মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে জার্মান সামরিক বাহিনীর আফগান ‘সন্ত্রাসীদের’ একটি ‘হত্যা তালিকা’ দেয়ার খবরে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন জার্মানরা৷ আসলে সত্য স্বীকার করা কখনও কখনও যন্ত্রণার কারণও হয়ে উঠতে পারে, মনে করেন ক্যার্স্টিন ক্নিপ৷
বিজ্ঞাপন
প্রকাশিত কয়েকটি তথ্য অস্বস্তিকর৷ এতটাই অস্বস্তির যে, অনেকে সেগুলো উপেক্ষা করবে৷
এমনই একটি তথ্য হলো, একসময় আফগানিস্তানে নিয়োজিত থাকা আন্তর্জাতিক বাহিনীর নীতিমালার মধ্যে থেকে জার্মান সামরিক বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা পর্যবেক্ষণ, আটক, এমনকি হত্যার জন্য কয়েকজনের নাম তালিকায় অন্তর্ভুক্তির জন্য সরবরাহ করেছে৷ জার্মান দৈনিক ‘বিল্ড' তাদের প্রতিবেদনে এই তালিকাকে ‘হত্যা তালিকা' বলে উল্লেখ করেছে৷
এই বিষয়ে জার্মানদের বিস্মিত হওয়ার ঘটনা এটাই প্রমাণ করে যে, আজকের আধুনিক যুগেও কিছু ঘটনা ‘অজানা' থেকে যেতে পারে৷ ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে প্রথম এই তালিকার অস্তিত্ব সম্পর্কে জানা যায়৷ ঐ বছরের ৮ সেপ্টেম্বরের তারিখ দেয়া ‘প্রিন্টেড ম্যাটার ১৭/২৮৮৪' শীর্ষক কাগজপত্রে জার্মান সরকার তালিকায় থাকাদের নিয়ে কী করা হবে তার একটি বর্ণনা দিয়েছে৷ সেখানে তাদের আটকের কথা বলা হয়েছে৷ অবশ্য সরকার এটাও বলেছে যে, তাদের (তালিকাভুক্তদের) ‘সম্ভাব্য সামরিক টার্গেট' করা যেতে পারে৷ সহজ কথায় এর মানে হলো, তালিকায় থাকা ব্যক্তিরা সামরিক অভিযানের লক্ষ্য হতে পারে এবং পরিণামে তাদের হত্যা করা যেতে পারে৷
জার্মান সরকার অবশ্য ‘টার্গেটেড কিলিং' বিষয়টির অনুমোদন দেয়নি৷ তবে সেটার সম্ভাবনাও নাকচ করেনি৷ জার্মান সামরিক বাহিনী ন্যাটোকে সেই তালিকা সরবরাহ করেছে৷
বিল্ড পত্রিকা তাদের প্রতিবেদনে ‘মিলিটারি টার্গেটস' শব্দটি ব্যবহার করে একটি বিষয় পরিষ্কার করেছে যে, ভবিষ্যতে কি হতে যাচ্ছে সেটা জানাই ছিল৷ এসব ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশল সবসময় খোলাসা ছিল৷
আফগানিস্তান ত্যাগ করছে জার্মান সেনাবাহিনী
আফগানিস্তানে জার্মান সামরিক বাহিনী ‘বুন্ডেসভেয়ার’ এর কম্ব্যাট মিশন শেষ হচ্ছে ২০১৪ সালে৷ তাই সেনাসদস্যদের সঙ্গে কয়েক হাজার টন যুদ্ধ উপকরণ এবং অন্যান্য পণ্যও ফেরত আনতে হবে৷ বিছানা থেকে শুরু করে বিশাল ট্যাংক রয়েছে তালিকায়৷
ছবি: cc-by/Sebastian Wilke/Bundeswehr
বিশাল কর্মযজ্ঞ
জার্মান সেনাবাহিনীর সাড়ে চার হাজারের মতো সেনা সদস্য, সতের শত যান এবং ছয় হাজারের মতো কন্টেইনার রয়েছে আফগানিস্তানে৷ ২০১৪ সালে আফগানিস্তানে আন্তর্জাতিক বাহিনী আইসাফ এর কর্মকাণ্ড শেষ হওয়ার আগেই জার্মান সেনাবাহিনীর অনেক সম্পদ ফিরিয়ে আনা হবে৷ এই সম্পদের মধ্যে মেশিনগান থেকে শুরু করে পঞ্চাশ টন ওজনের ট্যাংক রয়েছে৷
ছবি: cc-by-nd/Bundeswehr/Bienert
ট্রাবজন হাব
হিন্দুকুশ থেকে বিভিন্ন পণ্য ফিরিয়ে আনতে জার্মানি যে দুটি হাব ব্যবহার করছে তার একটি তুরস্কের ট্রাবজন৷ এই বন্দর হয়ে জার্মানিতে পৌঁছাবে বুন্ডেসভেয়ার-এর বিভিন্ন পণ্য৷ তবে আফগানিস্তান থেকে ট্রাবজন পর্যন্ত পণ্য পৌঁছানোর প্রক্রিয়া সহজ নয়৷
ছবি: cc-by-nd/Sebastian Wilke/Bundeswehr
পর্যায়ক্রমে প্রত্যাহার
গত এগারো বছরের বেশি সময় ধরে আফগানিস্তানে অবস্থান করছে জার্মান সেনাবাহিনী৷ তাদেরকে মূলত সেদেশের উত্তরে মোতায়েন করা হয়েছিল৷ ইতোমধ্যে অনেক ক্যাম্প খালি করা হয়েছে৷
ছবি: cc-by-nd/Bundeswehr/Bienert
সবাই সম্ভবত ফিরছেন না
২০১৪ সালের শেষ নাগাদ সম্ভবত সকল জার্মান সেনা ঘরে ফিরবেন না৷ জার্মানি আইসাফের ম্যান্ডেট মেনে আটশো সেনা আরো দীর্ঘ সময়ের জন্য আফগানিস্তানে রাখতে পারে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
সব পণ্য ফিরবে না
আফগানিস্তানে পাঠানো কিছু জার্মান পণ্য ফেরত আনা হবে না৷ কিছু পণ্য বিক্রি অথবা ধ্বংসে করে ফেলা হবে৷ তবে অস্ত্রশস্ত্র কন্টেইনারে ভরে নিয়ে আসা হবে৷ ইতোমধ্যে এসব পণ্য জমা করা শুরু হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
আরেক হাব: মাজার-ই-শরিফ
আফগানিস্তান থেকে জার্মান সেনাবাহিনীর পণ্য ফিরিয়ে আনার আরেকটি হাব হচ্ছে মাজার-ই-শরিফ৷ সে দেশের চতুর্থ বড় এই শহর থেকে অধিকাংশ পণ্য বিমানে পরিবহন করা হচ্ছে৷ তবে পাকিস্তান, উজবেকিস্তান এবং তাজাকিস্তান হয়ে সড়ক পথেও কিছু পণ্য ফেরত আনা হবে৷ তবে নিরাপত্তার কারণে বেশি পণ্য এভাবে পরিবহন হবে না৷
ছবি: picture-alliance/dpa
রক্ষণাবেক্ষণ এবং জীবাণুমুক্তকরণ
জার্মান সেনাবাহিনীর এসব পণ্যের মাধ্যমে আফগানিস্তান থেকে কোন জীবাণু যাতে জার্মানিতে প্রবেশ করতে না পারে, সে জন্য এসব পণ্য জীবাণুমুক্ত করা হবে৷ জার্মানিতে এসব পণ্য প্রবেশের আগেই এটা করা হবে৷
ছবি: Bundeswehr - PIZ SKB/Foto: Vanita Schanze
বিমানে আফগানিস্তান ত্যাগ
বড় এবং ভারি যানবাহন পরিবহনের মতো বিমান জার্মান সামরিক বাহিনীর নেই৷ ফলে ছবির এই বিশাল সামরিক যান পরিবহনের জন্য একটি ইউক্রেনীয়-রাশিয়ান কনসর্টিয়ামের সহায়তা নেওয়া হচ্ছে৷ এই ব্যবস্থায় প্রত্যেক উড়ালে ৩৭ মিটার দীর্ঘ জায়গায় ১৫০ টন পণ্য পরিবহন সম্ভব হচ্ছে৷
ছবি: cc-by-nd/Bundeswehr/Weinrich
সরাসরি জার্মানিতে ফেরত
অস্ত্র এবং কারিগরিভাবে সংবেদনশীল বিভিন্ন পণ্য বিমানে আফগানিস্তানের মাজার-ই-শরিফ থেকে সরাসরি জার্মানিতে ফেরত আনা হচ্ছে৷ ছবির ট্যাংকটি এই সুবিধা পাচ্ছে৷
ছবি: cc-by-nd/Bundeswehr/Schmidt.
বাকি পণ্য আসছে তুরস্ক হয়ে
অস্ত্রবিহীন গাড়ি, রেডিও এবং তাঁবুর মতো পণ্য সরাসরি জার্মানিতে আনা হচ্ছে না৷ আফগানিস্তান থেকে বিমানে এগুলো তুরস্কের ট্রাবজন বন্দরে আনা হচ্ছে৷
ছবি: cc-by/Sebastian Wilke/Bundeswehr
জাহাজে প্রত্যাবর্তন
ট্রাবজন বন্দরে জার্মান সেনাবাহিনীর জন্য কাজ করছেন ১৭০ ব্যক্তি৷ এই বন্দর থেকে ত্রিশ হাজার বর্গমিটার পণ্য জাহাজে জার্মানিতে পাঠাতে কাজ করছেন তারা৷ সমুদ্রপথে বিভিন্ন পণ্য ট্রাবজান থেকে জার্মানিতে পোঁছাতে সময় লাগে দুই সপ্তাহের মতো৷
ছবি: Bundeswehr - PIZ SKB/Foto: Vanita Schanze
11 ছবি1 | 11
‘ভালো লোক', নোংরা হাত
যুদ্ধের সময় ‘ভালো লোক'-এর হাতেও যে ময়লা লাগতে পারে, এই তালিকা তার প্রমাণ৷ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের ধারাগুলো যুদ্ধের সময় ঠিকভাবে মেনে চলা সম্ভব হয় না – অন্তত যেমন হওয়া উচিত, তেমনভাবে নয়৷
অস্বস্তিকর কয়েকটি প্রশ্ন
আত্মরক্ষার অধিকারের বিষয়টি কখন প্রযোজ্য হবে, যেটা টার্গেটেড কিলিং এর বিষয়কে আইনসম্মত করবে? ‘প্রত্যাশিত' আত্মরক্ষার বিষয়টি কার কাছে কেমন হবে? অন্য কথায় বলা যায়, হামলা ঠেকাতে শত্রুর উপর কখন আক্রমণের অনুমতি দেয়া যেতে পারে? এবং কখন এটা আইনসম্মত হবে?
আরও কিছু প্রশ্ন আছে যেগুলোর উত্তর এখনও পাওয়া যায়নি৷ ‘যোদ্ধা' আর ‘সন্ত্রাসী'-র সংজ্ঞা আসলে কী? একটি অভিযানে কতজন সাধারণ মানুষ হত্যা করা যায়? ভয়ংকর এক অপরাধীকে হত্যা করতে গিয়ে নিরীহ মানুষকে হত্যা করা যায় কিনা, করলে কতজন?
যে তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালানো হচ্ছে সেটা কতখানি বিশ্বাসযোগ্য তা খুব গুরুত্বপূর্ণ৷ এমন অনেক অভিযান পরিচালিত হয়েছে যার জন্য অনেক মানুষ মারা গেছে – অথচ যার জন্য অভিযান তার কিছু হয়নি, কারণ তাঁর তখন সেখানে থাকার তথ্যটি ঠিক ছিল না৷ এক্ষেত্রে শুধুমাত্র ‘দুঃখিত' বলে পার পাওয়া যাবে না৷ মানুষের মূল্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ৷ আফগানিস্তানের ক্ষেত্রেও সেটা প্রযোজ্য৷
আফগানিস্তানে বাড়ছে আফিম চাষ
আফগান চাষীরা আবারো বেশি করে ঝুঁকছেন আফিম চাষের দিকে৷ এর মধ্যেই উৎপাদনের পরিমাণ অতীতের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে৷
ছবি: AP
বিশ্ব নেতা
আফিম চাষের দিক থেকে বিশ্বের কোনো দেশই আফগানিস্তানকে টেক্কা দিতে পারবে না – তাই এক্ষেত্রে আফগানিস্তানকে ‘বিশ্ব নেতা’ বলা যেতে পারে৷ ২০১৩ সালে দেশটিতে ২ লাখ ৯ হাজার হেক্টর জমিতে পপি ফুলের চাষ হয়েছে৷ এই পপি ফুলের বীজ থেকেই তৈরি হয় আফিম এবং হেরোইন৷ বিশ্বের অন্তত ৯০ ভাগ চেতনানাশক মাদক উৎপাদন হয় এখানে৷
ছবি: dapd
বৃহৎ জমি, ব্যাপক উৎপাদন
২০১৩ সালের নভেম্বরে জাতিসংঘ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে যেখানে বলা হয় যে, ২০১৩ সালে এর আগের বছর, মানে ২০১২ সালের তুলনায় আফিমের উৎপাদন ৫০ ভাগ বেড়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
সেনা প্রত্যাহার কি সঠিক সিদ্ধান্ত?
এই হারে আফিমের উৎপাদন বাড়ায় আফগানিস্তান থেকে বিদেশি সেনা প্রত্যাহারের বিষয়টি ভাবিয়ে তুলেছে জাতিসংঘকে৷ ধারণা করা হচ্ছে, সেনা প্রত্যাহারের পর আফগানিস্তানের নিরাপত্তা এবং অর্থনীতির যে ক্ষতি হবে তা পোষাতে আফিমের উৎপাদন আরো বাড়াতে বাধ্য হবেন চাষীরা৷
ছবি: picture alliance/dpa
কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য
জাতিসংঘের অনুমান, ২০১৩ সালে আফগানিস্তানে যে পরিমাণ আফিম উৎপাদন হয়েছে তার মূল্য অন্ততপক্ষে ৯৫ কোটি মার্কিন ডলার৷
ছবি: picture-alliance/ dpa/dpaweb
অর্থের মোহ
স্বল্প উৎপাদনে বিপুল লাভের কারণে পপি উৎপাদনে চাষীদের লোভ বাড়ছে৷ এক কেজি আফিম আফগানিস্তানে বিক্রি হয় ১৫০ মার্কিন ডলারে৷ ফলে এটা তাঁদের জন্য একটি লাভজনক বিনিয়োগে পরিণত হয়েছে৷
ছবি: Getty Images
হেলমন্দ – সমস্যাগ্রস্ত প্রদেশ
জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুযায়ী, আফগানিস্তানে গত বছর যে পরিমাণ আফিম উৎপাদন হয়েছে তার অর্ধেক উৎপাদন হয়েছে দেশটির হেলমন্দ প্রদেশে৷ এই প্রদেশটি জঙ্গি গোষ্ঠী তালেবানের শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বৃথা লড়াই
মাদকবিরোধী লড়াইয়ে আফগানিস্তানকে সহায়তা করছে যুক্তরাষ্ট্র৷ ২০১৩ সালেই দু’দেশের মধ্যে ২৫ কোটি মার্কিন ডলারের একটি চুক্তি সই হয়েছে৷ আফগান সরকারের তথ্য অনুযায়ী, দেশের অন্তত ২ লাখ পরিবার আফিম চাষের উপর নির্ভরশীল৷
ছবি: AP
মাদক বাণিজ্য তালেবানের জন্য লাভজনক
আফগানিস্তানের এই মাদক বাণিজ্য থেকে একটা বড় লাভের অংশ যায় তালেবানের হাতে৷ কাবুল সরকার এবং আন্তর্জাতিক বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অর্থের জন্য আফিম চাষীরা বরাবরই তাদের লাভের একটা অংশ তালেবান জঙ্গিদের হাতে তুলে দেয়৷
ছবি: AP
মাদকাসক্ত শিশু
ব্যাপক উৎপাদনের সাথে ব্যাপক আসক্তির ব্যাপারটাও জড়িত৷ আফগানিস্তানে কেবল যে মাদক উৎপাদন হচ্ছে তাই না, স্থানীয়রা এই মাদক বেচা-কেনাও করে৷ জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পুরো দেশে ১৫ লাখ মানুষ মাদকাসক্ত এবং এদের মধ্যে ৩ লাখই নাকি শিশু৷