক ছিল৷ এই মেয়াদকাল ছিল ৯ থেকে ১৮ মাস৷ বর্তমানে তরুণদের সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়ার আহ্বান জানানো হয়৷ তবে সাম্প্রতিক কেলেঙ্কারির কারণে এই আবেদনে তাদের সাড়া দেয়াটা সত্যিই কঠিন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/S. Sauer
7 ছবি1 | 7
জার্মান সেনাদের কোথায় মোতায়েন করা হবে তা নির্ধারণ করে দেশটির সংসদ৷ গত জুনে সংসদে তুরস্ক থেকে সেনা সরিয়ে নেয়ার বিষয়টি অনুমোদন পায়, কেননা, গতবছর তুর্কি প্রেসিডেন্ট রেচেপ তাইয়িপ এর্দোয়ানকে সরিয়ে দেয়ার এক ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানের পর থেকে সেদেশে বিদেশিদের উপর বাড়তি কড়াকড়ি আরোপ করা হয়৷ জার্মানির সাংসদরা ইনচিরলিকে অবস্থানরত সেনা সদস্যদের সঙ্গে একাধিকবার দেখা করতে চাইলেও সরাসরি অনুমতি দেয়নি তুরস্ক সরকার৷ এই নিয়ে জলঘোলা হয়েছে অনেক৷ গত সেপ্টেম্বরে বিশেষ ব্যবস্থায় সাত সাংসদ সেখানে যেতে পারলেও জার্মানির কাছে তা ইতিবাচক মনে হয়নি৷ ফলে দেশটি থেকে সেনাদের পুরোপুরি সরিয়ে নেয়া হলো৷
মূলত সিরিয়ায় মার্কিন নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক বাহিনীর বিমান হামলা পর্যবেক্ষণের দায়িত্বে ছিল জার্মানির সেনারা৷ এখন সেই দায়িত্ব জর্ডান থেকে পালন করা হবে৷ সেখানে ২৬০ জন জার্মান সেনার জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছুই তুরস্ক থেকে নেয়া হয়েছে৷ জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী উরসুলা ফন ডেয়ার লায়েন এই বিষয়ে বলেন, ‘‘জার্মান সেনা ইউনিটটিকে তুরস্কের এমন এক ঘাঁটিতে নেয়া হয়েছে, যেটি বেশ কয়েকটি ন্যাটোভুক্ত দেশ ব্যবহার করছে৷’’
উল্লেখ্য, গত কয়েকমাস ধরেই জার্মানির সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না৷ এর্দোয়ানের বিরুদ্ধে সে দেশের সেনাবাহিনীর ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানের পর কয়েকজন সেনা সদস্য জার্মানিতে রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহণ করেন৷ তুরস্ক দাবি করেছে, রাজনৈতিক আশ্রয় নেয়া সেনারা অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত ছিল৷ পাশাপাশি তুরস্কও সেখানে অবস্থানরত কয়েকজন জার্মানকে গ্রেপ্তার করে৷