রাশিয়ার তেল কম দামে কিনে পরিশোধন করে তা ইউরোপে বিক্রি করছে ভারত। ইইউ-র এই অভিযোগের জবাব দিল দিল্লি।
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশ, সুইডেনের পর বেলজিয়াম পৌঁছেছেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শংকর। মঙ্গলবার ব্রাসেলসে বসে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্র বিষয়ক প্রধান জোসেপ বরেলের অভিযোগের উত্তর দিয়েছেন তিনি। বরেলের অভিযোগ ছিল, রাশিয়ার তেল কম দামে কিনে তা ঘুরিয়ে ইউরোপে বিক্রি করছে বেশ কিছু দেশ। ভারত তার অন্যতম। এদিন জয়শংকর পাল্টা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে বলেছেন, বরেলের ইউরোপীয় কাউন্সিলের রেগুলেশন আরেকবার পড়ে নেয়া উচিত।
জয়শংকরের দাবি, রেগুলেশনের ৮৩৩/২০১৪ নম্বর ধারায় স্পষ্ট বলা আছে, কোনো দেশ রাশিয়া থেকে তেল কিনে পরিশোধন করে তা যদি আবার ইউরোপে বিক্রি করে, তাহলে সেই তেল রাশিয়ার বলে গণ্য হবে না। সুতরাং, ভারত আইন বহির্ভূত কোনো কাজ করছে না। এ বিষয়ে ভারতের বিরুদ্ধে ইউরোপীয় ইউনিয়ন কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না।
রাশিয়ার জ্বালানির ওপর নির্ভরতা যেভাবে কমাবে ইউরোপ
২০২৭ সালের মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাশিয়ার ওপর থেকে তাদের জ্বালানির নির্ভরতা শূন্যে নামিয়ে আনতে চাইছে৷ গত বুধবার এ সংক্রান্ত একটি পরিকল্পনা প্রকাশ করেছে ইউরোপীয় এই জোট৷
ছবি: Jean-Francois Badias/AP/picture alliance
রাশিয়ার ওপর নির্ভরতা
এখন পর্যন্ত রাশিয়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের ৪০ ভাগ গ্যাস ও ২৭ ভাগ তেলের চাহিদা মেটাচ্ছে৷ ইউরোপজুড়ে এই জ্বালানি ঘর গরম রাখতে, বিদ্যুৎ উৎপাদনে এবং শিল্পে ব্যবহৃত হয়৷ এতটা নির্ভরশীলতা হুট করে কমানো সম্ভব নয়৷ তবে ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণ ইউরোপকে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছে৷ অবশ্য এই নির্ভরশীলতা কাটাতে অন্তত আরো পাঁচ বছর প্রয়োজন৷
ছবি: Kremlin Pool/ZUMAPRESS/picture alliance
নবায়নযোগ্যে ভরসা
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সরে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ওপর নির্ভরতা বাড়ানোর পরিকল্পনা আগে থেকেই ছিল৷ কিন্তু ইউরোপীয় কমিশন সেই পরিকল্পনাকে আরো ত্বরান্বিত করতে চাইছে এখন৷ আগের প্রস্তাব অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ শতাংশ নবায়নযোগ্যের পরিকল্পনাকে বাড়িয়ে ৪৫ শতাংশ করতে চাইছে তারা৷ ২০২০ সালের হিসেবে, তাদের ২২ শতাংশ জ্বালানি আসে বায়ু, সৌর ও জৈবশক্তি থেকে৷
ছবি: picture alliance / Zoonar
আইনে পরিবর্তন
লক্ষ্যে পৌঁছাতে ইউরোপীয় কমিশন আইনে পরিবর্তন আনার ঘোষণাও দিয়েছে৷ কড়া বিধিনিষেধের কারণে অনেক প্রকল্প পাস হতে সময় লাগে৷ সেগুলো কিছুটা শিথিলের উদ্যোগ নেয়া হবে৷ এছাড়া বড় বাণিজ্যিক ও আবাসিক ভবনগুলোর ওপর সৌর প্যানেল বসানো বাধ্যতামূলক করার নিয়মও করা হবে৷
ছবি: Philip Reynaers/BELGA/dpa/picture alliance
জ্বালানি সাশ্রয়
কমিশন ২০৩০ সালের মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের জ্বালানি সাশ্রয়ও ১৩ ভাগ কমাতে চায়৷ আগের প্রস্তাবে তা ছিল ৯ শতাংশ৷ এর জন্য অনেক ভবনকে সংস্কার করা হবে, যেন সেগুলোতে কম জ্বালানি খরচ হয়৷ তাদের হিসেব বলছে, মানুষ চাইলে নিজ উদ্যোগে তাদের জ্বালানি খরচ কমাতে পারে৷ এতে করে অন্তত পাঁচ শতাংশ গ্যাসের চাহিদা কমানো সম্ভব৷
ছবি: David McNew/Getty Images
গ্যাসের নতুন অবকাঠামো
ইউরোপ রাশিয়া থেকে বছরে ১৫৫ বিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাস আমদানি করে থাকে৷ নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার ও জ্বালানি সাশ্রয় করে এর বিকল্প তৈরি সম্ভব৷ কিন্তু স্বল্পমেয়াদে ইউরোপ এখন সেই গ্যাসের বিকল্প উৎস খুঁজছে৷ সেক্ষেত্রে হাইড্রোজেন গ্যাস এর বিকল্প হতে পারে৷ কিন্তু এর অবকাঠামো নির্মাণ করতে হবে৷ কারণ যে-কোনো সময় রাশিয়া গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দিলে বিপদ তৈরি হবে, যেমনটি তারা পোল্যান্ড ও বুলগেরিয়ার ক্ষেত্রে করেছে৷
ছবি: Joerg Boethling/imago images
অর্থায়ন
সবমিলিয়ে জ্বালানি খাতে ২০২৭ সালের মধ্যে ২১০ বিলিয়ন ইউরো বিনিয়োগ করতে চায় ইইউ৷ ২০৩০ সালের মধ্যে এটি ৩০০ বিলিয়ন হবে৷ এর মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানির জন্য ৮৬ বিলিয়ন, হাইড্রোজেন অবকাঠামোর জন্য ২৭ বিলিয়ন ইউরো, ২৯ বিলিয়ন ইউরো বিদ্যুৎ গ্রিড উন্নয়নে ও ৫৬ বিলিয়ন ইউরো জ্বালানি সাশ্রয় অবকাঠামো ও হিট পাম্প তৈরিতে খরচ হবে৷
ছবি: Christoph Hardt/Geisler-Fotopress/picture alliance
6 ছবি1 | 6
রাশিয়ার বিরুদ্ধে এগারোতম নিষেধাজ্ঞার প্যাকেজ তৈরি করছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। সেখানেই এই তৃতীয় দেশের তেল বিক্রির প্রসঙ্গটি উঠেছে। এর আগের নিষেধাজ্ঞার প্যাকেজে রাশিয়া থেকে তেল এবং গ্যাস কেনার বিষয়ে একাধিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে ইইউ। কিন্তু অভিযোগ, ভারত, সৌদি আরব এবং চীনের মতো কিছু দেশ এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করছে। তারা রাশিয়ার কাছ থেকে অপরিশোধিত তেল কম মূল্যে কিনছে। এরপর তা নিজেদের দেশে পরিশোধন করে ইউরোপে বিক্রি করছে। ফলে ঘুরপথে রাশিয়ার তেল ইউরোপে ঢুকছে। রাশিয়াও নিজের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে।
এগারোতম নিষেধাজ্ঞার প্যাকেজে এই তৃতীয় দেশগুলির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়ে আলোচনা হয়েছিল। তারই ভিত্তিতে বরেল তার মন্তব্যটি করেছিলেন। মঙ্গলবার সেই মন্তব্যেরই পাল্টা জবাব দিয়েছেন জয়শংকর।
রাশিয়ার কাছ থেকে তেল কেনা নিয়ে অবশ্য গত প্রায় এক বছর ধরেই ভারতের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছে ইউরোপীয় দেশগুলি। অভিযোগ, ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরে ইইউ এবং অ্যামেরিকা যখন রাশিয়ার বিরুদ্ধে কঠিন অবস্থান নিয়েছে, ভারত তখনো রাশিয়ার সঙ্গে ব্যবসা চালিয়ে গেছে। কম দামে তেল কিনছে। কয়েকমাস আগে দিল্লিতে এসেছিলেন জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনালেনা বেয়ারবক। জয়শংকরের সঙ্গে একাধিক বিষয়ে তার আলোচনা হয়েছিল। সেখানে ভারতের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্কের বিষয়টিও উঠেছিল।
এসব দেশে মজুত আছে সবচেয়ে বেশি তেল
বিশ্ব রাজনীতিতে জ্বালানি তেলের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে৷ যেসব দেশে জ্বালানি তেলের মজুত বেশি, তারা হয় কোনো দেশের শত্রু অথবা মিত্র৷ ছবিঘরে দেখুন কোন ১০টি দেশে তেলের মজুত সবচেয়ে বেশি৷
ছবি: Reuters/H. Romero
নাইজেরিয়া
তেলের মজুত: ৩৬ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন ব্যারেল৷ এটি বিশ্বের মোট মজুতের দুই ভাগের বেশি৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Bureau
লিবিয়া
তেলের মজুত: ৪৮.৩৬ বিলিয়ন ব্যারেল, যা বিশ্বের মজুতকৃত ক্রুডের প্রায় তিন ভাগ৷
ছবি: DW/K. Zurutuza
রাশিয়া
তেলের মজুত: ৮০ বিলিয়ন ব্যারেল, যা বিশ্বের মজুতকৃত অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের প্রায় পাঁচ ভাগ৷
ছবি: picture-alliance/dpa
সংযুক্ত আরব আমিরাত
তেলের মজুত: ৯৭ দশমিক ৮ বিলিয়ন ব্যারেল, যা বিশ্বের মোট মজুতের প্রায় ছয় ভাগ৷
ছবি: picture-alliance/dpa
কুয়েত
তেলের মজুত: ১০১.৫০ বিলিয়ন ব্যারেল৷ বিশ্বের ছয় ভাগের বেশি জ্বালানি তেলের মজুত আছে দেশটিতে৷
তেলের মজুত: ১৫৫ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ব্যারেল, যা বিশ্বের মোট মজুতকৃত ক্রুড তেলের সাড়ে নয় ভাগ৷
ছবি: imago/Xinhua
ক্যানাডা
তেলের মজুত: ১৭০.৮৬ বিলিয়ন ব্যারেল৷ মোট মজুতের প্রায় সাড়ে দশভাগই আছে দেশটিতে৷
ছবি: AFP/Getty Images/M. Ralston
সৌদি আরব
তেলের মজুত: ২৬৭ দশমিক ০৩ বিলিয়ন ব্যারেল৷ বিশ্বের ক্রুড তেলের ১৬ ভাগ মজুত আছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশটিতে৷
ছবি: M. Naamani//AFP/Getty Images
ভেনেজুয়েলা
তেলের মজুত: ৩০২.৮১ বিলিয়ন ব্যারেল, যা মোট মজুতের ১৮ ভাগ৷
ছবি: picture-alliance/dpa/C. Sanchez
10 ছবি1 | 10
বৈঠকের পর যৌথ সাংবাদিক বৈঠকে জয়শংকর বলেছিলেন, ভারত রাশিয়ার থেকে খুবই কম মূল্যের তেল কেনে। সব মিলিয়ে তা ১২-১৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এত নিষেধাজ্ঞার পরেও ইউরোপীয় ইউনিয়ন এর চেয়ে অনেক বেশি মূল্যের গ্যাস এবং তেল রাশিয়ার থেকে কিনছে। এ বিষয়ে একটি ওয়েবসাইটের নাম উল্লেখ করেছিলেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। রাশিয়া ফসিল ফুয়েল ট্র্যাকার নামক ওই ওয়েবসাইটে কোন দেশ রাশিয়ার থেকে কত মূল্যের তেল এবং গ্যাস কিনছে, তা নথিভুক্ত করা আছে বলে জানিয়েছিলেন তিনি। ই প্রতিবেদন লেখার সময় রাশিয়া ফসিল ফুয়েল ট্র্যাকারের হিসেব বলছে, এত নিষেধাজ্ঞার পরেও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর রাশিয়ার থেকে ৮৮ মিলিয়ন ইউরোর তেল, ৬২ মিলিয়ন ইউরোর গ্যাস এবং তিন মিলিয়ন ইউরোর কয়লা কিনছে। তেল গ্যাস এবং কয়লা মিলিয়ে চীন কিনেছে প্রায় ৮১ মিলিয়ন ইউরোর প্রাকৃতিক সম্পদ। আর ভারত কয়লা আর তেল কিনেছে প্রায় ২৯ মিলিয়ন ইউরোর।
ব্রাসেলসে জয়শংকর জানিয়েছেন, যুদ্ধের পর রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য বেড়েছে, এমন নয়। আগে যে বাণিজ্য সম্পর্ক ছিল, তা-ই বহাল আছে।