করোনা সংকট মোকাবিলায় সরকারি পদক্ষেপের সমালোচকদের উপর থাইল্যান্ড কর্তৃপক্ষ কঠোর দমন-পীড়ন চালাচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল৷
বিজ্ঞাপন
করোনা ভাইরাস নিয়ে সরকার ও রাজতন্ত্রের সমালোচনা করে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে পোস্ট দিলে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিচ্ছে থাইল্যান্ড৷ বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল তাদের প্রতিবেদনে জানায়, প্রধানমন্ত্রী প্রায়ুত চান-ও-চা'র প্রশাসন গত বছর সরকার গঠনের পর থেকে বিশেষ আইনে এ পর্যন্ত অনেক সমালোচকের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেছে৷
অ্যামনেস্টির জ্যেষ্ঠ গবেষণা পরিচালক ক্লার অ্যালগার জানালেন, সরকারবিরোধীদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা রুখতেই একটা আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি করেছে থাইল্যান্ড সরকার৷ করোনা সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার পর সমালোচকদের রুখতে একই ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করছে, যা মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল৷
প্রতিবেদনের শিরোনাম ‘দে আর অলওয়েজ ওয়াচিং’ অর্থাৎ তারা সবসময় সজাগ আছে৷ থাইল্যান্ডের মানবাধিকার কর্মী, সমাজ কর্মী, রাজনীতিবিদ, আইনজীবী, শিক্ষাবিদদের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে তৈরি হয়েছে প্রতিবেদনটি৷ প্রত্যেকেই জানিয়েছেন, সরকার কীভাবে মত প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করছে৷ যারাই সরকারের সমালোচনা করেছে তাদের বিরুদ্ধে এখন ফৌজদারি মামলা চলছে বলে জানান তারা৷
রাষ্ট্রের দমন কৌশল
বাংলাদেশে যখন যে সরকারই ক্ষমতায় এসেছে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দল কিংবা বিরুদ্ধমত দমন করেছে৷ কখনও আইন, কখনও প্রশাসন, কখনও সহযোগী সংগঠনের পেশি শক্তি ব্যবহার করে ভিন্ন মতের মানুষের উপর চালানো হয়েছে নির্যাতন৷
ছবি: Sony Ramany/AFP
জনতার মিছিলে পুলিশের গুলি
সরকার বিরোধী প্রতিবাদ কিংবা মিছিলে পুলিশের গুলি চালানোর ঘটনা বারবার ঘটেছে বাংলাদেশে৷ এরশাদের আমলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে পুলিশ গুলি করে ছাত্রদের হত্যা করে৷ এমন ঘটনা অব্যাহত ছিল গণতান্ত্রিক সরকারের আমলেও৷ ২০০৬ সালে কানসাটে বিদ্যুতের দাবিতে গণবিক্ষোভে ২০ জন নিহত হয়েছে৷
ছবি: DW/H. U. Rashid Swapan
মিছিল-সমাবেশে বাধা
নব্বইয়ের পর গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারগুলো প্রতিপক্ষকে রাস্তায় প্রতিবাদে বাধা দেয়৷ চলে পুলিশি হামলা, নির্যাতনের ঘটনা৷ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই পরিস্থিতি আরো প্রকট হয়েছে৷ শুধু রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নয় নাগরিক সমাজের প্রতিবাদেও বাধা দেয়ার ঘটনা ঘটছে৷
ছবি: bdnews24.com
বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড
বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর হিসেবে ২০১৯ সালের নভেম্বর পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ক্রসফায়ারের শিকার হয়েছেন ৩৬১ জন৷ গত বছর নিহত হয়েছেন ৪২১ জন, যা আগের বছরের তুলনায় তিনগুণ বেশি৷ এসব ক্রসফায়ারের ঘটনায় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ফাসানোর অভিযোগ আছে৷
ছবি: bdnews24.com
গুম কিংবা নিখোঁজ
ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন ফর হিউম্যান রাইটসের (এফআইএইচআর) হিসাবে ২০০৯-১৮ পর্যন্ত গুম হয়েছেন ৫০৭ জন৷ এর মধ্যে ৬২ জনের লাশ পাওয়া গেছে, ১৫৯ জনের হদিস মেলেনি৷ গত ১০ বছরে নিজেদের ৩০০ এর বেশি নেতাকর্মী গুম হয়েছে বলে দাবি করেছে বিএনপি৷ (প্রতীকী ছবি)
ছবি: Getty Images/AFP/O. Kose
মামলার হয়রানি
সবশেষ জাতীয় নির্বাচনের আগে বিরোধী দলের বিরুদ্ধে ৪,৪২৯টি মামলা করা হয়েছে৷ যাতে চার লাখ ৩৪ হাজার ৯৭৫ জনকে আসামি করা হয় বলে অভিযোগ করেছে বিএনপি৷ সেখানে এমনকি মৃত ব্যক্তির বিরুদ্ধে পুলিশের উপর ককটেল ছুড়ে মারার মামলা হয়েছে৷ ভোটকেন্দ্র দখলের অভিযোগ আনা হয়েছে আশি বছরের প্রৌঢ়ের বিরুদ্ধেও৷
ছবি: bdnews24.com
পেশিশক্তির দৌরাত্ম্য
বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলো তাদের সহযোগী সংগঠনগুলোকে বরাবরই ব্যবহার করে আসছে বিপক্ষ বা ভিন্নমত দমনে৷ সাম্প্রতিক সময়ে রাজনীতিতে এমন পেশিশক্তির ব্যবহার আরও প্রকট হয়েছে৷ ২০১৯ সালে ছাত্রলীগের নির্যাতনে বুয়েটে আবরারের মৃত্যুর ঘটনা সবচেয়ে বেশি আলোচনায় এসেছে৷ ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর ও কোটা বিরোধী আন্দোলনকারীদের উপর বারবার হামলার ঘটনা ঘটেছে৷
ছবি: bdnews24.com
নিষ্পেষণমূলক আইন
ভিন্নমত দমনে আশ্রয় নেয়া হয় আইনেরও৷ ২০১৫ সালে করা তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়৷ গণমাধ্যমকর্মী, শিক্ষক, ব্লগার থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে এই আইনে মামলা হয়েছে৷ সেটি বাতিল করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস করা হলে সেখানেও একই ধরনের বিভিন্ন ধারা রাখা হয়৷ এই আইনে আটক হয়ে জেলখানায় বিনা বিচারে মারা যান লেখক মুশতাক আহমেদ৷
ছবি: Reuters/M. Ponir Hossain
গণমাধ্যমের উপর চাপ
বাংলাদেশে এখন বিপুল সংখ্যক গণমাধ্যম থাকলেও তাদের স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন আছে৷ বিভিন্ন সময়ে টিভি চ্যানেল, নিউজ পোর্টাল বন্ধ করে দেয় সরকার৷ মালিকানা, বিজ্ঞাপন বন্ধে চাপ দেয়া, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কারণে গণমাধ্যমগুলো নিজেরাই এখন সেলফ সেন্সরশিপ আরোপ করে বলেও অভিযোগ রয়েছে৷
ছবি: Reuters/M. Ponir Hossain
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিয়ন্ত্রণ
২০১৯ সালের ২৯ জুন ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার জানান, ঐ বছরের শেষ দিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ও ভিডিও শেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম ইউটিউব নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হবে বাংলাদেশ৷ তিনি বলেন, ‘‘রাষ্ট্রের এখন সবচেয়ে বড় ক্ষমতা হচ্ছে রাষ্ট্র ইচ্ছে করলে যে কোনো ওয়েবসাইটকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, এটি বড় অর্জন৷’’
ছবি: picture-alliance/chromorange/C. Ohde
ফোনে আড়িপাতা
সাম্প্রতিক সময়ে সরকার বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মী, বিভিন্ন মানুষের ফোনালাপ ফাঁসের ঘটনা ঘটছে৷ ইউটিউব বা গণমাধ্যমে সেগুলো ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে, লঙ্ঘন করা হচ্ছে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা৷
ছবি: imago/avanti
আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো যা বলছে
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ২০১৯ সালের মানবাধিকার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুমের ঘটনায় কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না৷ সভা-সমাবেশ ও বাকস্বাধীতার ওপর নিয়ন্ত্রণ বেড়েছে৷ হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনে বিরোধী দলসহ নাগরিকদের প্রতিবাদ ও সংবাদ মাধ্যমের ওপর হামলা, মামলা এবং বাকস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের কথা বলা হয়েছে৷
ছবি: AP/DW
11 ছবি1 | 11
করোনা সংক্রমণের কারণে মার্চে জরুরি অবস্থা জারি করার পর থেকে বিরোধীদের উপর দমন-পীড়ন আরো বেড়েছে বলে জানিয়েছে অ্যামনেস্টি৷ যারাই সরকারের সমালোচনা করছে, তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভুয়া খবর ছড়াচ্ছে৷
অনলাইনে বিভ্রান্তিকর সংবাদ ও তথ্য পর্যবেক্ষণ করতে বর্তমান সরকার গত বছরের নভেম্বরে বেশ কয়েকটি ‘অ্যান্টি ফেক নিউজ সেন্টার' বা ‘ভুয়া সংবাদ-বিরোধী কেন্দ্র' স্থাপন করে৷
গত ২৬ শে মার্চ জরুরি পরিস্থিতিতে জন প্রশাসন সংক্রান্ত সরকার জরুরি ডিক্রি জারি করে৷ এর ফলে অনলাইনে যে-কোনো তথ্য মিথ্যা বা ভুল মনে হলে সেগুলো সেন্সর করা এবং তথ্য সংশোধন করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে সরকারি কর্মকর্তাদের উপর৷ এছাড়া যারা এই সমালোচনা করবে, তাদের দুই বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে৷
২০১৬ সালে ‘কম্পিউটার ক্রাইমস অ্যাক্ট' নামে একটি আইন হয়৷ এই আইনকে কাজে লাগিয়ে বিরোধী ও সরকার সমালোচকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে৷ থাই ক্রিমিনাল কোডের ১১৬ নম্বর ধারায় অপরাধ প্রমাণিত হলে সাত বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে৷ অ্যালগার হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, শান্তিপূর্ণভাবে যারা সমালোচনা করছে, তাদের বিরুদ্ধে অপরাধ আইন প্রয়োগ এখনই বন্ধ করা উচিত৷ এছাড়া করোনা সংক্রমণ সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশে ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা'য় হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি৷