তুরস্কে নারী-হত্যা নতুন কিছু নয়৷ নারীকে হত্যা করে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা সবচেয়ে বেশি নাড়া দিয়েছিল ২০১৮ সালের এক রোমহর্ষক ঘটনায়৷ সে বছর আঙ্কারায় ২৩ বছর বয়সি তরুণী সুলে সেট-কে ধর্ষণের পর হত্যা করে জানালা দিয়ে ফেলে দেয় দুই মাতাল৷ সুলের অফিসেই ঘটে ঘটনাটি৷ দুই মাতালের একজন ছিলেন তার বস৷
হাইরাইজ ভবনের ওপর থেকে সুলের লাশ ফেলে দিয়েই পুলিশে খবর দেন বস৷ দাবি করেন সুলে আত্মহত্যা করেছেন৷ অথচ সুলের ঘাড় ছিল ভাঙা, শরীরে ছিল অসংখ্য আঁচড়ের দাগ আর রক্তে ছিল ঘুমের ওষুধ জাতীয় কিছুর আলামত৷ ফলে নিহত তরুণীর পরিবার হত্যা মামলা করে৷ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ওঠে সুষ্ঠু তদন্তের জোর দাবি৷ কাজ হয় তাতে৷ তদন্তে বেরিয়ে আসে প্রকৃত সত্য এবং সুলের বসকে যাবজ্জীবন এবং তার সহযোগীকে ১৯ বছরের কারাদণ্ড দেয় আঙ্কারার আদালত৷
বিশ্বের ৩৫ শতাংশ নারী যৌন হয়রানির শিকার হন৷ এর মধ্যে ৪০ শতাংশ নারী যৌন হয়রানির শিকার হলেও চুপ থাকেন, ১০ শতাংশ আইন-শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তা নেন৷ এক সমীক্ষা জানাচ্ছে, ২০১৯ সালে কোন দেশে কতগুলো ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে৷
ছবি: picture-alliance/Pacific Press/E. McGregorদেশটির প্রতি এক লাখের মধ্যে ১৩২ জনেরও বেশি নারী ধর্ষণের শিকার হন৷ দক্ষিণ আফ্রিকার মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিলের জরিপ অনুসারে, প্রতি চারজনের মধ্যে একজন ধর্ষণ করে সেই কথা স্বীকারও করেন৷
ছবি: Reutersদক্ষিণ আফ্রিকার দেশ বোতসোয়ানায় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ধর্ষণের ঘটনা ঘটে৷ দেশটির প্রতি এক লাখ নারীরর মধ্যে ৯৩ জন ধর্ষণের শিকার হন৷
ছবি: picture alliance/AA/K. Mathe দক্ষিণ আফ্রিকার আরেক দেশ লেসোথোয় ২০১৯ সালে তৃতীয় সর্বোচ্চ ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে৷ সেখানকার এক লাখ নারীর মধ্যে ৮৩ জন ধর্ষণের শিকার হন৷ দেশটির মোট জনসংখ্যা ২১ লাখ ২৫ হাজার ২৬৮ জন৷
ছবি: Imago/F. Starkসোয়াজিল্যান্ডে প্রতি এক লাখ নারীর মধ্যে ৭৮ জন ধর্ষণের শিকার হন৷ দক্ষিণ আফ্রিকার এই দেশটির জনসংখ্যা ১১ লাখ ৪৮ হাজার ১৩০ জন৷ সেই হিসেবে ২০১৯ সালে এ দেশে ৮৯৫টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/J. Kalaeneদেশটির প্রতি এক লাখের মধ্যে ৬৭ জনেরও বেশি নারী ধর্ষণের শিকার হন৷ অনেক দেশেই যৌন নিপীড়ন ও সহিংসতারিবোধী আইন থাকলেও নানান অসঙ্গতিতে তা ঠিকমতো প্রয়োগ হয় না৷
ছবি: pictureäalliance/dpa/A. Simmonsইউরোপের এই দেশটিতে প্রতি এক লাখের মধ্যে ৬৩ জনেরও বেশি নারী ধর্ষিত হন৷ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নারীরা যৌন নির্যাতনের শিকার হলেও বিশ্বজুড়ে পুরুষরাও প্রতিদিন যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন৷
ছবি: picture-alliance/robertharding/A. Tambolyদক্ষিণ অ্যামেরিকার দেশ সরিনামের প্রতি এক লাখ নারীর মধ্যে ৪৫ জন ধর্ষণের শিকার হয়৷ দেশটিতে পাঁচ লাখ ৮১ হাজার ২৭২ জন মানুষ বসবাস করে৷ গত বছর দেশটিতে ২৬২ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন৷
ছবি: picture-alliance/E.Troonমধ্য অ্যামেরিকার দেশ কোস্টা রিকার প্রতি এক লাখ মানুষের মধ্যে ৩৭ জন ধর্ষণের শিকার হন৷ গবেষণা বলছে, ১৬ থেকে ১৯ বছর বয়সের নারীদের ধর্ষণ বা যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়ার আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি৷
ছবি: Reuters/J.C. Ulateমধ্য অ্যামেরিকার এই দেশটির প্রতি এক লাখ মানুষের মধ্যে ন৩২ জন ধর্ষণের শিকার হন৷ দেশটির মোট জনসংখ্যা ৬৫ লাখ ৪৫ হাজার ৫০২ জন৷ ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউ ডটকম বলছে, অনেক নারী যৌন সহিংসতার ঘটনা নিয়ে অভিযোগই করেন না৷
ছবি: Getty Images/AFP/I. Oconক্যারিবীয় এই দেশটির প্রতি এক লাখ নারীর মধ্যে ৩১ জন ধর্ষণের শিকার হন৷ দেশটির মোট জনসংখ্যা এক লাখ ১২ হাজার তিনজন৷ ১৮ থেকে ২৪ বছর বয়সি কলেজ ছাত্রীরাও যৌন নির্যাতনের ঝুঁকিতে থাকেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/A. Camara১১৮টি দেশের মধ্যে চালানো এই জরিপে ১৪তম অবস্থানে আছে যুক্তরাষ্ট্র৷ ৪০তম অবস্থানে থাকা বাংলাদেশের প্রতি এক লাখ নারীর মধ্যে প্রায় ১০ জন ধর্ষণের শিকার হন৷ ৪২তম অবস্থানে থাকা জার্মানিতে প্রতি এক লাখ নারীর মধ্যে ৯ জনেরও বেশি ধর্ষিত হন৷ আর ভারতের প্রতি লাখ নারীর মধ্যে এক দশমিক ৮ জন ধর্ষণের শিকার হন৷
ছবি: picture-alliance/Pacific Press/E. McGregor ধারণা করা হয়েছিল সুলে হত্যার বিচারের পর তুরস্কে নারী-হত্যা এবং নারীদের হত্যা করে আত্মহত্যা বলে চালানোর প্রবণতা কমবে৷ কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি৷ কয়েকদিন আগে তুরস্কের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় শহর দিয়ারবাকিরের বাড়িতে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া যায় আতেন কায়ার লাশ৷ ৩৫ বছর বয়সি ওই নারীর স্বামীর দাবি, তার স্ত্রী আত্মহত্যা করেছেন৷ কায়ার পরিবার তা মানতে পারেনি৷ হত্যা মামলা করেন তারা৷ কিন্তু স্থানীয় তদন্তকারীরা কায়ার মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলে রিপোর্ট দেয়ায় বন্ধ হয়ে যায় মামলার কাজ৷ সুলের পরিবারের মতো কায়ার পরিবারও সন্দেহমুক্ত হতে পারছেন না৷ তাদের প্রশ্ন, আত্মহত্যা হলে ময়না তদন্ত প্রতিবেদনে ঝুলন্ত মৃতদেহে অসংখ্য আঘাতের চিহ্নের কথা লেখা হয় কী করে? কেউ ফাঁসিতে ঝুলে মারা গেলে তো তার সারা গায়ে আঘাত লাগতে পারে না!
কায়ার পরিবার অবশ্য এসব প্রশ্ন তুলেও নতুন করে তদন্তের দাবি আদায় করতে পারেনি৷
‘উই উইল স্টপ ফেমিসাইড’ নামের একটি নারী অধিকার সংগঠনের দেয়া তথ্য অনুযায়ী ২০২০ সালে তুরস্কে কমপক্ষে ৩০০ জন নারীকে হত্যা করা হয়েছে৷ এর বাই আরো ১৭১ জনের মৃত্যু খুব রহস্যজনক৷ আত্মহত্যা বলা হলেও প্রত্যেকের ক্ষেত্রে এমন আলামত পাওয়া গেছে যা কিনা সুলে সেট-এর হত্যাকাণ্ডের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়৷
নারী অধিকার সংগঠন দিয়ারবাকির ব্রাঞ্চ অব রোজা-র সদস্য, আইনজীবী গুরবেত গজদে এঙ্গিন জানান, গত কয়েকদিনে আয়েত কায়া ছাড়াও আরো চার নারীর সন্দেহজনক মৃত্যুর খবর পেয়েছেন তারা৷ তিনি মনে করেন পুরুষশাসিত সমাজে নারীর ‘আত্মহত্যার’ প্রতিটি ঘটনাকে সন্দেহের চোখে দেখে তদন্ত না করলে নারী-হত্যাকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেয়ার প্রবণতা রোধ করা যাবে না৷
বুর্কু কারাকাস/এসিবি