দক্ষিণ অ্যামেরিকার গাছে-চড়া ভাল্লুক
১৭ আগস্ট ২০১৬রক্সানা রহাস যে প্রকল্পটির দায়িত্বে, তার উদ্দেশ্য হল অ্যান্ডিজ পর্বতমালার অ্যান্ডিজ ভাল্লুক বা ‘চশমা পরা' ভাল্লুকের জীবনযাত্রা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা৷ কাজেই রক্সানা ও তাঁর সাঙ্গপাঙ্গরা সুদূর অতীতের ইনকাদের পায়ে চলা পথে ক্যামেরা ট্র্যাপ বসাচ্ছেন৷ ভাল্লুকরাও জঙ্গলের মধ্য দিয়ে না গিয়ে এই চলাপথ দিয়েই যাওয়া-আসা করতে পছন্দ করে৷
খুব কম মানুষই অ্যান্ডিজ ভাল্লুক স্বচক্ষে দেখেছেন৷ তবে তাদের চিহ্ন দেখতে পাওয়া যায়৷ ফ্রাংকফুর্ট জুয়োলজিক্যাল সোসাইটির রক্সানা রহাস বলেন, ‘‘এখানে ভাল্লুকের থাবার ছাপ দেখতে পাবেন৷ এই গাছটায় চড়েছে৷ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, কোথায় নখ বসিয়েছে৷ এখানে, ওইখানে... চারটে নখই এখানে ঢুকিয়ে দিয়ে গাছে চড়েছে৷'' রক্সানা দেখালেন, ‘‘এখানে ভাল্লুকের বিষ্ঠা পড়ে রয়েছে, ছোট ছোট ফলের বিচি দেখা যাচ্ছে৷ এগুলো সর্বত্র৷ বেশ অনেকটা৷ ভাগ্য ভালো যে, বর্ষার জলে ধুয়ে যায়নি৷''
দক্ষিণ অ্যামেরিকায় আজও প্রায় ২৫ হাজার অ্যান্ডিজ ভাল্লুক আছে বলে ধরে নেওয়া হয়৷ তবে যে ঘন জঙ্গলে তাদের বাস, তা ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে৷ ইতিমধ্যে তারা এতোই বিরল যে, তাদের জীবনযাত্রার ধরন সম্পর্কে কোনো কিছু জানাই মুশকিল৷ সেজন্য প্রচুর অভিজ্ঞতা লাগে... সেই সঙ্গে ভাগ্য৷ সন্ধ্যায় রক্সানা ও তাঁর দলবল বসে ক্যামেরা ট্র্যাপের ছবিগুলো খতিয়ে দেখেন৷
চিহ্নগুলো সম্ভবত সাক্রা নামের একটি তরুণ ভাল্লুকের৷ বাকি সব অ্যান্ডিজ ভাল্লুকদের মতো সাক্রাও গাছে চড়তে ভালোবাসে – শোবার জায়গার খোঁজে, অথবা ওপর থেকে চারিদিকে নজর রাখতে৷
ভু্ট্টাখেতের ভাল্লুক
আজ রক্সানা আর তাঁর সতীর্থদের দু'হাজার আটশ মিটার খাড়াই চড়তে হবে, অ্যান্ডিজ ভাল্লুকরা একটি ভু্ট্টাখেতের কী দশা করেছে, তা দেখতে ও সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করতে৷ রক্সানা দেখালেন, ‘‘এটা দেখুন৷ এটা থেকে বোঝা যাবে, ভাল্লুক কীভাবে ভুট্টা খায়৷ ঠিক আামাদের মতো করে খায়৷ প্রথমে থাবা দু'টো ব্যবহার করে, তারপর নখ দিয়ে দানা সহ মোচাটা বার করে নেয়৷ কখনো-সখনো মোচাটা ভেতরেই থাকে৷ ভাল্লুকের নখের দাগ খুব ভালো করে বোঝা যায়, যেমন এখানে৷ ভুট্টাটা খুলে দানাগুলো সব খেয়ে ফেলেছে৷ মোচায় আর কিছু লেগে নেই৷''
হাতুন নামের একটি স্থানীয় অ্যান্ডিজ ভাল্লুক ভুট্টাখেতের প্রলোভন সামলাতে পারেনি৷ চাষিদের কী হবে, তা না ভেবে আগে নিজের পেট ভরিয়েছে৷ এখন প্রশ্ন হল, হাতুনকে কীভাবে ভুট্টাখেতের উপর উত্তরোত্তর হানা দেওয়া থেকে রোখা যায়৷ এবার কিন্তু হাতুন যখন ভুট্টাখেতে আসবে, তখন সে পাবে লঙ্কাপোড়ার গন্ধ! রক্সানা তার ব্যবস্থা করছেন৷
হাতুনের ঘ্রাণেন্দ্রিয় খুবই তীক্ষ্ণ – কাজেই তার লঙ্কাপোড়ার গন্ধ ভালো না লাগারই কথা৷ তবে হাতুন হল যাকে বলে কিনা ভবঘুরে৷ সে যে অন্য কোথাও ভুট্টাখেতে হানা দেবে না, তা কে বলবে? কাজেই রক্সানা ও তাঁর সহকর্মীদের ভাল্লুক আর মানুষের মধ্যে এই বিরোধ সমাধানের অন্য কোনো পন্থা খুঁজে বার করতে হবে৷ অ্যান্ডিজ ভাল্লুকরা যেমন বিলুপ্তির মুখে, তেমন চাষিদেরও অস্তিত্বের সংকট৷
চাষি দেমেত্রিও ওহেদা স্পষ্ট সে-কথা বললেন: ‘‘আমি বলতে বাধ্য যে, ভাল্লুকরা আমাদের রুজি-রোজগারের ওপর থাবা বসায়৷ কাজেই তারা অন্য কোথাও গেলে আমার কোনো আপত্তি নেই৷ ওরা যাতে কোনো ক্ষতি না করে, সেদিকে নজর রাখাটা সত্যিই বড় কাজ৷''
চাষিরা তাহলে যায় কোথায়
ফ্রাংকফুর্ট জুয়োলজিক্যাল সোসাইটির প্রকল্পগুলির লক্ষ্য হল, মানুষজনকে চাষবাস ছাড়া অন্য পন্থা দেখানো৷ যেমন তাঁত বোনা; এই অঞ্চলের তাঁতে বোনা কাপড়ের চাহিদা পৃথিবী জুড়ে, ডিজাইনার আর ফ্যাশনেবল বুটিকরা তা নিয়ে কাড়াকাড়ি করে৷ একটি প্রকল্পে স্থানীয় মহিলারা যাতে তাদের হাতে বোনা কাপড় ভালোভাবে বিক্রি করতে পারেন, তার ব্যবস্থা করা হচ্ছে৷
রক্সানা জানালেন, ‘‘এভাবে যে তাদের শুধু রোজগার বাড়ে, শুধু তাই নয় – ওরা মানু ন্যাশনাল পার্কের জীবজন্তুদের ছবি ওদের বোনা কাপড়ে ফুটিয়ে তুলতে পারেন৷ প্রতিটি নকশা, প্রতিটি কাপড়ে ওদের জীবনযাত্রার ছবি ফুটে ওঠে৷ ওরা এই ন্যাশনাল পার্ক ও তার জন্তুজানোয়ারদের ছবি দেখাতে পারেন৷''
মানু ন্যাশনাল পার্ককে বিশ্বের সবচেয়ে প্রজাতি-সমৃদ্ধ ন্যাশনাল পার্ক বলে মনে করা হয়৷ তবে এখানেও সমৃদ্ধি শুধু সম্পদ নয়, বিরোধের সূত্রও বটে৷