তৃণমূল পর্যায়ে দলের বহিরাগত ও দুর্নীতিবাজদের তালিকা করেছে আওয়ামী লীগ৷ তাদেরকে আগামী কমিটিতে রাখা হবে না বলে জানিয়েছেন বিভিন্ন নেতারা৷ তবে তৃণমূলের চেয়ে শীর্ষ পর্যায়েই দুর্নীতিবাজ বেশি বলে অভিযোগ তাদের৷
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে এখন দুর্নীতিবাজ ও অনুপ্রবেশকারীদের বিদায় করার প্রক্রিয়া চলছে৷ কাউন্সিলের মাধ্যমে যেসব নতুন কমিটি হবে সেখানে তাদের জায়গা হবেনা বলে শোনা যাচ্ছে৷ প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার এই মনোভাবে উজ্জীবিত আওয়ামী লীগের তৃনমূলের নেতা-কর্মীরা৷
সম্প্রতি যুবলীগের চেয়ারম্যানওমর ফারুক চৌধুরীকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে ক্যাসিনো কাণ্ডের কারণে৷ একই কারণে বিদায় করা হয়েছে স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মোল্লা মো. আবু কাওসারকে৷ সাধারণ সম্পাদক পঙ্কজ দেবনাথকে কউন্সিলের কাজ থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে৷ তারও আগে চাঁদাবাজির অভিযোগে বিদায় করা হয়েছে ছাত্রলীগের সভাপতি শোভন এবং সাধারণ সম্পাদক রাব্বানীকে৷ এখন তৃণমূল নেতা-কর্মীরা আওয়ামী লীগের সংস্কার চান৷ তাদের অভিযোগ আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনে অনেক বহিরাগত রয়েছে৷
দেশের দক্ষিণের জেলা পিরোজপুরের ইন্দুরকানি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মতিউর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমাদের কাছে আওয়ামী লীগের অনুপ্রবেশকারীদের তালিকা চাওয়া হয়েছিল কেন্দ্র থেকে৷ আমরা তা পঠিয়ে দিয়েছি৷ আর দুর্নীতিবাজ কারা তা সবাই জানে৷ তাদের তালিকা করছে প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী৷ আমরা এবার এদের কাউকেই আওয়ামী লীগ বা সহযোগী সংগঠনের কোনো কমিটিতে ঠাঁই দেব না৷''
মতিউর রহমান
তিনি জানান, ‘‘আমাদের এখানে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কমিটিতে বহিরাগত বেশি৷ এমনকি শিবিরের ছেলেরাও ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতৃত্বে চলে এসেছে৷ আওয়ামী লীগেও বিএনপির লোকজন ঢুকেছে৷ উপজেলা কমিটির সহসভাপতি পদেও আছেন বহিরাগতরা৷''
এটা কীভাবে সম্ভব হলো জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘জেলা আওয়ামী লীগের মধ্যে গ্রুপিং-এর কারণে এটা সম্ভব হয়েছে৷ যার যার গ্রুপকে শক্তিশালী করার জন্য বহিরাগত জামায়ত-শিবির ও বিএনপিকে আওয়ামী লীগে আনা হয়েছে৷ আবার অভিযোগ আছে টাকার বিনিময়েও তাদের কাছে পদ বিক্রি করা হয়েছে৷''
একই ধরণের কথা বলেন সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রফিক আহমেদ৷ তিনি বলেন, ‘‘আমাদের নেত্রী শেখ হাসিনা যে উদ্যোগ নিয়েছেন তা যেন সফল হয় এটা আমাদের প্রত্যাশা৷ তাঁকে যদি সবাই সহযোগিতা করেন তাহলে তিনি সফল হবেন৷ কিন্তু শেখ হাসিনার পাশেও মোশতাকরা আছে৷ তার পাশেও মীরজাফররা আছে৷ তিনি যদি তাদের চিনে দূরে সরিয়ে দিতে পারেন, শাস্তি দিতে পারেন, তাহলে তিনিদুর্নীতি ও হাইব্রিডদের বিরুদ্ধেসফল হবেন৷''
তৃনমূলের এই নেতা বলেন, ‘‘আমরা দেখেছি তৃনমূলের চেয়ে দলের শীর্ষ পর্যায়ে হাইব্রিড, বহিরাগত ও দুর্নীতিবাজ বেশি৷ আমার বিবেচনায় নেতৃত্বের পর্যায়ে এটা শতকরা ১০ ভাগের কম হবে না৷ আর তৃণমূলে কমপক্ষে পাঁচ ভাগ৷''
কিন্তু তাঁর প্রশ্ন, ‘‘এদের বিদায় করবে কারা? কারণ এদের যারা দলে এনেছেন, দলে ঢুকিয়েছেন তারা আওয়ামী লীগেরই প্রভাবশালী নেতা৷ এখন তারাই যদি সিদ্ধান্ত নেন তাহলে তারাতো টিকে যাবেন৷''
মমতাজ উদ্দিন আহমেদ
আগামী ২০ ও ২১ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কাউন্সিল৷ তার আগেই প্রায় সব সহযোগী এবং ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের কাউন্সিলের নির্দেশ দেয়া হয়েছে৷ আর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কাউন্সিল হওয়ার আগেই জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কাউন্সিল ও নতুন কমিটি গঠন করবে আওয়ামী লীগ৷ ৬ নভেম্বর কৃষক লীগ, ৯ নভেম্বর শ্রমিক লীগ, ১৬ নভেম্বর স্বেচ্ছাসেবক লীগ এবং ২৩ নভেম্বর যুবলীগকে কেন্দ্রীয় কাউন্সিল করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে৷
জানা গেছে জেলা পর্যায়ে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ থেকে এরইমধ্যে কাউন্সিলের নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে৷ কেন্দ্রীয় কাউন্সিলের আগেই জেলা, পৌর ও উপজেলা পর্যায়ে কাউন্সিল করে নতুন নেতৃত্ব আনতে হবে৷
রংপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মমতাজ উদ্দিন আহমেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমাদের জেলা কাউন্সিল ১৯ নভেম্বর৷ মহানগর ও উপজেলার কমিটি তার আগেই হবে৷ আমরা আমাদের নেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশমত বহিরাগত ও দুর্নীতিবাজমুক্ত কমিটি গঠন করবো৷ জামায়াত ও বিএনপির কাউকে কমিটিতে রাখা হবে না৷''
তিনি জানান, ‘‘মহানগর ও থানা কমিটিতে জামায়াত ও বিএনপির লোক ঢুকেছে৷ বিশেষ করে মহানগরের ওয়ার্ড পর্যায়ে বহিরাগত বেশি৷ আমরা তাদের চিহ্নিত করেছি৷ কমিটিতে তারা জায়গা পাবেন না৷''
আর দুর্নীতিবাজ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘তাদের চিহ্নিত করা কঠিন৷ তাদের ব্যাপারে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী নজর রাখছে৷ আমরাও মনিটর করছি৷ কেন্দ্র থেকে তাদের একটা তালিকা পাব৷ কিন্তু এখানো পাইনি৷''
অভিযানে আলোচনায় ক্যাসিনো
বাংলাদেশে ক্যাসিনোয় মদ, জুয়া চলছে অনেক দিন ধরে৷ তবে বুধবার যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া গ্রেপ্তার হবার পর ক্যাসিনোই হয়ে গেছে ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’৷ বাংলাদেশে ক্যাসিনোের বিস্তারের ইতিহাস নিয়েই এই ছবিঘর...
ছবি: bdnews24.com/A. Al Momin
ক্লাবে ক্লাবে মদ, জুয়া
আয়ের উৎস হিসেবে বাংলাদেশের অনেক ফুটবল ক্লাবে ‘হাউজি’ খেলা শুরু হয় আশির দশকের দিকে৷ তবে নব্বইয়ের দশকে জুয়ার আসরও জমে ওঠে৷ গত কয়েক বছরে তা আরো ভয়াবহ মাত্রা পায়৷ ঢাকা এবং ঢাকার বাইরের অনেক ক্লাবেই গড়ে ওঠে ক্যাসিনো৷
ছবি: bdnews24.com/A. Al Momin
প্রতিবেদনে ক্যাসিনো
জাতীয় দৈনিকে ক্যাসিনো নিয়ে প্রথম উল্লেখযোগ্য প্রতিবেদন নজরে আসে ২০১৩ সালে৷ প্রথম আলো-র সেই প্রতিবেদনে তখন বলা হয়, ‘‘বছরের পর বছর ধরে ক্লাবগুলোতে নিপুণ, চড়চড়ি, ডায়েস, ওয়ান-টেন, ওয়ান-এইট, তিন তাস, নয় তাস, রেমি, ফ্ল্যাসসহ বিভিন্ন ধরনের তাস খেলা বা কথিত ‘ইনডোর গেমস’-এর নামে জুয়া খেলা চলছে৷’’
ছবি: bdnews24.com/A. Al Momin
এগিয়ে থাকা ঢাকার কিছু ক্লাব
ছয় বছর আগে প্রথম আলো’র সেই প্রতিবেদনে ঢাকার ক্লাবগুলোর মধ্যে ফকিরেরপুল ইয়ংমেনস ক্লাব, ক্লাব প্যাভিলিয়ন ফকিরাপুল, আরামবাগ ক্লাব, দিলকুশা ক্লাব, ডিটিএস ক্লাব, আজাদ বয়েজ ক্লাব, মুক্তিযোদ্ধা ক্লাব, বিজি প্রেস স্পোর্টস অ্যান্ড রিক্রিয়েশন ক্লাব, ব্রাদার্স ইউনিয়ন ক্লাব, ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাব, আরামবাগ ক্রীড়া সংঘ ও বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা পুনর্বাসন সোসাইটি ক্রীড়াচক্র বিমানবন্দর কমান্ড-এর নাম এসেছিল৷
ছবি: bdnews24.com/A. Al Momin
ঢাকার বাইরেও...
বগুড়ার রহমান নগর ক্রিকেট ক্লাব, নোয়াখালীর শহীদ শাহ আলম স্মৃতি সংসদ হলরুম, সোনাইমুড়ী, চাঁদপুরের মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব, ভাই ভাই স্পোর্টিং ক্লাব, ফ্রিডম ফাইটার (৫ নম্বর গুপ্তি ইউনিয়ন পরিষদ), নারায়ণগঞ্জের সানারপাড় বর্ণালী সংসদ, বরিশালের সেতুবন্ধন ক্লাব ও লাইব্রেরি, চট্টগ্রামের মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব ও বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদেও তখন থেকেই নিয়মিত জুয়ার আড্ডা বসছে বলে জানা যায়৷
ছবি: bdnews24.com/A. Al Momin
আরো প্রতিবেদন
২০১৭ সালে দৈনিক বণিক বার্তা ‘অবৈধ তবু বড় হচ্ছে’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে৷ তাতে তুলে ধরা হয় ক্লাবভিত্তিক রেস্টুরেন্টগুলোতেও পশ্চিমা ধাঁচের অবৈধ ক্যাসিনো ব্যবসা জমে ওঠার তথ্য৷ বলা হয়, প্রশিক্ষিত জুয়াড়ি আনা হচ্ছে বিদেশ থেকে, তাঁদের কাজে লাগিয়ে ক্লাবগুলোতে প্রতি রাতে বসানো হচ্ছে জুয়ার আসর৷
ছবি: bdnews24.com/A. Al Momin
বিচ্ছিন্ন অভিযান
এরপর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনি দু-একটি ক্লাবে অভিযান চালালেও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি, বরং ক্যাসিনোর বিস্তার আরো বেড়েছে৷
ছবি: bdnews24.com/A. Al Momin
প্রধানমন্ত্রীর হুঁশিয়ারি
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা এক বৈঠকে দলের সহযোগী সংগঠন যুবলীগের নেতাদের কঠোর সমালোচনা করেন৷ আওয়ামী লীগ নেতাদের ভাষ্য অনুযায়ী সেই বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যুবলীগের ঢাকা মহানগরের একজন নেতা যা ইচ্ছে করে বেড়াচ্ছে, চাঁদাবাজি করছে৷ আরেকজন এখন দিনের বেলায় প্রকাশ্যে অস্ত্র উঁচিয়ে চলেন৷ এসব বন্ধ না করলে যেভাবে জঙ্গি দমন করা হয়েছে, একইভাবে তাদেরকেও দমন করা হবে৷
ছবি: DW
যুবলীগের ৬০টি ক্যাসিনো?
প্রধানমন্ত্রীর ওই বক্তব্যের পর যুবলীগ নেতারা ৬০টি জুয়ার আখড়া বা ক্যাসিনো চালাচ্ছেন বলে কয়েকটি সংবাদপত্র জানায়৷ এরপরই ক্যাসিনোতে অভিযান শুরু করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনি৷
ছবি: bdnews24.com/A. Al Momin
যুবলীগ নেতা আটক
ঢাকার ফকিরাপুল ইয়ংমেনস ক্লাবে অবৈধভাবে ক্যাসিনো চালানোর অভিযোগে বুধবার যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে গ্রেপ্তার করে র্যাব৷ গুলশান ২ নম্বরের ৫৯ নম্বর সড়কের বাসা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ একই দিনে ফকিরাপুলের ইয়ংমেনস ক্লাবে অভিযান চালিয়ে দুই নারীকর্মীসহ ১৪২ জনকে আটক ও ২৪ লাখ টাকা উদ্ধার করা হয়৷
ছবি: bdnews24.com/A. Al Momin
অভিযান চলছে
শুক্রবার যুবলীগের নেতা পরিচয় দিয়ে ঠিকাদারি চালিয়ে আসা গোলাম কিবরিয়া শামীম ওরফে জি কে শামীমের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ নগদ টাকা, অস্ত্র ও মদ উদ্ধার করে র্যাব৷ বুধবার ফকিরাপুল ইয়ংমেনস ক্লাবের পাশাপাশি ওয়ান্ডারার্স ক্লাব, বঙ্গবন্ধু এভিনিউর মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্র এবং বনানীর আহমেদ টাওয়ারের একটি ক্যাসিনোতে অভিযান চালায় র্যাব৷ এ পর্যন্ত ১৮২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়৷
ছবি: bdnews24.com/A. Al Momin
মোহামেডান, ভিক্টোরিয়াতেও ক্যাসিনো!
রোববার ঢাকার মতিঝিলে চারটি ক্লাবে অভিযান চালায় পুলিশ৷ ভিক্টোরিয়া ক্লাব থেকে জুয়া খেলার নয়টি বোর্ড, এক লাখ টাকা, জুয়ায় ব্যবহৃত চিপস ও মদ পাওয়া গেছে। দুটো রুলেট টেবিল, নয়টি বোর্ড, বিপুল পরিমান কার্ড পাওয়া গেছে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে৷ এছাড়া আরামবাগ ও দিলকুশা ক্লাবেও বাকারা ও রুলেট টেবিলসহ বিভিন্ন জুয়ার সরঞ্জাম পেয়েছে পুলিশ। এর আগে শনিবার চট্টগ্রামে ক্লাবগুলোতে অভিযান চালিয়েছে র্যাব৷
ছবি: bdnews24.com
ক্যাসিনোতে রাজনীতির প্রভাব
ক্যাসিনো প্রসঙ্গে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠন ও অন্য দলের নেতাদের নামও উঠে এসেছে৷ ফকিরাপুল ইয়ংমেন্স ক্লাবের গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা এবং ঢাকা-৮ আসনের সংসদ সদস্য রাশেদ খান মেনন আর মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হাজী সাব্বির সাধারণ সম্পাদক৷ রাশেদ খান মেননের দাবি, ক্লাবে যে ক্যাসিনো চলছে তা তিনি জানতেন না৷