তৃণমূল নেতারা কী করে আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছেন?
১ জুলাই ২০২৫
এসব ঘটনা ঘিরে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, কেন এভাবে আইন হাতে তুলে নিচ্ছেন শাসক দলের নেতারা বা তার ঘনিষ্ঠরা।
দক্ষিণ কলকাতার আইন কলেজে ছাত্রীর ধর্ষণকে ঘিরে রাজনীতি সরগরম। মূল অভিযুক্ত ছাত্রনেতা কোন সাহসে এতটা বেপরোয়া হয়ে উঠল, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এরই মধ্যে একাধিক জায়গায় দেখা যাচ্ছে, তৃণমূলের নেতা বা তার ঘনিষ্ঠরা আইন নিজের হাতে নেয়ার সাহস দেখাচ্ছেন।
বৃদ্ধকে মারধর
পশ্চিম মেদিনীপুরের খড়্গপুরে এক বৃদ্ধকে রাস্তায় ফেলে মারধরের অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ, স্থানীয় তৃণমূল নেত্রী বেবি কোলে ও তার সঙ্গী দু-তিনজন মহিলা বৃদ্ধকে রাস্তায় ফেলে মেরেছেন। কলার ধরে তাকে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, মারা হয়েছে। এর ফলে জামাকাপড় ছিঁড়ে যায় তার।
আক্রান্ত ও অভিযোগকারী অনিল দাস বামপন্থি নেতা। তিনি এলাকায় ভীমদা নামে পরিচিত। এক সময় সিপিএমের নেতা হলেও পরে দলের সঙ্গে মতবিরোধে তিনি 'আমরা বামপন্থি' নামে একটি সংগঠন তৈরি করেন। সেই অনিলকে কেন রাস্তায় এভাবে নিগ্রহ করা হলো?
অভিযুক্ত তৃণমূল নেত্রী বেবির দাবি, "চাকরি দেয়ার নাম করে উনি টাকা নিয়েছেন। কিন্তু চাকরি হয়নি। সেই টাকা ফেরত দেননি।" অনিলের বক্তব্য, "একেবারেই মিথ্যা অভিযোগ। অকারণে বদনাম করা হচ্ছে। এই অভিযোগ আগে কেন করেননি?"
বেবি আগে বিজেপির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলে স্থানীয় সূত্রের খবর। পরে তিনি তৃণমূলে যোগ দেন। প্রশ্ন উঠেছে অনিলের বিরুদ্ধে যে অভিযোগই থাক না কেন, তিনি নিজে কেন আইন হাতে তুলে নিলেন? পুলিশে অভিযোগ জানালে তারা ব্যবস্থা নিতে পারত না? বেবির বিরুদ্ধে থানায় মারধরের অভিযোগ দায়ের হয়েছে। তাকে পুলিশ আটক করেছে। তৃণমূল তাকে শোকজ করেছে। বেবিও পাল্টা অভিযোগ দায়ের করেছেন থানায়।
উত্তর ২৪ পরগনা জেলার মোহনপুর এলাকায় মারধরের মুখে পড়েছেন এক মহিলা। এক্ষেত্রে অভিযোগ তৃণমূল পঞ্চায়েত সদস্যের স্বামীর বিরুদ্ধে। অভিযোগ, এক গ্রামবাসীর কাছ থেকে তিনি টাকা নিয়েছিলেন চাকরি পাইয়ে দেওয়ার নাম করে। চাকরি না মেলায় ওই মহিলা টাকা ফেরত চান। সেই কারণে পঞ্চায়েত সদস্যের স্বামী তাকে মারধর করেন বলে অভিযোগ। এই অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে অভিযুক্ত শহীদুল গাজী ও তার ভাইকে।
অতীতের ঘটনা
সপ্তাহ দুয়েক আগে নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগর পুরসভার ভিতরে একজন আধিকারিককে মারধরের অভিযোগ ওঠে তৃণমূল কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে। ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের পুর প্রতিনিধি সুমিত ঘোষ পূর্ত দপ্তরের আধিকারিক সুজিত পালকে চড়, ঘুসি মারেন বলে অভিযোগ।
জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে উত্তর ২৪ পরগনার পানিহাটির একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল। এই ভিডিওর সত্যতা যাচাই করেনি ডিডাব্লিউ। স্থানীয় তৃণমূল কাউন্সিলরের সঙ্গে এক তরুণীর কার্যত মারপিট শুরু হয়ে গিয়েছিল রাস্তার মাঝখানে। স্কুটি আরোহী ওই তরুণী রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় তৃণমূল কাউন্সিলরের মুখোমুখি হন। উভয়ের মধ্যে বচসা শুরু হয়। ভিডিওতে দেখা গিয়েছে, তরুণীকে চড় মারছেন তৃণমূল কাউন্সিলর শ্রাবন্তী রায়। পাল্টা তরুণী মারছেন ওই কাউন্সিলরকে।
শ্রাবন্তীর দাবি, মত্ত অবস্থায় ওই তরুণী গাড়ি চালাচ্ছিলেন। এর প্রতিবাদ করাতে গন্ডগোলের সূত্রপাত। যদিও তরুণী এই অভিযোগ স্বীকার করেননি। ঘটনা যাই হোক, তবু কি তৃণমূলের জনপ্রতিনিধি কাউকে চড় মারতে পারেন?
বিভিন্ন সময় এভাবে প্রকাশ্যে গায়ে হাত তোলার ঘটনা ঘটে চলেছে। মোবাইল ক্যামেরার সৌজন্যে এসব ঘটনা ছড়িয়ে পড়ছে সামাজিক মাধ্যমে। গত লোকসভা নির্বাচনের সময় বালুরঘাটে এক নারী বিজেপি কর্মীকে চড় মারার অভিযোগ ওঠে এক তৃণমূল নারী কর্মীর বিরুদ্ধে।
গত বছরের জুলাই মাসে উত্তর কলকাতায় দলেরই যুব নেতাকে থাপ্পড় মারার অভিযোগ ওঠে তৃণমূল কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে। ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের পুর প্রতিনিধি সুনন্দা সরকার এলাকারই যুব নেতা কেদার দাসকে চড় মারেন বলে অভিযোগ। যদিও সুনন্দা এই অভিযোগ খারিজ করে দেন।
তৃণমূল কাউন্সিলর বা তার সঙ্গীদের বিরুদ্ধে গুরুতর দাদাগিরির অভিযোগ মাঝেমধ্যে শোনা যায়। গত বছরের শেষে রাজপুর সোনারপুর পুরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর রঞ্জিত মন্ডলের অনুগামীদের বিরুদ্ধে মারধর ও লুটপাটের অভিযোগ ওঠে। নরেন্দ্রপুরের ব্যবসায়ী সুব্রত সরকারের অভিযোগ, দল বল নিয়ে স্থানীয় নেতা তার দোকানে হানা দিয়েছিলেন। এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন কাউন্সিলর।
এর কদিন আগেই বাগুইআটিতে প্রোমোটারকে আক্রমণের অভিযোগ ওঠে তৃণমূল কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে। বিধাননগর পুরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সমরেশ চক্রবর্তীর অনুগামীরা প্রোমোটার কিশোর হালদারের কাছ থেকে ৩০ লক্ষ টাকা দাবি করেন বলে অভিযোগ। রাজি না হওয়ায় বন্দুকের বাঁট দিয়ে মেরে রক্তাক্ত করা হয় বলে প্রোমোটারের অভিযোগ। এই ঘটনার সঙ্গে তার কোনো যোগাযোগ নেই বলে দাবি করেছেন সমরেশ।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে একেবারে তুচ্ছ কারণে মারধরের অভিযোগ উঠেছে শাসক নেতাদের বিরুদ্ধে। যেমন গত মার্চে বীরভূমের দুবরাজপুরের একটি ঘটনা। পুরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর শেখ নাজিরউদ্দিন শিঙাড়া বিক্রেতা জিতেন্দ্রনাথ সাহাকে অতিরিক্ত চাটনি না দেওয়ার জন্য মারধর করেন বলে অভিযোগ।
অধিকাংশ ঘটনার ক্ষেত্রে তৃণমূলের জেলা নেতৃত্ব দলীয় কর্মী বা জনপ্রতিনিধিদের সংযত থাকার বার্তা দিয়েছেন। একেবারে নিচুতলার এ সব ঘটনা কি শাসক দলের অকুতোভয় মানসিকতার প্রকাশ?
দমদম পুরসভার এক নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর রিঙ্কু দে বলেন, "এ ধরনের ঘটনা ঘটলে দলের উপর প্রভাব হয়তো পড়ে। তবে অনেক সময় কোনো কোনো পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে এমন ঘটনা ঘটে যায়।"
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন
অন্যায়ের পরিপ্রেক্ষিতে হলেও কোনো জনপ্রতিনিধির কি আইন হাতে তুলে নেওয়া কাম্য? মনোজিতের মতো নিচুতলার ছাত্র নেতাদের দাপট, কলেজের ভিতরে ধর্ষণের মতো অভিযোগ কি এই বেপরোয়া মনোভাবেরই প্রকাশ?
সাবেক পুলিশ কর্তা নজরুল ইসলাম ডিডাব্লিউকে বলেন, "আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা না করলে কেউ ভয় পান না। মনোজিত প্রবেশিকা পরীক্ষায় কোনো র্যাংক করেনি, তাও এই আইন কলেজে ভর্তি হয়েছে। তার বিরুদ্ধে ১১টা মামলা বিচারাধীন আছে। তারপরেও তাকে ওখানে চাকরি দেওয়া হয়েছে। তিনি আদালতে প্র্যাকটিস করেন। অথচ কেউ চাকরি করলে প্র্যাকটিস করতে পারেন না, বা প্র্যাকটিস করলে চাকরি করতে পারেন না। দুই জায়গাতেই তিনি বেআইনি কাজ করেছেন। কলেজে ভর্তি, উৎসব, পিকনিক সংক্রান্ত ক্ষেত্রে লক্ষ লক্ষ টাকা তুলতেন, সে জন্য দাদাদের প্রশ্রয় পেতেন। প্রশ্রয় না পেলে মনোজিৎ এতদূর এগোতে পারতেন না। এই পরিস্থিতি তো নিচুতলায় রয়েছে।"
তিনি বলেন, "শাসক দলে থাকলে পুলিশ অভিযুক্তের বিরুদ্ধে অনেক ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এর ফলে অভিযুক্তরা নিজেদের শক্তিশালী ভাবছে। ভাবছে, তারা যা খুশি তাই করতে পারে। সাধারণ একজন মানুষ প্রকাশ্যে এরকম কাজ করতে পারেন না, কারণ তাদের ভয় আছে যে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হতে পারে বা পুলিশ পদক্ষেপ নিতে পারে। শাসক দলের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের এই ভয়টাই নেই। এ জন্য তারা মারধর করছেন। এই বেপরোয়া মনোভাবের ভয়াবহ প্রকাশ হয়েছে আইন কলেজে।"
প্রবীণ সাংবাদিক শুভাশিস মৈত্র ডিডাব্লিউকে বলেন, "দাদাগিরি এবং নেতাগিরি ক্রমশ প্রায় সমার্থক হয়ে উঠছে। তার ফলেই এই অবস্থা হয়েছে। অতীতে এতটা চোখে পড়ত না। টেলিভিশনের মতো শক্তিশালী গণমাধ্যমের প্রভাবে এই ঘটনাগুলো সামনে আসছে। বাড়াবাড়ি আগেও ছিল, কিন্তু সেটা দিনে-দিনে বাড়ছে এবং প্রকাশ্যে চলে আসছে।"
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক রাজাগোপাল ধর চক্রবর্তী ডিডাব্লিউকে বলেন, "শাসক দলের নেতা-কর্মীরা মনে করছেন যে পুলিশ তাদের ছুঁতে পারবে না। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, পুলিশ তাদের নাম কা ওয়াস্তে গ্রেপ্তার করলেও পরে ছেড়ে দিচ্ছে। এই দুর্বলতার জন্য আইন কলেজে গণধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটেছে।"
তিনি বলেন, "প্রকাশ্যে যা যা ঘটছে, সে সব দেখে বোঝা যাচ্ছে, শাসক দলের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা বার্তা দিচ্ছেন, তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে প্রকাশ্যে ধোলাই খেতে হবে। ভবিষ্যতে যারা এরকম প্রতিবাদ করবে, তাদের সঙ্গেও এরকম হতে পারে।"
সাংবাদিক সুমন ভট্টাচার্য ডিডাব্লিউকে বলেন, "এটা আসলে ক্ষমতার আস্ফালন। খড়্গপুরে এটা নিয়ন্ত্রণ করা গিয়েছে। কিন্তু রাজ্যের শাসক দল হিসেবে তৃণমূলকে বুঝতে হবে, এই ক্ষমতার আস্ফালন তাদের কোনা রকম স্বস্তি দেবে না, বরং তাদের নিজস্ব জনভিত্তিকে দুর্বল করবে। খড়্গপুরের ক্ষেত্রে গোটা প্রতিবাদটাই এসেছে তৃণমূলের ভেতর থেকে।"
তার মতে, "ভারতে ক্ষেত্রে যেটা ইতিবাচক, এদেশের গণতন্ত্রে প্রতিবাদের একটা জায়গা আছে। যখন অপারেশন সিঁদুর চলছিল, বিদেশ সচিব বিক্রম মিশ্রি মনে করিয়ে দিয়েছিলেন যে, পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের তফাৎ হচ্ছে, আমাদের গণতন্ত্র প্রশ্ন করতে শেখায়। ফলে যে প্রশ্ন করছে তাকে আমি থাপ্পড় মারব, শারীরিকভাবে নিগ্রহ করব, এটা কোনো সময় ভারতবর্ষের রাজনীতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এইটা যত তাড়াতাড়ি তৃণমূলের এই উশৃঙ্খল অংশ, যারা ক্ষমতার আস্ফালন দেখাতে বদ্ধপরিকর, তারা বুঝে যাবে, ততই ভালো।"