পেঙ্গুইন শুধু অ্যান্টার্কটিকায় নয়, দক্ষিণ আফ্রিকায়ও দেখা যায়৷ তবে এই প্রজাতির অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়ছে৷ সরাসরি সংরক্ষণের উদ্যোগ ও বাড়তি সচেতনতা সত্ত্বেও খাদ্যের অভাবে তারা লুপ্ত হয়ে যেতে পারে৷
বিজ্ঞাপন
সমুদ্রে শিকারের পর এবার বিশ্রামের পালা৷ পেঙ্গুইনদের জীবন ব্যস্ততায় ভরা৷ প্রতিদিনই তারা কয়েক ঘণ্টা সমুদ্রে মাছ ধরে৷ নিজেরা খায়, সন্তানদের জন্য মাছ ধরে নিয়ে যায়৷ দক্ষিণ আফ্রিকার পশ্চিম উপকূলে স্টোনি পয়েন্ট-এ পেঙ্গুইনদের কলোনি গোটা মহাদেশে সবচেয়ে বড় বসতি৷ কয়েক হাজার পেঙ্গুইন সেখানে বাসা বেঁধে থাকে৷
কুয়ান ম্যাকজর্জ এই কলোনির সুরক্ষার দায়িত্বে রয়েছেন৷ তিনি রাষ্ট্রীয় প্রকৃতি সংরক্ষণ সংগঠন ‘কেপনেচার'-এর হয়ে কাজ করেন৷ তিনি বলেন, ‘‘এই এলাকায় এটাই একমাত্র কলোনি, যা ফুলেফেঁপে উঠছে৷ দক্ষিণ আফ্রিকার উপকূলে বাকি ২৭টি পেঙ্গুইন কলোনি হয় ছোট হয়ে যাচ্ছে, অথবা বিলুপ্ত হয়ে গেছে৷''
তাই তিনি প্রতি সপ্তাহে পেঙ্গুইন গণনা করেন৷ ডিম ও পেঙ্গুইনছানারা ভালো আছে কিনা, তা পরীক্ষা করেন৷ বেঁচে যাওয়া প্রতিটি প্রাণীই অত্যন্ত মূল্যবান৷ কুয়ান বলেন, ‘‘এই প্রজাতি লড়াই করে বেঁচে আছে৷ মহাসাগরের স্বাস্থ্য জানতে হলে এই প্রজাতির অবস্থা জানা অত্যন্ত জরুরি৷ তাই তাদের সেন্টিনেল স্পিশিজ বলা হয়৷ বায়োমাসের অবস্থা খারাপ হলে সেই প্রজাতিকে টিকে থাকার সংগ্রাম করতে হয়৷ বর্তমানে আমরা আফ্রিকার পেঙ্গুইনদের মূল অংশের ২ থেকে আড়াই শতাংশের উপর নজর রাখছি৷ মনে হয়, বর্তমানে মাত্র ২০,০০০ দম্পতি বংশবৃদ্ধি করছে৷''
বহুগামী পাখিদের কথা
পাখিদের মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশই একগামী হয়ে থাকে৷ অর্থাৎ বাকি দশ শতাংশের স্বভাব একটু ভিন্ন৷ ছবিঘরে জেনে নিন এমন কয়েকটি পাখির কথা৷
ছবি: Imago
সঙ্গী যখন ঘুমে, উনি তখন খোঁজে
দেখতে সুন্দর এই ব্লুটিট পাখির স্বভাব একটু উড়ু-উড়ু৷ সকালবেলায় পুরুষ সঙ্গীটি যখন ঘুমে বিভোর তখন তিনি আশেপাশে বেরিয়ে পড়েন৷ তখন যদি অন্য কোনো পুরুষ পাখিকে গান গাইতে দেখেন তাহলে কিছুক্ষণের জন্য তার সঙ্গে একটু, মানে একটুখানি আনন্দ করে নেন!
ছবি: picture alliance/Arco Images GmbH
রাজহাঁসের কথা
ছবিই বলে দিচ্ছে রাজহাঁস এমনিতে দীর্ঘদিনের জন্য সম্পর্কে জড়াতে আগ্রহী৷ কিন্তু মাঝেমধ্যে যে ‘বিবাহবহির্ভূত’ সম্পর্কে জড়ানোর অভ্যাস কারও কারও নেই সেটা কিন্তু নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না!
ছবি: Otto Durst/Fotolia
ঝাঁক পছন্দ তাদের
তোতাপাখিরা সবসময় এক ঝাঁক হয়ে থাকতে পছন্দ করে৷ ঝাঁকের মধ্যেই এই পাখিরা একজন আরেকজনকে বেছে নিয়ে নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে তোলে৷ উদ্দেশ্য থাকে অনেকদিন একসঙ্গে থাকার৷ কিন্তু তারপরও রাজহাঁসের মতোই তাদেরও কারও কারও এক-আধটু মনে স্বাদ জাগে অন্যকিছু করার!
ছবি: Fotolia/H.Lange
ধারণা ছিল ভুল
একসময় বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল সারস পাখিরা বোধ হয় একগামী হয়ে থাকে৷ কিন্তু পরে জানা গেছে, সেটি সত্যি নয়৷ মাইগ্রেশনের সময় তারা নাকি অন্য কোনো সঙ্গীকে সঙ্গে নিতে পারে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/B. Rössler
সব পেঙ্গুইন এক নয়
ছবিতে গালাপাগোস পেঙ্গুইনদের দেখতে পাচ্ছেন৷ মনে হচ্ছে যেন তারা একে অপরের জন্যই জন্মেছে৷ কিন্তু আসলেই কি তাই? উত্তর – হয়ত কিংবা হয়ত নয়৷ কিন্তু বিজ্ঞানীরা জানতে পেরেছেন, রকহপার পেঙ্গুইন একগামী হয়ে থাকে৷ অর্থাৎ এই জাতের পেঙ্গুইন জোড়াদের একজন আরেকজনের চেয়ে কয়েক হাজার মাইল দূরে থাকলেও একে অপরের প্রতি বিশ্বস্ত থাকে৷
ছবি: picture-alliance/blickwinkel/McPHOTO
5 ছবি1 | 5
সমুদ্রে মাত্রাতিরিক্ত মাছ ধরার ফলে পেঙ্গুইনদের টিকে থাকতে কষ্ট হচ্ছে৷ তারা যথেষ্ট খাবার পাচ্ছে না৷ তাছাড়া পানিতে প্লাস্টিক আবর্জনা ও তেল দুষণের কারণে অনেকের মৃত্যু হচ্ছে৷ স্টোনি পয়েন্ট মূল ভূখণ্ডে দু'টি পেঙ্গুইন কলোনির অন্যতম৷ দু'টি কলোনিই মানুষের বসতির মধ্যে অবস্থিত৷ পেঙ্গুইনরা সম্ভবত বাগান ভালোবাসে৷ তাদেরই একজন দিব্যি এক বার্বিকিউ-এর মধ্যে আরামে বসে আছে৷ বিজ্ঞানীদের অনুমান, বাড়িগুলি চিতাবাঘের মতো হিংস্র প্রাণী দূরে রাখে৷ বিশেষজ্ঞরা পেঙ্গুইনদের স্বাস্থ্য সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করছেন৷ তাঁদেরই একজন কাটরিন লুডিনা৷ তিনি বলেন, ‘‘আমরা প্রতিটি পাখির শরীরে আলাদা আইডি লাগিয়ে দেখি, তারা কতদিন বাঁচে৷ এভাবে আমরা প্রজাতি হিসেবে পেঙ্গুইনদের অস্তিত্ব হিসেব করি৷ তাদের সংখ্যা নাটকীয়ভাবে কমছে৷ তাদের কত ঘনঘন দেখা যায়, তার ভিত্তিতে তাদের বাঁচার হার ও প্রকৃতিতে টিকে থাকার সম্ভাবনা হিসেব করতে পারি৷''
উপকূলবর্তী এলাকায় পর্যটকদের সংখ্যা বাড়ছে, যার ফলে পেঙ্গুইনদেরও উপকার হচ্ছে৷ নৌকায় করে পর্যটকরা বিভিন্ন কলোনি দ্বীপে যাচ্ছেন৷ বছর পঞ্চাশেক আগে ডায়ার আইল্যান্ড ছিল পেঙ্গুইনদের সবচেয়ে বড় ব্রিডিং কলোনি৷ প্রায় ২৫,০০০ পেঙ্গুইন দম্পতি এখানে বাসা বেঁধেছিল৷ কিন্তু পাখির বিষ্ঠা ও ডিম শিকারিদের দৌরাত্ম্যের ফলে সেই বসতি প্রায় পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে৷
পশু-পাখি যখন কাঁদে
সন্তান মারা গেছে, এই সত্য মানতেই পারছিল না গোরিলা মা৷ মৃত সন্তানকে পিঠে নিয়ে কয়েকদিন ঘুরেছে সে৷ সন্তান বা অন্য কোনো প্রিয়জনের মৃত্যুতে ডলফিন, হাতি, বেবুন, কাক, ভালুক বা মাছের শোক পালনও হৃদয়বিদারক৷
ছবি: picture-alliance/dpa/F. Gentsch
গোরিলার সন্তানশোক
জার্মানির ম্যুনস্টার চিড়িয়াখানায় এক গোরিলার বাচ্চা মারা যাওয়ার পর হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়েছিল৷ মা গোরিলাটিকে সবাই ডাকতো গানা আর তার সন্তানকে ডাকতো ক্লাউডিও নামে৷ ক্লাউডিও মারা গেল৷ সন্তানের মৃত্যু মা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না৷ আগের মতো সন্তানকে পিঠে নিয়েই চলাফেরা করছিল সে৷ চিড়িয়াখানার কর্মীদের কেউ কাছাকাছি গেলেই গানা তেড়ে আসত৷ সন্তানহারা গরিলা মায়ের মন শক্ত হতে বেশ কয়েকদিন সময় লেগেছিল৷
ছবি: picture-alliance/dpa/F. Gentsch
সন্তানকে সমুদ্রেই সমাধিস্থ করে মা ডলফিন
সন্তান মারা গেলে ডলফিনরাও দিশেহারা হয়ে পড়ে৷ এমনও দেখা গেছে, সদ্য মারা যাওয়া সন্তানকে মুখে নিয়ে শরীরের ভারসাম্য রক্ষার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে মা ডলফিন৷ মুখ থেকে পড়ে সন্তানের দেহ যখন তলিয়ে যাচ্ছে, ডুব দিয়ে দিয়ে তাকে অনুসরণ করছে মা৷ বড় কেউ মারা গেলেও ডলফিনরা তাকে ছেড়ে যেতে চায় না৷ মৃতদেহকে অনেকক্ষণ ঘিরে থাকে তারা৷
ছবি: Public Domain
হাতির ‘শোকসভা’
হাতিদের শোকও হৃদয় ছুঁয়ে যায়৷ কোনো হাতি মারা গেলে সঙ্গীরা তার পাশে স্থির দাঁড়িয়ে থাকে৷ দূর থেকে অন্য হাতিরাও এসে যোগ দেয় সেই শোকে৷ প্রিয়জন হারানোর দুঃখ হাতি ভুলতেই পারে না৷ তাই অনেকদিন পরও স্বজনের কঙ্কাল বা দেহাবশেষ ছুঁয়ে ছুঁয়ে যেন তাদের স্মরণ করে তারা৷
ছবি: picture alliance/WILDLIFE/M. Harvey
সেবায় মন দেয় শোকসন্তপ্ত বেবুন
এক বেবুন মারা গেলে অন্য বেবুনরা দুঃখে এতটাই কাতর হয় যে তাদের স্ট্রেস হরমোনের ঘনত্ব বেড়ে যায়৷ এবং বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, শোকে যখন দিশেহারা অবস্থা, বেবুনরা তখন একে অন্যের গায়ের লোম পরিষ্কার করায় মন দেয়৷ শোক ভোলার কী অদ্ভুত কৌশল!
ছবি: picture alliance/chromorange
পাখিদের মৃত্যুশোক
কোনো কাক মারা গেলে তার মৃতদেহ ঘিরে অন্য কাকদের শোক অনেকেই হয়ত দেখেছেন৷ বিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রিয়জনের শোকে কাক নাকি অনেক সময় খাওয়া-দাওয়াই বন্ধ করে দেয়৷ পাখিদের মধ্যে যারা এক সঙ্গী নিয়েই জীবন পার করে দেয়, তারা নাকি সঙ্গীর মৃত্যুর পর না খেয়ে খেয়ে মারাও যায়৷ রাজহাঁস আর কিছু গায়ক পাখি নাকি প্রায়ই প্রিয়জনের মৃত্যুর পর এভাবে মৃত্যুকে বরণ করে নেয়৷
বার্লিনের চিড়িয়াখানার এই বিড়াল আর ভালুকটি যেন ছিল ‘হরিহরাত্মা’৷ একজনের কাছ থেকে আরেকজনকে আলাদাই করা যেত না৷ ভালুকটি মারা যাওয়ার পর তাই আজব এক সমস্যা দেখা দিল৷ দেখা গেল, বিড়ালটি আর ভালুকের খাঁচাটি ছেড়ে যাচ্ছে না৷ কয়েকদিন অবিরাম ‘মিঁউ’ ‘মিঁউ’ করে ডেকে ডেকে বন্ধুর প্রতি শোক জানিয়েছিল সে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/A. Rüsche
মনিবের কবর পাহারা দেয় কুকুর
কুকুরের প্রভুভক্তির অনেক গল্প আছে৷ কুকুর তার মনিবকে এতটাই ভালোবাসে যে মনিব মারা গেলে তার কবরে গিয়ে সে বিলাপ শুরু করে৷ জার্মানির একটি কুকুর তো আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমেও বড় খবর হয়েছিল৷ কুকুরটির নাম কাপিটান৷ তার মনিব আর্জেন্টিনায় মারা যান৷ জার্মান শেফার্ডটি আর্জেন্টিনার ভিলা কার্লোসে মনিবের ওই সমাধিস্থল বহু বছর পাহারা দিয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/J. Garff
7 ছবি1 | 7
নৌকা ভ্রমণের আয়ের অর্থ থেকে পরিবেশ সংরক্ষণকারীরা পেঙ্গুইন সুরক্ষা কেন্দ্র গড়ে তুলছেন৷ আহত প্রাণীদের সেখানে আবার নিজের পায়ে দাঁড়াতে সাহায্য করা হয়৷ ডায়ার আইল্যান্ড সংরক্ষণ ট্রাস্টের শুলানি লায়ো বলেন, ‘‘সিলের কামড়ের ফলে এই প্রাণীটির শরীরে একটা ক্ষত রয়েছে৷ এখন সেটা পরিষ্কার করলাম৷ সে তিন সপ্তাহ আমাদের সঙ্গে থাকবে, তারপর ছেড়ে দেবো৷ এবার তাকে খাওয়ানো হবে৷''
শক্তি ফিরে পেলে সে আবার সমুদ্রে ফিরে যেতে পারবে৷ দক্ষিণ আফ্রিকার উপকূলে জীববৈচিত্র্যের ক্ষেত্রে পেঙ্গুইনদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে৷ স্টোনি পয়েন্টে মানুষকে পেঙ্গুইনদের গুরুত্ব বোঝানো এই কাজের গুরুত্বপূর্ণ অংশ৷ কলোনির মধ্য দিয়ে হাঁটার আলাদা রাস্তা রয়েছে৷ বোর্ডে লেখা তথ্য পড়ে পর্যটকরা পেঙ্গুইনদের জীবনযাত্রা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারেন৷ এক পর্যটক বললেন, ‘‘মানুষকে সঠিক তথ্য ও শিক্ষা দেওয়া উচিত৷ পরিবেশবান্ধব পর্যটনে ঠিকমতো ভারসাম্য আনলে বড় মাত্রার ইতিবাচক প্রভাব পড়বে৷ অন্যদিকে ঠিকমতো নিয়ন্ত্রণ না করলে নেতিবাচক প্রভাবও পড়তে পারে৷''
বিশেষ করে সমুদ্রবক্ষে পেঙ্গুইনদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা কার্যত অসম্ভব৷ উপকূল থেকে দূরে আন্তর্জাতিক জেলেদের বহরের কাছে পেঙ্গুইনদের তেমন কোনো মূল্য নেই৷ কিন্তু সেখানেই পেঙ্গুইনদের অস্তিত্বের সংগ্রাম চলছে৷ মাছের পরিমাণ কমে গেলে পেঙ্গুইনদেরও মৃত্যু হবে৷ বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, এই প্রবণতা বন্ধ করা না গেলে বিশ বছরের মধ্যে এই প্রজাতি পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে৷