1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

তৃতীয় লিঙ্গের হাত ধরে আগমন দেবী দুর্গার

পায়েল সামন্ত কলকাতা
১১ অক্টোবর ২০১৮

আদালতের স্বীকৃতি থাকলেও তৃতীয় লিঙ্গকে সমাজ মেনে নেয়নি৷ কিন্তু সমাজ যাঁদের এতদিন পর্যন্ত দূরে সরিয়ে রেখে এসেছে, এবার তাঁরাই হয়ে উঠেছেন কলকাতার পুজোর মুখ৷

ছবি: DW/P. Samanta 

দেবীপক্ষের শুরুতেই মহানগর জেগে উঠছে অন্যভাবে৷

ছকভাঙা পথে চলছে মহানগরের দিনলিপি৷ পুজোর মুখেই একটি ফ্যাশন শো-তে দেবী দু্র্গার সাবেক সাজে শো স্টপার হিসেবে মঞ্চ কাঁপিয়েছেন ভারতের প্রথম রূপান্তরকামী আইনজীবী মেঘ সায়ন্তনী ঘোষ৷ এবার মহানগরের শারদোৎসবের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মুখ হয়ে উঠেছেন তৃতীয় লিঙ্গের প্রতিনিধি মেঘ সায়ন্তনী৷ প্রচুর পুজো উদ্বোধন ছাড়াও তিনি হয়েছেন পুজোর ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর৷ এমনকি মঙ্গলবার, ৯ অক্টোবর তিনি দেবী দুর্গার চক্ষুদান করেছেন যোধপুর পার্ক কালচারাল অ্যাসোসিয়েশনে৷ এই প্রথমবার শহরের দুর্গাপুজোর শারদ সম্মানের বিচারক হিসেবে থাকছে কোনো রূপান্তরকামী হিসেবে সায়ন্তনীর নাম৷ শহরের প্রায় ৩০০টি পুজোর বিচারের দায়িত্বে থাকছেন তিনি৷ আগামী বছরের পুজোতে তাঁর ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হওয়ার নির্ঘণ্ট তৈরি৷

একসময় এই সায়ন্তনীই পুজো মণ্ডপে ঢুকতে পারতেন না৷ সায়ন্তনীর ভাষায়, ‘‘বয়ঃসন্ধিকালে যখন পাড়ার মণ্ডপে যেতাম, মানুষ আমার নারীসত্তা নিয়ে হাসাহাসি করত৷ এতে আমার চোখে জল চলে আসত৷ পুজোতে আর বেরোতামই না৷ তারপর থেকে নাচের দল নিয়ে শহরের বাইরে থাকতাম পুজোর সময়৷ গত পাঁচ-ছয় বছর ধরে আমি এভাবেই পুজো কাটিয়েছি৷’’

মানুষ ঘুমন্তপুরী থেকে জেগে উঠছে: সায়ন্তনী ঘোষ

This browser does not support the audio element.

আজকের মেঘ সায়ন্তনীর বাড়ির কাছের সোনারপুর রিক্রিয়েশন ক্লাব তাঁদের ১৯তম বর্ষে সায়ন্তনীকে পুজোর ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডার করেছে৷ হাওড়ার মন্দিরতলায় টর্পেডো ওয়েলফেয়ার সোসাইটি তৃতীয়ার দিন সায়ন্তনীর হাতে দুর্গার চক্ষুদান করাচ্ছে৷  কিন্তু এতেই কি সমাজের চিরাচরিত ভাবনাটা পাল্টাবে? 

টর্পেডো ওয়েলফেয়ার সোসাইটির তরফে সৌরভ বন্দ্যোপাধ্যায় ডয়চে ভেলেকে বললেন, ‘‘সমাজ তৃতীয় লিঙ্গদের এখনো মেনে নিতে পারেনি৷ সমাজে এঁদের গ্রহণযোগ্যতা যাতে বাড়ে, তাই আমাদের এই উদ্যোগ৷ আশা করি আমরা এই বার্তা সমাজের সর্বস্তরে পৌঁছে দিতে পারব৷’’

তবে সোনারপুর রিক্রিয়েশন ক্লাবের কোষাধ্যক্ষ এবং সায়ন্তনীর খুব কাছের বন্ধু রাজীব ভুঁইয়া ডয়চে ভেলেকে জানালেন, ব্যাপারটা এতটাই সোজা নয়৷ তিনি বললেন, ‘‘সামান্য উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে ক্লাবের তরফে৷ তবে ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর করা হলেই যে সমাজটা পাল্টে যাবে, তা নয়৷ এটা একটা প্রয়াস মাত্র৷ সারা বছর ধরে এমন নানাভাবে পদক্ষেপ নিয়ে সাধারণ মানুষকে জানাতে হবে৷ সমাজের সব ক্ষেত্রেই এ ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে৷ তবেই এক বছরে না হোক, পাঁচ বছরে সমাজের ভাবনাটা পাল্টাবে৷’’   

ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর করা হলেই যে সমাজটা পাল্টে যাবে, তা নয়: রাজীব ভুঁইয়া

This browser does not support the audio element.

যোধপুর পার্ক কালচারাল অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিমায় সায়ন্তনীর চক্ষুদানের ভাবনাটি যাঁর মস্তিষ্কপ্রসূত, সেই সৌম্যজ্যোতি সেন ডয়চে ভেলেকে বললেন, ‘‘সমাজ তো পাল্টাচ্ছে৷ আজকাল মি-টু আন্দোলন নিয়ে কথা হচ্ছে৷ সেক্স আর জেন্ডারের মধ্যে যে পার্থক্যটা আছে, এটা তো অনেকেই জানেন না৷ তাহলে উৎসবের মিলনের জায়গাতে ট্রান্সজেন্ডারদের ব্রাত্য রাখার ভাবনা কেন?’’

আইনজীবী এবং শিল্পী সায়ন্তনী নাকি রূপান্তরকামী সায়ন্তনী, কোন পরিচয়টা পুজোর প্রচারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে? সৌম্যজ্যোতি মনে করেন, সায়ন্তনীর যোগ্যতা নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই৷ তবে সমাজ শুধু যে পুরুষের সুবিধার্থে তৈরি হয়েছে৷ এ ক্ষেত্রে এই ভাবনাটা পাল্টানোই লক্ষ্য৷ তিনি বলেন, ‘‘আমাদের অগ্রাধিকার নেতিবাচক পরম্পরা ভাঙা৷ পরিবর্তনকে মানতে হবেই আজ নয় তো কাল৷ আজ যদি পরিবর্তন মেনে নিই, তাহলে আগামী দিনগুলো তাড়াতাড়ি ভালো হবে৷ এটা কেন আমরা বুঝতে চেষ্টা করি না! তৃতীয় লিঙ্গের মানুষও রক্তমাংসের মানুষ, তাঁদেরও খিদে-তৃষ্ণা আছে৷ তাঁদের কেন সমাজ-বহির্ভূত ভাবা হবে? এই সচেতনতা বাড়াতেই আমাদের এই ভাবনা৷’’

তৃতীয় লিঙ্গের মানুষও রক্তমাংসের মানুষ, তাঁদেরও খিদে-তৃষ্ণা আছে: সৌম্যজ্যোতি সেন

This browser does not support the audio element.

এ বছরই দেশের প্রথম রূপান্তরকামী আইনজীবী হিসেবে আলিপুর আদালতে যোগ দিয়েছেন সায়ন্তনী৷ আবার এ বছরই শারদোৎসব তাঁর জন্য অনেক সাফল্যমণ্ডিত হয়ে উঠছে৷ এসব দেখে খুশি সায়ন্তনীর সমস্ত লড়াইয়ের অন্যতম শরিক তাঁর মা বীথিকা ঘোষ৷ তিনি বললেন, ‘‘পৃথিবীতে ভালো থাকার অধিকার সকলের আছে৷ সমাজ যে স্বীকৃতি দিচ্ছে, এটা মা হিসেবে দেখতে ভালো লাগছে৷ আজ পাড়ার সবাই বলছে, ওর জন্য আমরা গর্বিত৷ ওর মতো সবাই যেন স্বীকৃতি পায়, সেটাই প্রার্থনা দেবীর কাছে৷’’

সেলিব্রিটি ব্যক্তিত্ব দিয়ে পুজো উদ্বোধনের রেওয়াজকে পিছনে ফেলে বাঙালি আধুনিক চিন্তাভাবনায় যে অনেকটা এগিয়েছে, তারই প্রমাণ শহরের অনেক পুজো কমিটি৷ ‘রূপং দেহি’ অবতারে তৃতীয় লিঙ্গের প্রতি সম্মান প্রদর্শন এ বছর মহানগরের পুজোর অন্যতম সেরা বৈশিষ্ট্য৷ বেহালার শীলপাড়ার বড়বাগান কালচারাল অ্যাসোসিয়েশনের থিমে উঠে এসেছে তৃতীয় লিঙ্গ ও সমকামিতা৷ একইরকমভাবে সন্তোষপুর লেক পল্লীতেও মণ্ডপসজ্জা থেকে প্রতিমার শাড়ির ডিজাইন তৈরিতে থাকছেন রূপান্তরকামীরা৷ সত্যিই কি শহর ক্রমশ জেগে উঠছে, নাকি এটা নিতান্তই কলকাতার পুজোর আকর্ষণীয় চমক? উত্তরে সায়ন্তনী বলেন, ‘‘না, কোনো চমক বা আড়ম্বর নয়৷ মৃগনয়নী উমাসম্মানের প্রধান বিচারক হিসেবে আমি আছি৷ সঙ্গে আছে যৌনকর্মীদের সংগঠন দুর্বার কমিটি৷ পাশাপাশি অনেক রূপান্তরকামী বহু পুজো উদ্বোধন করছেন৷ এটা বিশাল জনজোয়ার৷ নতুন সূর্যোদয় হচ্ছে৷ মানুষ ঘুমন্তপুরী থেকে জেগে উঠছে৷’’

সমাজ যে স্বীকৃতি দিচ্ছে, এটা মা হিসেবে দেখতে ভালো লাগছে: বীথিকা ঘোষ

This browser does not support the audio element.

তৃতীয় লিঙ্গের জীবনভিত্তিক উপন্যাস ‘হলদে গোলাপ’ লিখে পুরষ্কৃত সাহিত্যিক স্বপ্নময় চক্রবর্তী পুজো কমিটির ভাবনাকে সমর্থন করছেন না৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘শুধুমাত্র তৃতীয় লিঙ্গ এই পরিচয় দিয়ে পুজো উদ্বোধন বা চক্ষুদানের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়, তাহলে সেটা অত্যন্ত খারাপ কাজ হচ্ছে৷ এটা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের পক্ষে সম্মানজনক নয়৷ যাঁরা নৃত্যশিল্পী, গায়ক, আইনজীবী, অধ্যাপক হিসেবে জীবনে প্রতিষ্ঠিত, তাঁদের সেই পরিচয়ে আমন্ত্রণ জানানো উচিত৷ তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের আলাদা করে সম্মান দেখানোর দরকার নেই৷ আর পাঁচ জনকে যেভাবে দেখা হয়, তাঁদেরও সেই দৃষ্টিতে দেখা উচিত৷’’

এটা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের পক্ষে সম্মানজনক নয়: স্বপ্নময় চক্রবর্তী

This browser does not support the audio element.

সায়ন্তনীও চান একজন শিল্পী হিসেবে পরিচিত হতে৷ তাঁর আইনজীবী পেশার আড়ালেও যে অন্য পরিচয় আছে, তা ইতিমধ্যে যথেষ্ট সাড়া ফেলেছে৷ তিনি নৃত্যশিল্পী৷ তাঁর নাচের দল ‘রুদ্রপলাশ’ নিয়ে বহু স্থানে নৃত্য পরিবেশন করেন৷ তিনি সঙ্গীতশিল্পী স্বাগতালক্ষ্মী দাশগুপ্তর সুযোগ্য ছাত্রী৷ ১০ অক্টোবর সায়ন্তনী উদ্বোধন করেছেন দক্ষিণ কলকাতার একটি কন্টিনেন্টাল রেস্তোরাঁ৷ তাঁর আশা, একদিন রূপান্তরকামী পরিচয়কে ছাপিয়েও তিনি সমাজে পরিচিতি পাবেন শর্টফিল্মের অভিনেত্রী হিসেবে, সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে, চিত্রাঙ্গদার নৃত্যশিল্পী, খ্যাতনামা আইনজীবী হিসেবে এবং অবশ্যই সাধারণ মানুষ হিসেবে৷

আইনি বাধা অনেক আগেই পেরিয়েছে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ৷ এবার সমাজের মূল স্রোতে ফিরে আসতে শুরু করছেন৷ সায়ন্তনীর জয়যাত্রা শুরু হয়েছে৷ এভাবেই হয়ত যাত্রা শুরু করবেন তাঁর মতো আরো অনেকে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ