নোট বাতিলের বিরুদ্ধে এবং তৃণমূল সাংসদদের গ্রেপ্তারির প্রতিবাদে সোমবার থেকে দেশজুড়ে বিক্ষোভ আন্দোলন শুরু করেছে তৃণমূল কংগ্রেস৷ আগামী তিনদিন এই বিক্ষোভ চলবে, ঘোষণা করেছেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷
বিজ্ঞাপন
সোমবার সকালে তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় টুইট করে ঘোষণা করেন দেশজুড়ে তাঁর দলের তিন দিনের বিক্ষোভ সমাবেশের কথা৷ মমতার ভাষায়, ‘‘মোদি বাবুর নির্লজ্জ ফ্লপ শো-এর বিরুদ্ধে দেশজুড়ে প্রতিবাদ৷ বাংলা, ভুবনেশ্বর, পাঞ্জাব, কিষাণগঞ্জ (বিহার), মণিপুর, ত্রিপুরা, আসাম, ঝাড়খণ্ড এবং দিল্লিতে প্রতিবাদ হবে৷'' সেই মতো, বেলা বাড়তেই শুরু হয়ে যায় প্রতিবাদ৷ রাজধানী দিল্লিতে দলের বিক্ষোভ কর্মসূচির দায়িত্ব নেন দুই সাংসদ সৌগত রায় এবং ডেরেক ও ব্রায়েন৷ সঙ্গে ছিলেন লোকসভা ও রাজ্যসভার বাকি তৃণমূল সাংসদরা৷ গত সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনের সামনে এবং প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের সামনে তৃণমূল সাংসদদের আচমক প্রতিবাদের পর থেকে সন্ত্রস্ত দিল্লি পুলিশ৷ এদিন সকাল থেকে পুলিশ পাহারা বসানো হয় ডেরেক ও ব্রায়েন এবং তৃণমূলের সর্বভারতীয় সম্পাদক মুকুল রায়ের বাড়ির সামনে৷ তবে এদিন আর কোনও হঠাৎ বিক্ষোভ নয়, দিল্লির সাউথ অ্যাভিনিউতে, গলায় পোস্টার ঝুলিয়ে তৃণমূল সাংসদরা বিক্ষোভ দেখান৷ অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গের জেলায় জেলায় তৃণমূলের বিক্ষোভের পাশাপাশি কলকাতায় এদিন দুটি বড় বিক্ষোভ শুরু হয়েছেউ একটি সিবিআই দপ্তরের সামনে, অন্যটি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সামনে৷
নোট বাতিলের পর ভারতের নাজেহাল অবস্থা
ভারতে ৫০০ আর ১,০০০ টাকার নোট বাতিল হয়েছে৷ কিন্তু পরিস্থিতি সামাল দেবার যথেষ্ট ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি৷ কাজেই হয়রান ও অধৈর্য হচ্ছেন মানুষ, দানা বাঁধছে রাজনৈতিক প্রতিরোধ৷
ছবি: REUTERS/File Photo/A. Dave
টাকা বাতিলে আতঙ্ক সর্বত্র
৮ই নভেম্বর ২০১৬ তারিখে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ঘোষণা করেন যে, ৯ই নভেম্বর থেকে পাঁচশ’ ও হাজার টাকার নোট বাতিল করা হচ্ছে৷ পরের বৃহস্পতিবার থেকেই ব্যাংকে ঢুকে টাকা বদল করার জন্য মানুষের ভিড় ও ধস্তাধস্তি৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/Altaf Qadri
লেডিজ ফার্স্ট
নতুন দিল্লির একটি ব্যাংকে নোট বদলানোর জন্য মহিলাদের আলাদা লাইন৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/A. Qadri
ব্যাংক কর্মীরাও ব্যতিব্যস্ত
আসামের গুয়াহাটির একটি ব্যাংকে এক ব্যাংক কর্মী নোট তুলে ধরে দেখছেন, তা সাচ্চা কিনা৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/A. Nath
অনন্ত প্রতীক্ষা
রাজধানী নতুন দিল্লির একটি ব্যাংকের সামনে সুদীর্ঘ লাইন৷ ধীরে ধীরে শৃঙ্খলা ফিরে আসছে, যদিও বাড়ছে অসন্তোষ৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/S. Das
ভুক্তভোগী
মুম্বইতেও মানুষজন লাইন করে দাঁড়িয়েছেন, টাকা বদলানোর আশায়৷ কিন্তু বয়স্ক মানুষদের জন্য কোনো আলাদা ব্যবস্থা রাখা হয়নি৷ চূড়ান্ত অসুবিধেয় পড়েছেন পেনশনভোগী ও ‘দিন-আনি-দিন-খাই’ সাধারণ মানুষ৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/R. Kakade
প্রতিরোধ দানা বাঁধছে
সোমবার, ২৮শে নভেম্বর ভারত বনধ-এর ডাক দেয় বিরোধীরা৷ দেশ জুড়ে প্রতিবাদ মিছিল ও সমাবেশের আয়োজন করা হয়৷ ছবিতে বনধের দিনে মুম্বই৷
ছবি: Getty Images/AFP/I. Mukherjee
ধর্মঘটের দিনেও টাকা বদলানোর লাইন
দৃশ্যটা কলকাতার৷ ২৮শে নভেম্বর ১২ ঘণ্টা বনধের ডাক দিয়েছিল বামফ্রন্ট৷ মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি যা সমর্থন করেননি৷ জানিয়েছিলেন, জনজীবন স্বাভাবিক থাকবে৷ বস্তুত পশ্চিমবঙ্গে ছিলও তাই৷
ছবি: Getty Images/AFP/D. Sarkar
‘দিদি’ মাঠে নামলেন
সোমবার আঠাশে নভেম্বর কলকাতার কলেজ স্কোয়্যার থেকে ধর্মতলা অবধি মিছিল করেন তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা ব্যানার্জি৷ সেদিন নরেন্দ্র মোদীকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করার হুমকিও দেন তিনি৷ মমতা আগামী ৬ই ডিসেম্বর অবধি এক বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
8 ছবি1 | 8
তৃণমূল কংগ্রেসের প্রবীণ নেতা, রাজ্যের মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সামনে তৃণমূলের ধর্ণামঞ্চ থেকে সংবাদমাধ্যমকে বলেন, কেন্দ্রীয় সরকার নোট বাতিলের মাধ্যমে যে অনৈতিক কাজ করছে, তার প্রতিবাদ জানাতে, নিজেদের বিক্ষোভ রিজার্ভ ব্যাঙ্কের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌঁছে দিতে ওঁরা সমবেত হয়েছেন৷ দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই কারণেই সোমবার থেকে তিনদিনের এই বিক্ষোভ কর্মসূচি শুরু করেছেন দেশজুড়ে৷
কলকাতায় সিবিআইয়ের কার্যালয়, বিধান নগরের সিজিআই কমপ্লেক্সের সামনে এদিন একযোগে বিক্ষোভ দেখায় তৃণমূল, যার নেতৃত্বে ছিলেন স্থানীয় বিধায়ক সুজিত বসু এবং বিধান নগর পুরসভার চেয়ার পার্সন কৃষ্ণা চক্রবর্তী৷ এখানে কেন্দ্রীয় সরকারের নোট বাতিলের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদের পাশাপাশি তৃণমূল সাংসদ তাপস পাল এবং সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গ্রেপ্তারির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখায় তৃণমূল৷ সাংসদদের এই গ্রেপ্তারি, তৃণমূলের দাবি অনুযায়ী, তাদের নোট বাতিলবিরোধী আন্দোলনের প্রতিক্রিয়াতেই, যা রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ছাড়া আর কিছুই নয়৷ একই সঙ্গে এদিন ভুবনেশ্বরে খুর্দা রোড বিচারবিভাগীয় কমপ্লেক্সের সামনে বিক্ষোভ দেখান তৃণমূলের নেতা কর্মীরা৷ এদিন সেখানেই ধৃত সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সিবিআই হেফাজতের মেয়াদ বাড়ানোর আর্জি জানিয়ে আদালতে হাজির করা হয়৷
সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আইনজীবী রাজদীপ মজুমদার আদালত চত্বরে দাঁড়িয়ে সংবাদমাধ্যমকে বলেন, সাংসদ রোজভ্যালি চিটফান্ড থেকে নগদ টাকা নিয়েছেন বলে যে অভিযোগ সিবিআই তুলেছে, তার সপক্ষে কোনও প্রমাণ নেই৷ সিবিআই সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের দু'জন প্রাক্তন সহযোগীর ম্যাজিস্ট্রেটকে দেওয়া গোপন এজাহারের ভিত্তিতে এই অভিযোগ আনছে৷ তাঁরা নাকি সাংসদের নাম করে রোজভ্যালি থেকে নিয়মিত টাকা নিয়ে আসতন৷ কিন্তু সেই টাকা আদৌ সুদীপের হাতে পৌঁছেছে কিনা, তার কোনও প্রমাণ নেই৷
একজন নরেন্দ্র মোদী
উগ্র সাম্প্রদায়িক আদর্শ এবং বিভাজনের রাজনীতির কারণে ভারতের বহু মানুষের কাছে তিনি খলনায়ক৷ ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে নিজেকে নতুন মোড়কে সামনে এনে সেই নরেন্দ্র মোদীই শোনাচ্ছেন ভারতকে বদলে দেয়ার মন্ত্র৷
ছবি: dapd
চা ওয়ালা
১৯৫০ সালে গুজরাটের নিম্নবিত্ত এক ঘাঞ্চি পরিবারে জন্ম নেয়া নরেন্দ্র মোদী কৈশরে বাবাকে সাহায্য করতে রেল ক্যান্টিনে চা বিক্রি করেছেন৷ ঘাঞ্চি সম্প্রদায়ের রীতি অনুযায়ী ১৭ বছর বয়সে যশোদাবেন নামের এক বালিকার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়, যদিও বেশিদিন সংসার করা হয়নি৷ ছাত্র হিসেবে সাদামাটা হলেও মোদী বিতর্কে ছিলেন ওস্তাদ৷ ১৯৭১ সালে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা আরএসএস-এর প্রচারক হিসাবে রাজনীতির দরজায় পা রাখেন মোদী৷
ছবি: UNI
গুজরাটের গদিধারী
১৯৮৫ সালে আরএসএস থেকে বিজেপিতে যোগ দেয়ার ১০ বছরের মাথায় দলের ন্যাশনাল সেক্রেটারির দায়িত্ব পান ১৯৯৫ সালে গুজরাটের নির্বাচনে চমক দেখানো মোদী৷ ১৯৯৮ সালে নেন দলের জেনারেল সেক্রেটারির দায়িত্ব৷ ২০০১ সালে কেশুভাই প্যাটেলের স্বাস্থ্যের অবনতি হলে দলের মনোনয়নে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে আবির্ভূত হন নরেন্দ্র মোদী, যে দায়িত্ব তিনি এখনো পালন করে চলেছেন৷
ছবি: Reuters
দাঙ্গার কালিমা
মোদীকে নিয়ে আলোচনায় ২০০২ সালের দাঙ্গার প্রসঙ্গ আসে অবধারিতভাবে৷ স্বাধীন ভারতের সবচেয়ে ভয়াবহ সেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় গুজরাটে প্রায় ১২০০ মানুষ নিহত হন৷ মোদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হয়েও তিনি দাঙ্গায় উসকানি দেন৷ তিনি এ অভিযোগ স্বীকার করেননি, আদালতও তাঁকে রেহাই দিয়েছে৷ তবে দাঙ্গার পক্ষে কার্যত সাফাই গেয়ে, হিন্দুত্ববাদের গান শুনিয়েই তিন দফা নির্বাচনে জয় পান মোদী৷
ছবি: AP
রূপান্তর
দাঙ্গার পর নিজের ভাবমূর্তি ফেরানোর উদ্যোগ নেন নরেন্দ্র মোদী৷ একজন বিতর্কিত নেতার বদলে উন্নয়নের কাণ্ডারি হিসাবে তাঁকে প্রতিষ্ঠা দিতে শুরু হয় ‘গুজরাট মডেল’-এর প্রচার৷ ২০০৭ সালের পর নিজেকে একজন সর্বভারতীয় নেতা হিসাবে তুলে ধরতে নতুন প্রচার শুরু করেন এই বিজেপি নেতা, প্রতিষ্ঠা করেন ‘ব্র্যান্ড মোদী’৷গুজরাটের উন্নয়নের চিত্র দেখিয়ে কলঙ্কিত ভাবমূর্তিকে তিনি পরিণত করেন ভারতের ত্রাতার চেহারায়৷
ছবি: UNI
ভারতের পথে পথে
ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌঁড়ে নরেন্দ্র মোদী পাড়ি দিয়েছেন তিন লাখ কিলোমিটার পথ৷ সারা ভারতে পাঁচ হাজার ৮২৭টি জনসভায় তিনি অংশ নিয়েছেন, নয় মাসে মুখোমুখি হয়েছেন পাঁচ কোটি মানুষের৷ কট্টর হিন্দুত্ববাদী নেতা হিসাবে শুরু করলেও এবার তিনি হিন্দুত্ব নিয়ে প্রচার এড়িয়ে গেছেন সচেতনভাবে, যদিও বাংলাদেশের মানুষ, ভূখণ্ড এবং ধর্ম নিয়ে নরেন্দ্র মোদী এবং বিজেপি নেতাদের বক্তব্য নতুন সমালোচনার জন্ম দিয়েছে৷
ছবি: AP
নতুন ইতিহাস
ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটই যে এবার ভারতে সরকারগঠন করতে যাচ্ছে, বুথফেরত জরিপ থেকে তা আগেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল৷ ৬৩ বছর বয়সি মোদীর নেতৃত্বে এই বিজয়ের মধ্য দিয়ে তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করতে যাচ্ছে হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি৷ ৭ই এপ্রিল থেকে ১২ই মে অনুষ্ঠিত ইতিহাসের সবচেয়ে বড় এ নির্বাচনে ভোটার ছিলেন ৮১ কোটি ৪০ লাখ৷ তাঁদের মধ্যে রেকর্ড ৬৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ ভোট দিয়েছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
শেষ হাসি
নির্বাচনে বিজেপির প্রতিশ্রুতি ছিল – মোদী প্রধানমন্ত্রী হলে দেশের অর্থনীতি নতুন গতি পাবে, গুজরাটের আদলে তিনি ভারতকে বদলে দেবেন৷ অবশ্য সমালোচকরা বলছেন, ‘কলঙ্কিত ভাবমূর্তি’ ঢাকতে এসব মোদীর ফাঁপা বুলি৷ তাঁর স্বৈরাচারী মেজাজ, শিক্ষা ও অর্থনীতির জ্ঞান নিয়েও ঠাট্টা-বিদ্রুপ হয়েছে৷ বলা হচ্ছে, ভোটাররা টানা তৃতীয়বার কংগ্রেসকে চায়নি বলেই বিজেপি জয় পেয়েছে৷ যদিও শেষ হাসি দেখা যাচ্ছে নরেন্দ্র মোদীর মুখেই৷